ফুটবলে নেইমারের আগমন হয়েছিল ধূমকেতুর মতো। ব্রাজিলের ফুটবলে তখন প্রতিভার বড্ড অভাব। ফর্ম হারিয়েছেন রোনালদিনহো, কাকাও বেশির ভাগ সময়ই থাকেন চোটগ্রস্ত। রোনালদোর পর বলার মতো কোনো ‘নাম্বার নাইন’ জোটেনি তাদের কপালে। তখনই আশার বাণী হয়ে এসেছিলেন নেইমার। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ব্রাজিলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুটিই ভাবা হয়েছিল নেইমারকে। অথচ সেই নেইমার মাত্র ৩১ বছর বয়সেই বলার মতো কিছু করা ছাড়াই ইউরোপ থেকে বিদায় নিলেন।
অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। নেইমার ছিলেন এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা প্রতিভা। এখন অবশ্য ছিলেনই বলতে হচ্ছে। কারণ, ক্যারিয়ারের বসন্ত যখন কড়া নেড়েছিল তাঁর দরজায়, তখন অবহেলায় সেটা সরিয়ে দিয়েছেন নেইমার। নিজের সেরা সময়, সেরা প্রতিভা সবটার কী দারুণ অপচয়! একসময় ক্যারিয়ারজুড়ে ছিল কোটি মানুষের সমর্থন, পণ্ডিতদের প্রশংসাবাক্য আর ফুটবলের প্রতি অনন্ত ভালোবাসা। এখন কি সেগুলোর কিছু আর অবশিষ্ট আছে? তাঁকে নিয়ে দেখা কোটি স্বপ্ন পরিণত হয়েছে আফসোসে, তাঁকে নিয়ে আশার বাণী ছড়ানো পণ্ডিতেরা বদলে ফেলেছেন মতামত, যা একটু বাকি আছে ভালোবাসা, তা–ও বোধ হয় ফিকে হয়ে গেল টাকার কাছে।
নেইমার ছিলেন সেই খেলোয়াড়, অভিষেকের আগেই যাঁকে পাওয়ার জন্য লাইন ধরেছিল ইউরোপের দলগুলো। যাঁকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়ার জন্য তোলপাড় শুরু হয়েছিল ব্রাজিলজুড়ে। পেলে–রোমারিও পর্যন্ত চিঠি লিখেছেন তৎকালীন কোচ দুঙ্গার কাছে, নেইমারকে দলে একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। মন গলেনি তাঁর, তাই তো মাত্র ১৭ বছর বয়সে অল্পের জন্য বিশ্বকাপের টিকিট হাতছাড়া হয় নেইমারের। তাঁকে রেখে যাওয়া যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন মাসখানেকের মধ্যেই। নতুন কোচ এসেই ভরসা রেখেছেন নেইমারের ওপর। নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন মাঠে নামতে না নামতেই। কী ছিল না তাঁর খেলায়? রেইনবো, ইলাস্টিকো, টর্নেডো ফ্লিক; পরিপূর্ণ সাম্বা খেলোয়াড় বলতে যা বোঝায়, তার সবটাই ছিল নেইমারের মাঝে। ব্রাজিলিয়ানরা তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন বাঁধবে না কেন? যে ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন স্বয়ং ফুটবলের রাজা পেলে, সেই ক্লাব থেকে উঠে আসা নেইমারের ওপর ভরসা করতে দোষ কোথায়?
