মেসি না রোনালদো: কার লিগ বেশি সহজ?

একটা সময় ছিল যখন প্রতি সপ্তাহেই ইউরোপের সেরা লিগ মাতাতেন মেসি-রোনালদো। ইউরোপের সেরা মঞ্চে নিয়মিতই মুখোমুখি হতেন একে অপরের। তাঁদের দ্বৈরথ দেখতে টিভি পর্দার সামনে অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন দর্শকেরা। একজন দুই গোল করলে অন্যজন তার জবাব দিচ্ছেন হ্যাটট্রিক করে। সময়ের কাঁটা ঘুরে সেসব আজ বহু দূরের স্মৃতি। সেসব দিনের কথা ভাবনাতে আসা মানেই যেন নতুন করে নস্টালজিয়ায় ভাসা, আর মনে মনে আফসোস করা।

সময়ের স্রোতে সেদিন আর নেই। দুজনের ইউরোপিয়ান লিগ অধ্যায়ের ইতি টানা হয়েছে এই মৌসুমেই। বিশ্বকাপের পরপরই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে, অন্যদিকে মৌসুম শেষে লিওনেল মেসির গন্তব্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিজেদের ইউরোপ থেকে সরিয়ে নিলেও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি তাঁদের ফর্মে। বয়সের ভারে ইউরোপে নিজের সেরাটা দিতে না পারলেও দূর পরবাসে ঠিকই তাঁদের খেলা মুগ্ধ করছে বিশ্বকে। সৌদি লিগে রোনালদো যেমন গোলের পর গোল করে চলছেন, তেমনিভাবে মেসি গোল-অ্যাসিস্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন মেজর লিগ সকারে।

পৃথিবীর দুই প্রান্তে, দুই মহাদেশে দুই মহাতারকা শেষবেলায় নিজেদের মতো করে উপভোগ করছেন ফুটবলকে। কিন্তু সমর্থকদের উন্মাদনা তো তাতে থেমে থাকে না। দুই পক্ষই নিজেদের প্রিয় খেলোয়াড়কে শীর্ষে দেখার জন্য উদগ্রীব, একইভাবে তাই প্রশ্নটাও সামনে এসেছে, সৌদি প্রো লিগ নাকি মেজর লিগ সকার; কোন লিগে খেলা বেশি সহজ?

লিগ সিস্টেম

যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার পৃথিবীর অন্য সব লিগের মতো নয়। মেজর লিগ সকারের চিন্তাধারা এবং খেলার ধরন পুরোটাই বিশ্বের অন্যান্য লিগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মেজর লিগ সকারের সূচনা ১৯৯৬ সালে, সেটাও শুরু হয়েছিল ফিফার জুড়ে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী। ১৯৮৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি পায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তখনো নিজস্ব কোনো ফুটবল লিগ ছিল না তাদের। বরং কানাডার সঙ্গে মিলে ‘নর্থ আমেরিকান সকার লিগ’-এ অংশ নিত যুক্তরাষ্ট্রের দল। অনেকটা বিপাকে পড়েই বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নিজেদের লিগ তৈরির উদ্যোগ নিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। যদিও শর্ত অনুযায়ী লিগ শুরু করতে পারেনি তারা। ১৯৯৪ সালে নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। দুই বছর পর অদ্ভুত সব নিয়মের বেড়াজালে সৃষ্টি হয় ‘মেজর লিগ সকার’ বা ‘এমএলএস’-এর।

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, ‘এমএলএস’ অনুষ্ঠিত হয় বছরে মাত্র ছয় মাস। মার্চের শুরু থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। এরপর এমএলএস কাপ চলে প্রায় ১ মাস। সব মিলিয়ে ৭ মাসের মধ্যেই পুরো মৌসুমের ইতি টানা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ জায়গাই শীতকালে তুষারের নিচে থাকে বলে গ্রীষ্মের উষ্ণতা থাকতে থাকতেই লিগ শেষ করার তাড়া তাদের মধ্যে। যে কারণে অনেকের কাছে ‘পিকনিক লিগ’ নামেও পরিচিত ‘এমএলএস’।

