ব্রাজিলের রোজকার ট্রেনিং তখনো শুরু হয়নি। তিতে মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন সহকারীদের সঙ্গে। আজ কীভাবে কী করতে হবে, আলোচনা করছেন তা নিয়ে। তখনই কোচদের জটলায় কোথা থেকে এসে মাথা ঢুকিয়ে দিলেন নেইমার। সাবধান করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ওই যে দেখেন, বাচ্চাগুলো কিন্তু আসছে।’
মাথা ঘুরিয়ে তিতে দেখেন, দল বেঁধে আসছে রাফিনিয়া, ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগোরা। হাসতে হাসতে তিতে বলেন, ‘তারা তো সব পাগল। তাদের সামলাতে আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়!’
ঝাঁকবেঁধে আসা এই তরুণদের তিতে ডাকেন, ‘পেরনিনিয়া হাপিদাস’ (Perninhas Rapidas) নামে। পর্তুগিজ এই শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘ছোট ক্ষিপ্র পা’। বয়সে অনেক ছোট এই খেলোয়াড়দের দ্রুত ছুটতে পারার ক্ষমতার জন্যই এ নাম। কিন্তু শত বিরক্ত আর ছেলেমানুষি করলেও এই ঝাঁকের ওপর তিতের কোনো অভিযোগ নেই। কারণ, তারা এসে যে খেলাই বদলে দিয়েছে ব্রাজিলের। ২০০৬ সালের পর ‘জোগো বনিতো’ আর ‘সাম্বা’র যে হাহাকার ছিল দলটিতে, সেটি পূরণ করে দিয়েছে এই কচিকাঁচার দল। ওরা আছে বলেই প্রায় ১৬ বছর পর এমন একটি দল পেয়েছে ব্রাজিল, যাদের দেখে এবার সমর্থকেরা সত্যি সত্যিই আশায় বুক বাঁধতে পারেন। স্বপ্ন দেখতে পারেন ষষ্ঠ বিশ্বকাপের।
২০১৪ আর ২০১৮ সালের দলটিকে খারাপ বলা যায়—এমনটাও নয়। কিন্তু এই দুই বিশ্বকাপে নেইমারের কাঁধে যে ওজনটা ছিল, তা অনেকখানি কমে গেছে এবার। লম্বা সময় ধরে ব্রাজিল দলে ছিল সহজাত উইঙ্গারের অভাব। নেইমার লেফট উইঙ্গার হলেও দলের জন্য খেলতেন পুরো মাঠজুড়ে। সম্ভাবনা দেখিয়েও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি কুতিনহো। তিনি নিজেও একজন লেফট উইঙ্গার, নেইমার থাকায় অনেক ম্যাচ খেলেছেন রাইট উইঙ্গে। উইঙ্গের দুর্বলতার জন্য দলের দুই ফুলব্যাককে উঠে আসতে হতো অনেক ওপরে, ফলে নড়বড়ে হয়ে যেত ডিফেন্স। সব মিলিয়ে কোনোভাবেই পরিপূর্ণ এক দল হচ্ছিল না সেলেসাওদের।
এই অভাব পূরণ করে দিয়েছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রাফিনিয়া, রদ্রিগো, মারতিনেল্লি, আন্তনিরা। লেফট উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস আর রাইট উইঙ্গার রাফিনিয়া কতটা ভয়ংকর, সেটি প্রমাণ হয়ে গেছে অনেক আগে। সমান পারদর্শী বদলি হিসেবে থাকা রদ্রিগো, মারতিনেল্লি আর আন্তনিও। উইং শক্তিশালী হয়ে যাওয়ায় চাপ কমে গেছে নেইমারের কাঁধ থেকে, ফলে এখন খেলতে পারেন পুরোমাঠ দাপিয়ে। পাশাপাশি ব্রাজিলের সব আক্রমণ এখন উইংভিত্তিক হওয়ায় ফুলব্যাকদের খুব বেশি ওপরে উঠে আসতে হয় না, যার ফলে ডিফেন্স লাইন থাকে দৃঢ়। সর্বশেষ ৫০ খেলায় ব্রাজিলের মাত্র ১৯ গোল হজম করাই এর প্রমাণ।
কিন্তু একটা খটকা ছিল। সবাই মনে করছিলেন, ইউরোপের বড় কোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেনি এই দল। ফলে সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের অনেক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ইংল্যান্ড বা স্পেনের মতো বড় কোনো দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলা হয়নি দলটির।
কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতে না হতেই এই আশঙ্কা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বে সুইজারল্যান্ড আর সার্বিয়া পাত্তাই পায়নি নেইমারদের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে ক্যামেরুনের কাছে ১-০ গোলে হেরে গেলেও দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে জয় এসেছে হেসেখেলে। ফলে সবাই এখন বুঝতে পারছেন, ব্রাজিলের কিছু হয়নি বরং সেলেসাওদের বিপক্ষে খেলতে না পারায় হয়তো ক্ষতি হয়েছে ইউরোপীয়ান দলগুলোরই।
এসব কারণেই ব্রাজিলের এই দলকে ২০১৪ আর ২০১৮ বিশ্বকাপের দলের থেকে অনেক এগিয়ে রেখেছেন দেশটির সাবেক ফুটবলার গ্রাফিতে। বিবিসি স্পোর্টসের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি নিজের মতামত তুলে ধরেন, ‘আগের দুই বিশ্বকাপের তুলনায় ব্রাজিলের এবারের দলটা অনেক বেশি প্রস্তুত। দলে ‘পেরনিনিয়া হাপিদা’র অন্তর্ভুক্তির ফলে নেইমারের বোঝা কমে গেছে অনেকখানি।’
তবে নেইমারের অবদানও ছোট করে দেখছেন না এই ফুটবলবোদ্ধা, ‘কাতার বিশ্বকাপ জিততে হলে নেইমারকে অবশ্যই নিজের সেরা খেলাটাই খেলতে হবে। কিন্তু দলটি এখন আর আগের মতো নেইমারনির্ভর নয়। কারণ, দলের শক্তি বেড়েছে অনেকখানি। নেইমার এখন ডানে তাকালে দেখবেন রাফিনিয়াকে, যে চমৎকার ড্রিবলিং পারে, ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে দুর্ধর্ষ। আপনি দলের যেখানেই তাকান, দেখবেন প্রতিভার ছড়াছড়ি।’
গত বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের কাছে ২-১ গোলে হারার ম্যাচে মোট যে ১৪ জন খেলেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে ব্রাজিলের এবারের স্কোয়াডে আছেন মাত্র ৪ জন। বাদ পড়ে গেছেন বাকি সবাই। আগের বিশ্বকাপের তুলনায় ভালো হলেও এই দলের ওপর চাপটাও অনেক বেশি। কাতার বিশ্বকাপ যদি জেতা না হয়, তাহলে আবারও ২৪ বছর বিশ্বকাপহীন থাকতে হবে ব্রাজিলকে। এর আগেও বিশ্বকাপের জন্য একবার ২৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল সেলেসাওদের। ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ের পর আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য অপেক্ষাটা ছিল ২৪ বছরের। টগবগে এই দলটি নিশ্চয়ই চাইবে না আবারও সেই পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে।
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ গত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু কোরিয়ার বিপক্ষে সাম্বার যে ঝলক দেখিয়েছে দলটি, সেটি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কে জানে, এ বছরই হয়তো কেটে যাবে ব্রাজিলের ষষ্ঠ শিরোপার দুঃখ। জোগো বোনিতোর ছোঁয়ায় রঙিন বিশ্বকাপ হয়ে উঠবে আরও রঙিন!