রোনালদো, বেনজেমা থেকে কান্তে—সবাই হঠাৎ সৌদিতে যাচ্ছেন কেন?
বিশ্বকাপের ঠিক এক দিন আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে বরখাস্ত হন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিহীন অবস্থাতেই বিশ্বকাপে পাড়ি দেন তিনি। তারপর কাতার বিশ্বকাপের ব্যর্থতা এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ—সব মিলিয়ে রোনালদোর চারপাশ হয়ে উঠেছিল বিষাদময়। এর মধ্যেই এল এক উড়ো খবর, সৌদি আরবে ভিড়ছেন রোনালদো। বাকি আর দশটা গুজবের মতো এই গুজবকেও হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যেদিন সৌদি আরবের ফ্লাইট ধরলেন রোনালদো, ফুটবল–বোদ্ধা থেকে শুরু করে সমর্থক—সবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
বয়সের ছাপ বেশ অনেক দিন ধরেই পড়েছিল রোনালদোর পায়ে। আগের মতো পুরো মাঠে আধিপত্য নেই, জালের সামনেও অনেকটাই নেতিয়ে গিয়েছেন। ৩৮-এ পা দিতে যাওয়া শরীর আর পারিবারিক জটিলতা—সবটা মিলিয়ে রোনালদোর ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। তবে সবাই ভেবেছিলেন, ইউরোপিয়ান কোনো দল না পেলে হয়তো আমেরিকায় পাড়ি জমাবেন তিনি। হলিউডের পাশে ছয় মাস ফুটবল আর অফুরন্ত টাকা—আর কী লাগে? কিন্তু সবাইকে অবাক করে রোনালদো পাড়ি জমালেন অজানা, অচেনা এক সৌদি ক্লাব ‘আল নাসর’-এ।
এর ঠিক ছয় মাস পর আল নাসর, আল হিলাল, আল ইতিহাদ কিংবা আল আহলি নামগুলো আর ফুটবল সমর্থকদের কাছে অপরিচিত রইল না। প্রতিদিনের নিউজ ফিডে নামগুলো দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গিয়েছে সবার। চোখের সামনে নামগুলো এলেই দর্শকেরা যেন আতঙ্কে ভোগেন, এই বুঝি তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়কে টেনে নিল সৌদি ক্লাবগুলো। কখন কাকে কোন দিক দিয়ে ডেকে বসে সৌদি ক্লাবগুলো, অনুমানই করা যাচ্ছে না যেন। হঠাৎ করেই কোত্থেকে টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হলো সৌদি ক্লাবগুলো? আর কেনই–বা সবাই ছুটছেন সেদিকে।
কেন ছুটছেন সবাই?
বিশাল ভূমিকা দিয়ে শুরু করা এই প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে দিয়ে দেওয়া সম্ভব—টাকা! ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে থাকা খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করতে টাকার থেকে বড় অনুপ্রেরণা কীই–বা হতে পারে। রোনালদো, বেনজেমার বেতনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। প্রতি মৌসুমে ২০০ মিলিয়ন ইউরো পাবেন রোনালদো, বেনজেমা পাবেন ১২০ মিলিয়ন। লিওনেল মেসিও যদি ভিড়তেন সৌদি আরবে, তবে বছর শেষে তাঁর পকেটেও শোভা পেত ২৫০ মিলিয়ন ইউরোর চেক। অথচ ইউরোপে থাকতে রোনালদো, বেনজেমা আর মেসির বেতন ছিল যথাক্রমে ৩০, ১৫ ও ৪৫ মিলিয়ন ইউরো। ইউরোপে শেষ পাঁচ বছরে যা কামিয়েছেন, তার দ্বিগুণ অর্থ সৌদি লিগে। তা-ও মাত্র এক বছরেই। এমন প্রস্তাব সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কার?
এ তো গেল বড় বড় তারকাদের কথা, পাদপ্রদীপের তুলনামূলক বাইরে থাকা তারকাদেরও বিশাল অঙ্কের বেতন দিচ্ছে সৌদি ক্লাবগুলো। যে কারণে ক্যারিয়ারের সান্নিধ্যে না গিয়েও রুবেন নেভেস পাড়ি জমিয়েছেন সৌদিতে। এমনকি উইলফ্রেড জাহা, বার্নাদো সিলভার মতো খেলোয়াড়ও দ্বিতীয়বার ভাবছেন তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে। আশার বিষয় হচ্ছে, সৌদি লিগে টাকার বস্তা নিয়ে শুধু একটি দল বসেনি, বরং যুদ্ধে নেমেছে চারটি আলাদা আলাদা দল। এর ফলে সৌদি লিগে যে ফ্রেঞ্চ কিংবা জার্মান লিগের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাবে না, তা খালি চোখেই বলে দেওয়া সম্ভব। আর সে কারণেই কিনা তরুণ খেলোয়াড়েরাও নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুবার ভাবছেন।
এত টাকা আসছে কোত্থেকে?