দোষ ছিল না, অন্তত শুরুর কয়েক বছর যে গতিতে তাঁর ক্যারিয়ার এগোচ্ছিল তাতে দোষ ধরার প্রশ্নই উঠছিল না। নেইমারকে কেনার জন্য পুরো ইউরোপ যখন উঠেপড়ে লেগেছে, তখনই সান্তোসেই নিজেকে গড়ে তুলছেন তিনি। তার আগেও শত শত প্রতিভা ব্রাজিল ছেড়ে ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। আবার হারিয়েও গিয়েছে। নেইমার সেই শত শত প্রতিভার একজন হতে চান না। তিনি চান বিশ্বসেরা হতে। তাই তো সমবয়সী তারকারা যতক্ষণে ইউরোপের নৌকায় পা দিয়ে ফেলেছেন, তখনো নেইমার নিজেকে গড়ে তুলছেন সান্তোসে।
সব জল্পনা–কল্পনা শেষে নেইমার ভিড়লেন ইউরোপে। ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের বিশাল অফার পাশ কাটিয়ে নেইমার ভিড়লেন বার্সেলোনায়। অনেকেই সন্দেহের তির ছুড়েছিলেন সেই ডিলের দিকে। সন্দেহের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায় বার্সেলোনা এবং নেইমার দুই পক্ষই ট্রান্সফার ফি প্রকাশ করতে অপারগ হলে। শুরু হয় তদন্ত, নেইমারের ট্রান্সফার ফি নিয়ে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতির খোঁজ পায় স্পেনের কর বিভাগ। যার জের ধরে জেলে যান বার্সা প্রেসিডেন্ট সান্দ্রো রাসেল, ট্যাক্স ফাঁকির মামলায় ফেঁসে যান নেইমার।
কথায় আছে, সকালের সূর্য দেখেই সারা দিনের পূর্বাভাস বলে দেওয়া সম্ভব। নেইমারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্য উল্টো। বার্সেলোনায় নেইমারের শুরুটাই হয়েছিল বিতর্ক দিয়ে। একদিকে নেইমারকে নিয়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি করছে বার্সা বোর্ড, অন্যদিকে নেইমার মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো বিশ্ব। মনের কোণে ব্রাজিল সমর্থকদের একটা ভয় ছিলই, মেসির ছায়ার নিচে নেইমার না নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু মাঠে বল গড়াতে না গড়াতেই বোঝা গেল, চিত্র পুরোপুরি উল্টো। নেইমার বরং মেসির ছায়াকেই নিজের সবচেয়ে শাণিত অস্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই নেইমার হয়ে উঠলেন বার্সেলোনার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ!
বার্সেলোনায় নেইমারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০১৫ সাল। মৌসুমের শুরুতেই লিওনেল মেসির চোট, নেইমারকে এনে দেয় বার্সেলোনার প্রাণ হয়ে ওঠার স্বীকৃতি। সে দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি তিনি। বরং লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগের দৌড়ে এগিয়ে নিয়েছেন দলকে। যেখানে তুলির শেষ আঁচড় দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি ফিরে এসে। যার প্রতিদানও পেয়েছেন, ২০১৫ ব্যালন ডি’অরে নেইমারের জায়গা ছিল মেসি-রোনালদোর পরেই। বিশ্ব ফুটবল যেন ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করল নেইমারের পায়ে।
কিন্তু এই মৌসুমটাই এলোমেলো করে দিল নেইমারের ক্যারিয়ার। জীবনের সবচেয়ে সফল মৌসুম হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এক মৌসুমের সাফল্য চোখ খুলে দিল নেইমারের। তিনিও ভেবে বসলেন, বার্সেলোনায় মেসির ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তাঁর বিকাশ হচ্ছে না। নেইমার চাইলেই অন্য কোনো দলে গিয়ে একই পরিমাণ অর্জন করতে পারবেন, একইভাবে জিততে পারবেন। আস্তে আস্তে এই ধ্যানধারণা গড়ে উঠল তাঁর মনে। এই ধারণার শেষ পেরেক ছিল পিএসজির বিপক্ষে বিখ্যাত কামব্যাকের দিন। প্রথম লেগে ০-৪ গোলে হারার পর দ্বিতীয় লেগে ৬-১ গোলের অবিস্মরণীয় এক জয় পায় বার্সা। সেদিন শেষ ১০ মিনিটে বার্সার করা ৩ গোলের তিনটিতেই সরাসরি অবদান ছিল নেইমারের। প্রথম দুটি গোল নিজে করেছেন, আর সার্জি রোবার্তোর করা ঐতিহাসিক গোলের পাসটিও ছিল তাঁর বানানো। বার্সেলোনার ঐতিহাসিক সেই জয়ের কান্ডারি ছিলেন নেইমারই। অথচ ম্যাচ শেষে তাঁর দেখা মিলেছে শেষ সারিতে। সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন এক লিওনেল মেসি। মেসির মতো মহিরুহ থাকতে তাঁর দিকে কেউ নজর দেবে, সে সুযোগ কোথায়?
