লিওনেল মেসি—আর্জেন্টিনা
কাতার বিশ্বকাপই লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ। সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও খেলবেন না তিনি। সেই হিসাবে, ৩৫ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়ের জন্য অধরা বিশ্বকাপ ঘরে তোলার এটাই শেষ সুযোগ। সুযোগটা অবশ্য হোঁচট খেয়েছে শুরুতেই। প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে গেছে আর্জেন্টিনা। মেসির কাজটা বেশ কঠিনই বলা যায়। তবে নামটা লিওনেল মেসি বলেই আশায় বুক বেঁধেছেন সমর্থকেরা। ফুটবল মেসিকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু মেসিরও ওই একটাই অপূর্ণতা—বিশ্বকাপ। মেসির ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে তিনি বিশ্বকাপ জয় করতে পারেননি একটুর জন্য। কিন্তু এখনো সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৮৬ সালের পর আর বিশ্বকাপ জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা। এবার যদি মেসি অধরা বিশ্বকাপটি ধরে ফেলতে পারেন, তাহলে একমাত্র অপূর্ণতাটাও পূর্ণতা পাবে। মেসি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ৭ বার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। হয়তো তাঁর নামের আগেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিরোনামটি বসানো যেতে পারে।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো—পর্তুগাল
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বয়স ৩৭ বছর। নানা বিতর্কের পর বিশ্বকাপের মধ্যেই শেষ হয়েছে তাঁর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অধ্যায়। তবে ভুলে গেলে চলবে না, এখনো আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকালের শীর্ষ গোলদাতা রোনালদো। এবারের বিশ্বকাপের মাধ্যমে তিনি নিশ্চয়ই সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে চাইবেন। যদিও রোনালদো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেননি যে এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। তবে তাঁর বয়স বিবেচনা করে বলাই যায়, কাতার বিশ্বকাপের পরে আর কোনো বিশ্বকাপের খেলায় দেখা যাবে না সিআর সেভেনকে। ২০১৬ সালে ইউরো জেতার পরে এখন তাঁর একটাই আফসোস—বিশ্বকাপ। নিজের ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ ছাড়া যে আর বাকি সব কাপের স্বাদ পাওয়া হয়ে গেছে। পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জয়ী সুপারস্টার কি পারবেন সতীর্থদের অনুপ্রাণিত করে প্রথমবার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসরে নিজের অপূর্ণতার স্বাদ পেতে? সময় বলে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর।
নেইমার জুনিয়র—ব্রাজিল
এ বছর ব্রাজিল দলের রয়েছে বেশ কিছু তরুণ খেলোয়াড়। তবে ব্রাজিলের মূল ভরসা কিন্তু নেইমারই। মেসি-রোনালদোর পর কারও নাম আলোচনায় নিতে হলে নামটি অবশ্যই নেইমার। তবে নেইমারের মূল শত্রু একটাই—ইনজুরি। তাঁর ফিটনেস নিয়ে ব্রাজিল শিবিরে চিন্তার ভাঁজ ছিল সব সময়ই। এত কিছুর পরও তিনিই এখনো দলের সেরা খেলোয়াড়। আর মাত্র তিনটি গোল করলেই জীবন্ত কিংবদন্তি পেলেকে ছাড়িয়ে তিনিই হবেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এবারের বিশ্বকাপে তাঁর সতীর্থদের নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো শিরোপা ঘরে তুললেও নিশ্চয়ই কেউ অবাক হবে না।
তুমি কি জানো? | ২০১৮ বিশ্বকাপে আয় করা নিজের সব টাকা প্রিমিয়ার ডি কর্ডি নামের একটি শিশুদের দাতব্য সংস্থায় দান করেছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
কিলিয়ান এমবাপ্পে—ফ্রান্স