মজার ব্যাপার হলো, এই লিগে নেই কোনো রেলিগেশন পদ্ধতি।অর্থাৎ লিগ টেবিলে সবার নিচে অবস্থান করলেও পরের ডিভিশনে নেমে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।এমনকি শীর্ষে থাকলেই যে শিরোপা জিতবে, তারও নিশ্চয়তা নেই এখানে। ‘এমএলএস’-এ খেলা ২৯ দলকে রাজ্যের অবস্থানের ওপর ভাগ করা হয়েছে ২টি বিভাগে; ইস্টার্ন কনফারেন্স ও ওয়েস্টার্ন কনফারেন্স।লিওনেল মেসির দল ইন্টার মায়ামি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব দিকের রাজ্য হওয়ায় তারা খেলছে ইস্টার্ন কনফারেন্সে।প্রতি মৌসুমে প্রতিটি দল মোট ৩৪টি ম্যাচ খেলে।নিজের কনফারেন্সের দলের বিপক্ষে দুটি করে ও অন্য কনফারেন্সের যেকোনো ৮টি দলের বিপক্ষে একটি করে।লটারির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় কোন ৮ দলের বিপক্ষে খেলবে তারা।৩৪ ম্যাচের মৌসুম শেষে দুই কনফারেন্স মিলিয়ে শীর্ষে থাকা দলের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘এমএলএস সাপোর্টার্স শিল্ড’।ব্যাপারটা বার্সা-রিয়াল শীর্ষে থাকলেই যেমন লিগ শিরোপা জিতে নেয়, অমন নয়।বরং লিগ টেবিলে শীর্ষে থাকার জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার যেন।আসল লিগ ট্রফি জিততে তাদের খেলতে হবে ‘এমএলএস কাপ’!

‘এমএলএস কাপ’–এর ফরম্যাট অনেকটা বিশ্বকাপের নকআউট রাউন্ডের মতো। একটাই ম্যাচ; জিতলে আছ, নইলে বাড়ির পথ ধরো। দুই কনফারেন্সের শীর্ষ ৯ দল নিয়ে ১৮ দলের টুর্নামেন্ট। ইস্ট কনফারেন্সের ৯টি দল মুখোমুখি হবে ইস্ট কনফারেন্সের দলের আর ওয়েস্ট কনফারেন্সের ৯টি দল মুখোমুখি হবে ইস্ট কনফারেন্সের দলগুলোর। সেখান থেকে টিকে থাকা একমাত্র দল মুখোমুখি হবে অন্য কনফারেন্সে টিকে থাকা দলের। সেটাই হলো ‘এমএলএস কাপ’-এর ফাইনাল! সেই ফাইনালজয়ী দলের হাতে ওঠে এমএলএস-এর শিরোপা। মেজর লিগ সকারের ইতিহাসে মাত্র সাতবার ‘এমএলএস সাপোর্টার্স শিল্ড’জয়ী দল ‘এমএলএস কাপ’ও জিতেছে। গত মৌসুমে যা করে দেখিয়েছিল গ্যারেথ বেলের লস অ্যাঞ্জেলেস এফসি।

লিওনেল মেসি এমন এক লিগে খেলছেন, যেখানে শীর্ষে থাকলেও শিরোপা নিশ্চিত নয়, আবার ১৮তম অবস্থানে থাকলেও থাকছে শিরোপা জয়ের সুযোগ। অন্যদিকে রোনালদোর জন্য লিগ ততটা উন্মুক্ত নয়। বরং সৌদি আরবের লিগ আর দশটা ইউরোপিয়ান লিগের মতোই।

এই মৌসুম থেকে সৌদি প্রো লিগে খেলবে মোট ১৮টি দল। গত মৌসুমে যা ছিল ১৬। প্রতি মৌসুম শেষেই লিগ টেবিলের নিচের তিনটি দল অবনমিত হয় পরবর্তী লিগে। আর শীর্ষ দুই দল সুযোগ পায় এশিয়ার ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’ খ্যাত এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে। বলতে গেলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যেভাবে লিগ পরিচালিত হয়, একই নিয়মে ৪৭ বছর ধরে নিজেদের লিগ চালিয়ে আসছে সৌদি আরবের ফুটবল কর্তৃপক্ষ।