তাই তো মৌসুম শেষে নেইমার প্রথম যে ট্রেন পেলেন, তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নেইমারকে বিক্রি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না বার্সেলোনার। যে কারণেই কিনা ২২২ মিলিয়ন ইউরোর রিলিজ ক্লজ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর মাথায়। তাঁকে কিনতে ব্যাংক ভাঙতে হতো যে কারও। সে সময় চাইলেও এত টাকা খরচ করে নেইমারকে দলে ভেড়ানোর মতো কেউ ছিল না। ছিলেন শুধু একজন, পিএসজি প্রেসিডেন্ট নাসের আর খেলাইফি। পিএসজির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেদার টাকা উড়িয়েছেন তিনি। লিগে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করেছেন। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন, সেই ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেননি তিনি।
আর ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কী দরকার? ইউরোপ কাঁপানো সুপারস্টার। গত মৌসুমে যাঁর কারণে ভাটা পড়েছিল ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে, ব্যাংক ভেঙে তাঁকেই কেনার প্রতিজ্ঞা করলেন খেলাইফি। শুরুতে অসম্ভবই লেগেছিল। সর্বোচ্চ ট্রান্সফার যেখানে মাত্র ১০৫ মিলিয়ন, সেখানে ২২২ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নেইমারকে ভেড়ানোর পাগলামি করবে পিএসজি? আর নেইমারও কেন তাঁর প্রিয় বন্ধুবান্ধব ছেড়ে পিএসজিতে যাবেন? নেইমারের বার্সায় থাকা নিয়ে পিকে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট পর্যন্ত করেছিলেন, ‘সে কুয়েদা’। নেইমার থাকছেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরদিনই ঘোষণা আসে, রিলিজ ক্লজ জমা দিয়েছে পিএসজি। নেইমারের পিএসজি যোগদান সময়ের ব্যাপার মাত্র।
নেইমারের দলবদল ছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের জন্য অশনিসংকেত। এত দিন পর্যন্ত দলবদলের বাজারে যে অর্থনৈতিক-স্থিতিশীলতা ছিল, তা ভেঙে চুরমার করে দেয় পিএসজি। ক্লাবগুলোও নিজেদের খেলোয়াড়ের জন্য বিশাল অঙ্ক দাবি করতে থাকে, বাধ্য হয়ে সে দামেই কিনতে হয় খেলোয়াড়দের। নেইমারের দলবদল দিয়ে শুরু হওয়া আগুন এখনো দাউদাউ করে জ্বলছে ইউরোপে, যার ভুক্তভোগী হচ্ছে মাঝারি ক্লাবগুলো।
তবে নেইমারের দলবদল শুধু ইউরোপিয়ান ফুটবলকে বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছিল তার ক্যারিয়ারের গ্রাফও। পিএসজিতে নেইমার ছিলেন সর্বেসর্বা। যা চাইতেন, তাই পেতেন। ছুটি, ট্রেনিংয়ে ফাঁকি দেওয়া, ঘুরতে চলে যাওয়া; পিএসজি তার জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। এত সবকিছুর মাঝে দরকারি জিনিসটাই হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর কাছে থেকে; নিয়মানুবর্তিতা। ফ্রেঞ্চ লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে কিছু ছিল না। নেইমারের একমাত্র পরীক্ষা ছিল তাই ইউরোপ। আর সেখানেও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলেন তিনি। বার্সায় থাকতে মেসি-সুয়ারেজের মিলে যে ত্রাস তৈরি করেছিলেন ইউরোপে, তার ছিটেফোঁটাও করতে পারেননি পিএসজিতে। উল্টো কাভানির সঙ্গে পেনাল্টি নিয়ে ঝগড়া করেছেন, সতীর্থদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছেন ড্রেসিংরুমে। এত কিছুর পরও ঠিকই পার পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের উত্থানটা সেখানেই শেষ করে দিয়েছেন তিনি। এত দিন যে লাইমলাইটের খোঁজ করছিলেন তিনি, সেই লাইমলাইটই কাল হয়ে দাঁড়াল নেইমারের জন্য। ইউরোপিয়ান ব্যর্থতার ভাগীদার একজনই, নেইমার।