২০১৮ সালে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় কিলিয়ান এমবাপ্পের। প্রথম বিশ্বকাপেই করেন বাজিমাত। চারটি গোল করে ফ্রান্সের দুই দশকের শিরোপার আক্ষেপ ঘোচান এই ফরোয়ার্ড। ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত একটি গোলও করেন ১৯ বছর বয়সী এই তারকা। ব্রাজিলের কিংবদন্তি খেলোয়াড় পেলের পর দ্বিতীয় কিশোর হিসেবে ফাইনালে গোল করেন এমবাপ্পে। গত মেয়াদে ফরাসি ক্লাব পিএসজির হয়ে ৩৯ গোল ও ২৬ অ্যাসিস্টই বলে দেয়, এই বিশ্বকাপে গোল্ডেন বলের দৌড়ে ভালোভাবেই এগিয়ে আছেন তিনি।
রবার্ট লেভানডফস্কি—পোল্যান্ড
প্রায় এক দশক জার্মানির ক্লাবে খেলার পরে সম্প্রতি বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছেন রবার্ট লেভানডফস্কি। এখন পর্যন্ত লা লিগায় ভালোভাবেই থিতু হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, লেভানডফস্কি নিজের ক্যারিয়ারকে আরও সফল করতে যোগ দিয়েছেন স্পেনের ক্লাব বার্সোলোনায়। কাতার বিশ্বকাপই ৩৪ বছর বয়সী লেভানডফস্কির শেষ বিশ্বকাপ। নিশ্চয়ই নিজের শেষ বিশ্বকাপটা রাঙিয়ে রাখতে চাইবেন এই পোলিশ স্ট্রাইকার। বিশ্বকাপে কখনোই কোনো গোল করতে পারেননি তিনি। এবার প্রথম ম্যাচেই পেনাল্টিতে গোল করার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। এই লেখা যখন লিখছি, ততক্ষণে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য কাঙ্ক্ষিত গোলটি পেয়ে গেছেন তিনি। লেভানডফস্কি নিজের সেরা ফর্মে ফিরে এলে বদলে যেতে পারে অনেক সমীকরণ।
কেভিন ডি ব্রুইনা—বেলজিয়াম
বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের শেষ অধ্যায় চলছে। ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের শীর্ষ দলের খেতাব পেয়েছে বেলজিয়াম। কিন্তু প্রায়ই এই শীর্ষ স্থানকে চোখ রাঙানি দেয় তাদের শিরোপা–খরা। তাই চাপ বাড়ছে কেভিন ডি ব্রুইনার ওপর। ম্যানচেস্টার সিটির ৩১ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার নিরলসভাবে চেষ্টা করছেন বেলজিয়ামের হয়ে একটি বিশ্বকাপ জিততে। কিন্তু বারবার হতাশ হতে হয়েছে তাঁর দলকে। ২০১৮ বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া, ২০২০ ইউরো কাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির কাছে হার তারই বহিঃপ্রকাশ। ডি ব্রুইনা ভালোভাবেই জানেন, এটাই তাঁর জন্য শেষ সুযোগ। হয় এবারই হবে, না হলে আর কখনো নয়।
গ্যারেথ বেল—ওয়েলস
২০১৩ সালে রেকর্ড মূল্যের লেনদেনে টটেনহ্যাম থেকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন গ্যারেথ বেল। দুর্ভাগ্যবশত ওয়েলস সুপারস্টারের জন্য স্পেনের জীবনটা শেষ দিকে কঠিনই ছিল। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের দল লস অ্যাঞ্জেলেসের হয়ে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। গ্যারেথ বেল ওয়েলসের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত। অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে তাঁর দুটি গোল আর ইউক্রেনের বিপক্ষে ফ্রি-কিক থেকে গোল ৬৪ বছর পর বিশ্বকাপ খেলার স্বাদ দিয়েছে ওয়েলসকে। প্রথম ম্যাচেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করেছেন ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। নিজের প্রথম বিশ্বকাপে বেল ওয়েলসকে কত দূর নিয়ে যেতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আলফনসো ডেভিস—কানাডা
বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষে ওঠা আলফনসো ডেভিসকে নিয়ে সত্যিই একটি তথ্যচিত্র হতে পারে। ২০০০ সালে ঘানার একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন ডেভিস। ঘানায় জন্মানো প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৬ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপস দলে যোগ দেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে চুক্তি করেন ডেভিস। ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগসহ প্রায় সব কটি একক ক্লাবের শিরোপা জিতেছেন তিনি। উত্তর আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় ডেভিসকে। যদিও প্রথম ম্যাচে পেনাল্টি পেয়েও সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি এই কানাডিয়ান তারকা। ১৯৮৬ সালের পর দ্বিতীয়বার কানাডা বিশ্বকাপ খেলছেন এবার।
ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন—ডেনমার্ক
ফিরে আসার গল্পের সঠিক উদাহরণ হতে পারেন ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। ২০২০ সালের ইউরোতে ম্যাচের মধ্যেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন এরিকসেন। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারসহ গোটা জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু এরিকসেন কিছুই শেষ হতে দেননি, বরং ফিরে এসেছেন বীরদর্পে। ৩০ বছর বয়সী টটেনহ্যামের সাবেক মিডফিল্ডার বর্তমানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলছেন। কাতার বিশ্বকাপে তিনিই হতে পারেন ডেনমার্কের মাঝমাঠের সবচেয়ে বড় তারকা। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনাল। এরিকসেনরা নিজেদের সেরাটা দিতে পারলে ছাড়িয়ে যেতে পারেন বিশ্বকাপের নিজেদের সেরা সাফল্যও।
তুমি কি জানো? | ২০১৫ সালে উলসবার্গের বিপক্ষে ৯ মিনিটে ৫ গোল করার সময় দ্রুততম হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড গড়েন রবার্ট লেভানডফস্কি। বুন্দেসলিগার ম্যাচে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডও তাঁর দখলে।
হ্যারি কেইন—ইংল্যান্ড
হ্যারি কেইনের পারফরম্যান্স তাঁর পক্ষেই কথা বলে। ২৯ বছর বয়সী এই ইংলিশ ফরোয়ার্ড প্রতি দুই ম্যাচে গড়ে একটির বেশি গোল করেছেন জাতীয় দলের হয়ে। অবশ্য ২০২০ ইউরোর কারণে ওই বছরটা তাঁর ভালো কাটেনি। ফাইনালে টাইব্রেকারে ইতালির কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় ইংল্যান্ড। তবে কেইন বর্তমানে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মেই আছেন। ২০১৮ বিশ্বকাপে মেসি, নেইমার, রোনালদোকে হটিয়ে গোল্ডেন বুট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। গত কয়েক বছরের ব্যর্থতা ঢাকতে আবারও কেইনের জন্য সবচেয়ে বড় মঞ্চ এই বিশ্বকাপ।
ভার্জিল ফন ডাইক—নেদারল্যান্ডস
২০১৯ সালে মাত্র ৭ পয়েন্টের জন্য ব্যালন ডি’অর হাতছাড়া হয়েছে ভার্জিলের। সেবার লিওনেল মেসি জিতেছিলেন এই পুরস্কারটি। ৩১ বছর বয়সী ফন ডাইক লিভারপুল এবং নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের রক্ষণভাগের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস ফেবারিট না হলেও ফন ডাইকের নেতৃত্বে যেকোনো বড় দলকে বিপদে ফেলতে পারে ডাচরা। ২০১৫ সাল থেকে দেশের হয়ে ৫০টির বেশি ম্যাচ খেলেছেন ফন ডাইক। গত বিশ্বকাপের টিকিট না পাওয়া নেদারল্যান্ডস চাইবে এই বিশ্বকাপকে রাঙিয়ে রাখতে। তার জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে ফন ডাইককেই।
ফিল ফোডেন—ইংল্যান্ড
ম্যানচেস্টার সিটিতে আর্লিং হলান্ডের আগমন অনেক খেলোয়াড়কেই চিন্তিত করে তুলতে পারে। তবে ফিল ফোডেন সেই কাতারে নেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৬-৩ গোলে হারানোর ম্যাচে দর্শকেরা দেখেছিল, ২২ বছর বয়সী ফোডেন কী করতে পারেন। হলান্ডের পাশাপাশি তিনিও হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ফোডেন হতে পারেন ইংল্যান্ড দলের মূল ভরসা। অবশ্য ২০২০ ইউরোর ফাইনালে ইতালির সঙ্গে টাইব্রেকার হারের দুঃখ ভোলার কথা নয় ফোডেনের। নিজের প্রথম বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে সে দুঃখ ভোলার চেষ্টা তিনি নিশ্চয়ই করবেন।