এক বছর আগে সৌদি লিগ চেনা দূরেথাক, নিয়মিত ফুটবল দেখা দর্শকের কাছে ক্লাবের নামগুলোও ছিল অপরিচিত। হুট করেই যেন সোনাভর্তি কলসি পেয়েছে ক্লাবগুলো। ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া ক্লাবগুলোর যেন থামাথামির নাম নেই।
ফুটবলের পেছনে বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচের সুযোগ করে দিয়েছে সৌদি সরকার। সৌদি লিগের শীর্ষ চার দল, আল ইতিহাদ, আল নাসর, আল আহলি ও আল হিলাল—চারটি ক্লাবেরই মালিক সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্ট ফান্ড বা পিআইএফ। নিয়মিত ফুটবল দেখে থাকলে নামটা পরিচিতই ঠেকবে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি ইংলিশ ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে কিনে নিয়েছিল ‘পিআইএফ’। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে নিউক্যাসলের জয়রথ। আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলারও সুযোগ পাচ্ছে তারা।
এককথায় বলতে গেলে নিজেদের টাকাই নিজেরা খরচ করছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের আয়ের প্রধান উৎস তেল ও পর্যটন। সেই টাকা এত দিন নিজেদের উন্নয়নের পেছনে ব্যয় করলেও এখন তার সিংহভাগই যাচ্ছে ফুটবলের পেছনে।
এত খরচের উদ্দেশ্য কী?
সৌদি আরবের মূল লক্ষ্য ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজন করা। সৌদি যুবরাজের ইচ্ছা, বিশ্বকাপকে আবারও মধ্যপ্রাচ্যে ফেরানো। আর সেটা বিশ্বকাপের ১০০ বছর পূর্তিতেই। এই তো কিছুদিন আগেই সব আলোচনা–সমালোচনা পেছনে ফেলে অসাধারণ এক বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছে কাতার। গ্রুপ পর্বে বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সৌদি আরব। আর সেখান থেকেই বিশ্বমঞ্চে নতুন করে নিজেদের পরিচয় করানোর বুদ্ধি খেলে সৌদি যুবরাজের মাথায়। তখন থেকেই শুরু হয় ফুটবলের পেছনে টাকা ঢালা।
হুট করেই রোনালদো, বেনজেমাদের পেছনে এত এত টাকা খরচ করার উদ্দেশ্য একটাই। ফুটবল–বিশ্বের সামনে নিজেদের একটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করা। রাজনৈতিক ইস্যুতে সৌদি আরব অনেক দিন ধরেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে আছে। এমন অবস্থায় বিশ্বকাপ আয়োজন করার জনমত তাদের পক্ষে যাবে না বলেই ধারণা অনেকের। আর জনমতকে পক্ষে আনতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে কী? জনগণকে মুগ্ধ রাখা। সৌদি এখন সে পথেই হাঁটছে।
শুধু দেশ নয়, তাদের লক্ষ্য পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করা। সে জন্য শুধু নামীদামি তারকা নয়, কোচদেরও আকৃষ্ট করা শুরু করেছে তারা। নুনো সান্তোস তো আছেনই, হোসে মোরিনহো, লুইস এনরিকে থেকে শুরু করে জিনেদিন জিদানকে কোচ হিসেবে আনার পূর্ণাঙ্গ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বলতে গেলে ইউরোপিয়ান ফুটবল থেকে দূরে নিজেদের একটা আলাদা সাম্রাজ্য তৈরির চেষ্টা সৌদির। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সৌদি লিগ বিশ্বের সেরা পাঁচ লিগের মধ্যে নাম লেখাবে। লেখাবে নাই–বা কেন? আমাদের দেশের কথাই ভেবে দেখো। স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ লিগ দেখতে যে পরিমাণ বেগ পোহাতে হয়, সেখানে টিভি খুললেই দেখা মিলছে সৌদি লিগের। যে লক্ষ্য নিয়ে তাদের সূচনা, গত ছয় মাসে তার অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছে তারা।
কিন্তু…
তবুও একটা কিন্তু তো থেকে যায়ই। কয়েক বছর আগে একই ফরম্যাটে নিজেদের লিগ গড়তে চেয়েছিল চীন। অস্কার, পাউলিনহো, লাভেজ্জি, কারাস্কোর মতো বড় বড় নাম নিজেদের সেরা সময়ে ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন চীনে। লক্ষ্য ছিল নিজেদের লিগকে উন্নত করে এরপর নিজেদের দলের দিকে তাকানো। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই সফল হয়নি। বরং ব্যর্থ প্রজেক্টে ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়ায় একপ্রকার মুখ থুবড়ে পড়েছে চায়নিজ লিগ।
তবে সৌদি আরবের পরিকল্পনা আরও বিশাল, বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি তাদের। সে লক্ষ্যে শুরু করে অনেকটা সফলতার মুখও দেখেছে তারা। এখন দরকার শুধু লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ ঠিক রাখা। নইলে স্বপ্নের দল গড়া কিংবা বিশ্বকাপ আয়োজন—স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।