পরের মৌসুমে যোগ দেন এমবাপ্পে। যে লাইমলাইটের আশায় পিএসজিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেটাও ভাগাভাগি হয়ে গেল এমবাপ্পের সঙ্গে। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই নেইমার হাঁটতে শুরু করলেন তার পূর্বসূরিদের পথে। প্রকাণ্ড অবকাশ, নারী আর চোট—এই তিন মিলেই যেন তাঁর ক্যারিয়ার। এরপর যতটা সময় পাওয়া যায়, তাতে ফুটবল। ভাগ্যিস সহজাত প্রতিভা ছিল বৈকি, নইলে অনেক আগেই হারিয়ে যেতেন ফুটবলের ইতিহাস থেকে। এমবাপ্পের আগমনের পর থেকে নেইমার পিএসজিতে ছিলেন নিজের ছায়া হয়েই। কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে এমবাপ্পের ছায়ার নিচে। করোনা আক্রান্ত ২০২০ মৌসুমে সে ছায়া থেকে বেরিয়ে একটা কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন বটে। পিএসজিকে নিয়ে ইউরোপিয়ান সাফল্যের বড্ড কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আটকে গেলেন বায়ার্নের কাছে। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার অনেক কাছে গিয়েও জেতা হয়নি তাঁর।
অন্যদিকে ব্রাজিলের জার্সিতে নেইমার অবশ্য বরাবরই উজ্জ্বল। সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙেছেন বটে, কিন্তু বড় টুর্নামেন্ট এলেই কেমন যেন মিইয়ে যান তিনি। কারণটা ঘুরেফিরে একই। নিয়মিত বড় ম্যাচ খেলার অনভিজ্ঞতা হাড়ে হাড়ে টের পান। এক অলিম্পিক ফাইনাল বাদে কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে টেনে আনার ক্ষমতা অনেকটাই লোপ পেয়েছে তাঁর। তাই তো ব্রাজিলের জার্সিতে তার একমাত্র শিরোপা ১০ বছর আগে, যখন সান্তোসের হয়ে মাঠ মাতাতেন তিনি। সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ফিফা কনফেডারেশনস কাপ।
পরিসংখ্যান দেখে কারও বলার সাধ্য নেই, খারাপ খেলেছেন নেইমার। মাঠের নেইমার বরাবরই দুর্দান্ত। সমস্যাটা হলো গত ছয়-সাত বছর ধরে মাঠের নেইমার আটকে আছেন এক জায়গাতেই। না খেলার ধরনে, না মানসিকতায়, কোনো দিক দিয়েই উন্নতি হয়নি তাঁর। আটকে আছেন বললেও ভুল হবে; বরং কিছু কিছু দিকে আরও অবনতি হয়েছে, নিজের তৈরি করা মান থেকেও অনেকখানি নিচে নেমে গিয়েছিলেন।
অথচ এই নেইমারকে দেখেই ফুটবলের প্রেমে পড়েছিল কোটি ব্রাজিল ভক্ত। ১৯ বছর বয়সে ব্রাজিলের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল যাঁর কাঁধে। সেই নেইমার আর আজকের নেইমারের মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। গত ১৩ বছর নেইমারের গ্রাফটা যেভাবে উঠেছিল, ঠিক সেভাবেই পতিত হয়েছে। সান্তোস, বার্সার নেইমারের সঙ্গে পিএসজির নেইমারকে মেলানো দায়। খেলার স্টাইল থেকে লাইফস্টাইল, যত দিন গড়িয়েছে, ততই পথভ্রষ্ট হয়েছেন তিনি। ইউরোপের ত্রাস নেইমারকে এখন মাঠে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।