সৌদি লিগে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে গত মৌসুমে, যখন সৌদির সেরা চারটি ক্লাব ‘আল নাসর’, ‘আল ইতিহাদ’, ‘আল হিলাল’ ও ‘আল আহলি’র ৭৫ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয় সৌদির ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট ফান্ড’ বা পিএফআই। যাদের লক্ষ্য সৌদির ফুটবলে বিশ্ববাসীর নজর আনা। ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য তাদের করা বিড যাতে আরও পাকাপোক্ত হয়।

মেজর লিগ সকার (বাঁয়ে) ও সৌদি প্রো লিগের (ডানে) লোগো

প্রতিপক্ষ

‘মেজর লিগ সকার’ অনেকের কাছেই পরিচিত রিটায়ারমেন্ট হোম হিসেবে। ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ প্রান্তে কিছু বাড়তি টাকাপয়সা আয়ের জন্য খেলোয়াড়েরা পাড়ি জমান মেজর লিগ সকারে। লিওনেল মেসিও অবশ্য তার ব্যতিক্রম নন। যে কারণে আমেরিকান লিগে মেসির কঠিন প্রতিপক্ষ বলতে তেমন কেউই নেই। জেরদান শাকিরি, লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে, হাভিয়ের চিচারিতোর মতো খেলোয়াড় খেললেও নামের ভারে কিংবা পুরো দল মিলিয়ে মেসির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেননি কেউই।

সৌদি প্রো লিগেও রোনালদো যোগ দিয়েছেন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। কিন্তু মৌসুম ঘুরতে না ঘুরতেই সৌদি প্রো লিগ হয়ে উঠেছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত লিগ। সবার নজর এখন সৌদির দিকে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ যোগ দিচ্ছে সৌদির কোনো ক্লাবে। কে নেই সেখানে? এন’গোলো কান্তে, সাদিও মানে, রিয়াদ মাহরেজ, ফ্যাবিনহো, রবার্তো ফিরমিনো থেকে শুরু করে বর্তমান ব্যালন ডি’অর জয়ী করিম বেনজেমা। এমন না যে শুধু ক্যারিয়ারের শেষবেলায় থাকা খেলোয়াড়েরা ছুটছেন সৌদি লিগে। রুবেন নেভেস, সেইন্ট-ম্যাক্সিমিনের মতো তারকারাও ছুটছেন সৌদিতে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, প্রত্যেকে কিন্তু একই দলে ভিড়ছেন না, বরং সৌদির একেকটি ক্লাব কিনছে একেকজনকে। ফলে বাড়ছে পুরো লিগের মানই। সঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। এই মৌসুমে ইংলিশ আর স্প্যানিশ লিগের পর সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সৌদি লিগ, তা এখন থেকেই বোঝা যাচ্ছে।  

সতীর্থ

লিওনেল মেসি ভিড়তে না ভিড়তেই তারকাদের ভিড় শুরু হয়েছে ইন্টার মায়ামিতে। ডেভিড বেকহাম বেছে বেছে লিওনেল মেসির সাবেক সতীর্থদের ডেকে আনছেন মায়ামিতে। মেসির পিছু পিছু বার্সেলোনা ছেড়ে যোগ দিয়েছেন সার্জিও বুসকেটস, জর্দি আলবা। গুঞ্জন আছে লুইস সুয়ারেজকেও কেনার চিন্তা করছেন বেকহাম। বলতে গেলে মেসির নিজের মতো খেলার জন্য ঠিক যেভাবে দলকে সাজানো দরকার, সেভাবেই সাজাচ্ছেন বেকহাম।

অন্যদিকে রোনালদোর আশপাশের নামগুলোও কম বড় নয়। গোলবারের নিচে ডেভিড অসপিনা, মাঝমাঠে সাদিও মানে আর মার্সেলো ব্রোজোভিচের মতো ইউরোপ–কাঁপানো তারকা আছে তাঁর পাশে। যদিও তাঁদের সঙ্গে এখনো খেলার সুযোগ মেলেনি তাঁর। মৌসুম শুরু হলেই পাকাপোক্ত হওয়া শুরু করবে তাদের জুটি।