ক্যারিয়ারের বসন্ত শেষে নেইমার পা দিয়েছেন ৩১-এ। ইউরোপিয়ান ক্যারিয়ারের সূর্যটাও অস্তমিত হয়েছে দিন কয়েক আগে। পিএসজি ছেড়ে নেইমার যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের আল হিলালে। রোনালদো, বেনজেমা, কান্তে থেকে শুরু করে ফিরমিনো—সৌদি ট্রেনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অনেকেই। কিন্তু প্রত্যেকেই আছেন তাঁদের ক্যারিয়ারের শেষবেলায়। ইউরোপে নেইমারের দেওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল, তার কিছুই পূরণ করতে পারেননি। না পেরেছেন আরেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে, না পেরেছেন ব্যালন ডি’অর অথবা ইউরোপের সেরা খেলোয়াড় হতে। মেসি-রোনালদোর পর যাঁকে ভাবা হয়েছিল বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ, সেই নেইমারও ইউরোপ ছেড়েছেন মেসি-রোনালদোর সঙ্গে হাতে হাত রেখেই। ভঙ্গুর শরীর নিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলের চাপটা হয়তো আর নিতে চাননি। কিন্তু আল হিলালে তার চাওয়া-পাওয়ার তালিকা দেখে যে কেউ বলতে বাধ্য হবে, ফুটবল উপভোগ করতে নয়; বরং টাকা কামাতেই এসেছেন তিনি।
আল হিলালে ১০০ মিলিয়ন ইউরো বেতন পাবেন, সঙ্গে ২৫ কক্ষের প্রাসাদ, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, ১০ জন গৃহকর্মী, ২ জন ড্রাইভার। এমনকি ছুটির দিনগুলোতে যা খরচ হবে, সবটাই বহন করবে আল হিলাল। রাজার হালে থাকা যাকে বলে, সৌদি আরবে সেটাই পাচ্ছেন তিনি। রোনালদো-বেনজেমাও এত সুযোগ–সুবিধা পাননি, যা নেইমার পেতে চলেছেন। এর কতটা অর্জন করেছেন আর জোর করে নিয়েছেন, সে নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু তিনিও যে অর্থের পেছনে ছুটে সুন্দর ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন, তা স্বীকার করতে নিশ্চয় কারও আর বাধবে না।
বার্সেলোনা ছাড়ার প্রাক্বালে নেইমারকে নিয়ে গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, ‘বার্সেলোনা থেকে শুধু একটা দিকেই যাওয়ার উপায় আছে, অধঃপতনে।’ ক্যারিয়ারের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই কথার প্রমাণ দিয়েছেন নেইমার। ইউরোপের সেরা লিগ ছেড়ে যোগ দিয়েছেন সেরা পাঁচের বাইরের লিগে। কাগজে-কলমে পাঁচবার লিগ জিতেছেন বটে, কিন্তু ‘ওয়ান ক্লাব লিগ’-এ সেটার মূল্য যৎসামান্যই। সময়মতো পিএসজি ছাড়লে বড় দলে যোগ দেওয়ার একটা সুযোগও ছিল। কিন্তু না, ইউরোপিয়ান ফুটবলের জৌলুশকে পাশ কাটিয়ে নেইমার বেছে নিলেন অর্থ, পাড়ি দিলেন সৌদিতে। ক্যারিয়ায়ের সেরা সময়ে শীর্ষ লিগ ছেড়ে, জৌলুশ ছেড়ে এতটা নিচে চলে যাবেন, এমনটা হয়তো তাঁর নিন্দুকও ভাবেনি।
তবে নেইমারের সামনে সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সৌদি লিগ যেভাবে নিজেদের শিখরে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে সেখানে গিয়েও সেরা ফুটবলারদের সঙ্গেই থাকবেন তিনি, কিন্তু ইউরোপিয়ান ফুটবলের যে জৌলুশ, আমেজ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর চাপ, তা আর কখনোই দেখা হবে না নেইমারের। ইতিহাসের পাতায় নেইমারের নাম লেখা থাকবে অনেক দিন, নেইমার হয়ে থাকবেন ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র ‘প্রিন্স’, যিনি কখনো রাজা হতে পারেননি।