জনপ্রিয়তা

ইউরোপিয়ান লিগের আনুষ্ঠানিক র‍্যাঙ্কিং থাকলেও, পৃথিবীর সব লিগ মিলিয়ে কোনো অফিশিয়াল কোনো র‍্যাঙ্কিং নেই। তবে মেজর লিগ সকার তাদের জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন খেলোয়াড়কে আকৃষ্ট করে নিজেদের নাম কামিয়েছে সর্বমহলে। ডেভিড বেকহাম থেকে কাকা, ইব্রাহিমোভিচ, ডেভিড ভিয়া, ওয়েইন রুনি, আন্দ্রে পিরলো থেকে গঞ্জালো হিগুয়েন, গ্যারেথ বেলরা খেলে গিয়েছেন এই লিগে। যে কারণে লোকমুখে ও ফুটবল সমাজেও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে মেজর লিগ সকারের। সঙ্গে একটু দুর্নামও আছে বৈকি। সবার কাছে তাঁদের পরিচয় ‘রিটায়ারমেন্ট হোম’ হিসেবেই। কেনই–বা হবে না? বড় বড় যতগুলো নাম শুনলে, সবাই এখানে ভিড়েছিলেন তাদের ক্যারিয়ারের শেষবেলায়। অবশ্য শেষবেলায় এলেও লিগের নাম বাড়াতে ঠিকই অবদান রেখেছেন তাঁরা।

এদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে সৌদি প্রো লিগ। রোনালদো যোগ দেওয়ার আগে তাঁদেরই নামই জানত না কেউ। হাতে গোনা দু-একজন হয়তো ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপে তাঁদের খেলতে দেখেছে, এ ছাড়া তাঁদের অবস্থান আজীবনই লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু রোনালদো যোগ দেওয়ার পর থেকেই হুড়হুড় করে জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে সৌদি লিগের। এতটাই বাড়তে শুরু করে যে স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান লিগ ফেলে সৌদি আরবের লিগ সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু করে কয়েকটি টিভি চ্যানেল। এবারের দলবদলের মৌসুমে তো আরও এক ধাপ এগিয়েছে তারা। বড় বড় খেলোয়াড়ের আগমনে সৌদি লিগের দলগুলোর নাম এখন সবার মুখে মুখে।

পরিশিষ্ট

বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে চেহারায়, খেলায় সেই পুরোনো উদ্যম নেই। ইউরোপ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়েও বিন্দুমাত্র লাইমলাইটের বাইরে যাননি দুজনে। এখনো প্রতিটি গোলে, প্রতিটি অ্যাসিস্টে কেঁপে উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিটি কোনা। হ্যাঁ, আগের মতো কাটাছেঁড়া হয়তো হয় না। গোল মিস করলে হাসির রোল হয়তো আর ওঠে না। কিন্তু তাঁদের যে দিন গেছে, একেবারেই হয়তো তা যায়নি। যায়নি বলেই আজও সমর্থকদের নজর থাকে তাঁদের প্রতিটি ম্যাচে, প্রতিটি শটে।

মেসি না রোনালদো, কার লিগ সহজ; সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। পরিস্থিতিভেদে ইতিহাসের সেরা দলটাও আটকে যেতে পারে পুঁচকে কোনো দলের কাছে। আবার সবচেয়ে দুর্বল দলটাও হয়ে উঠতে পারে সর্বেসর্বা। ফুটবল এমনই; অদ্ভুত, রোমাঞ্চকর, অনিশ্চয়তায় ভরপুর। কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, ইতি একদিন সবাইকেই টানতে হয়। ইউরোপ থেকে অনেক দূরে থাকা মেসি-রোনালদোও একদিন ইতি টানবেন তাঁদের ক্যারিয়ারের। শেষ সময়ে এসেও তাঁদের নিয়ে অহেতুক ঝগড়া না করে বরং একসঙ্গে উপভোগ করি, কী বলো?