হুট করেই যেন সব হয়ে গেল। চেলসি সমর্থকদের নাড়িছেঁড়া ধন ছিলেন ম্যাসন মাউন্ট। সেই ছোট্টবেলা থেকেই লন্ডনের নীল জার্সি তাঁর বড্ড আপন। চেলসি অ্যাকাডেমির প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে চেলসির মাঝমাঠের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিলেন চেলসি সমর্থকেরা। মুহূর্তের খেয়ালে সেই মাউন্ট এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
ভেতরে-ভেতরে জল গড়িয়েছিল অনেক দূর। নতুন মালিক আসার পর থেকেই সময়টা ভালো যাচ্ছে না চেলসির। দলের ভেতরে-বাইরে গুমোট পরিস্থিতি। দলের পুরোনো তারকারাও বিরক্ত। নিত্যনতুন খেলোয়াড়দের আগমন, বিদায়ের মিছিলে দলের অবস্থা শোচনীয়। গত এক মৌসুম ধরেই বেতন নিয়ে ম্যাসন মাউন্টের সঙ্গে মনোমালিন্য চেলসি মালিক টড বোহেলির। নিজেদের তারকাকে এত বেতন দিতে রাজি নন তিনি। তাই অনেকটা রাগের বসেই দলবদলের অনুরোধ করেছিলেন মাউন্ট। সাম্প্রতিক ফর্মও কিছুটা পড়তির দিকে। সুযোগটা লুফে নিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ম্যাসন মাউন্টের নতুন ঠিকানা এখন ওল্ড ট্রাফোর্ড।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ এরিক টেন হাগের ইচ্ছাতেই ম্যাসন মাউন্টকে কেনা। ধরে নেওয়া যায়, আগামী মৌসুমে মাঝমাঠের সবচেয়ে বড় ভূমিকায় আবির্ভূত হবেন মাউন্ট। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় সবাইকে অবাক করে দিল রেড ডেভিলরা। ম্যাসনের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে ইউনাইটেডের আইকনিক ‘৭’ নম্বর জার্সি। রোনালদো চলে যাওয়ার পর খালিই ছিল ‘৭’ নম্বর জার্সিটা। ধরে নেওয়া হয়েছিল নতুন মৌসুমে আর্জেন্টাইন তরুণ তুর্কি আলেসান্দ্রো গারনাচোর গায়ে শোভা পাবে এই জার্সি। কিন্তু মত বদলে নতুন খেলোয়াড়ের কাঁধেই জার্সির ভার তুলে দিল ইউনাইটেড।
বেকহ্যাম, রোনালদো থেকে শুরু করে ভ্যালেন্সিয়া, মেমফিস ডিপাই- ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন অনেকেই। কেউ নিজেকে চিনিয়েছেন, কেউ আবার হারিয়ে গিয়েছেন অতল গহিনে। এমনিতেই ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডের চাপ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘৭’ নম্বর জার্সি। ২০০৯ সালে রোনালদোর প্রথমবারের বিদায়ের পর থেকেই চলছে ‘৭’ নম্বরের দুর্দশা। সেই দুর্দশা মেটাতে পারবেন মাউন্ট? চলো দেখে নিই কারা ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নাম্বার সেভেন।
এরিক ক্যান্টোনা
প্রিমিয়ার লিগের সূচনা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউনাইটেডের আইকনিক ‘৭’ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন মাত্র ১০ জন খেলোয়াড়। শুরুটা হয়েছিল ফরাসি কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনাকে দিয়ে। ফুটবল মাঠে ক্যান্টোনা ছিলেন অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব। তিনি মাঠে থাকবেন আর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইবে না, এমনটা অসম্ভব। কখনো সতীর্থের ওপর চড়াও হওয়া, কখনো আবার সমর্থকদের বুকে লাথি বসিয়ে দেওয়া, কখনো রাগের মাথায় প্রতিপক্ষের ক্যারিয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়া—সবটাই আছে তাঁর রেকর্ডবুকে। এত কিছুর মাঝেও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের স্নেহ পেয়েছিলেন ক্যান্টোনা। কারণ, মাঠে ক্যান্টোনা শুধু বদমেজাজি নন, বরং প্রচণ্ড প্রতিভাবান একজন খেলোয়াড়ও বটে। ‘৭’ নম্বর জার্সিতে ৪ মৌসুম ছিলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে, তাতেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য একপর্যায়ে। ১৮০ ম্যাচে করেছেন ৮০ গোল। ইউনাইটেড ইতিহাসের অন্যতম সফল খেলোয়াড়ও তিনি। ১৯৯৭ সালে ক্যারিয়ারের শীর্ষে থাকা অবস্থাতেই মাত্র ৩১ বছর বয়সে অবসরের ঘোষণা দেন ক্যান্টোনা।
ডেভিড বেকহ্যাম
ক্যান্টোনার বিদায়ের পর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন রেড ডেভিলদের আইকনিক ‘৭’ নম্বর জার্সি তুলে দেন ডেভিড বেকহ্যামের গায়ে। বেকহ্যাম তত দিনে ইউনাইটেডে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। সমর্থকদের আস্থা, ভরসা, বিশ্বাস; সবটাই তখন তার কাঁধে। কিন্তু ‘৭’ নম্বরের ভারেই কিনা হ-য-ব-র-ল ঘটিয়ে ফেললেন তাঁর ক্যারিয়ারে। এক বছরের মাথাতেই বেকহ্যাম হয়ে উঠলেন চোখের বালি, ইংল্যান্ডের ‘ভিলেন নম্বর ওয়ান’।
কিন্তু নামটা তো ডেভিড বেকহ্যাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চোখের বালি থেকে চোখের মণি হয়ে উঠলেন তিনি। ইউনাইটেডকে উপহার দিলেন ট্রেবল, হয়ে উঠলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ত্রাণকর্তা। ‘৭’ নম্বর জার্সিতে ৬ মৌসুম কাটিয়েছেন বেকহ্যাম, ৬৪ গোল করে স্মরণীয় করে রেখেছেন নিজের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্যারিয়ার। ২০০৩ সালে স্যার অ্যালেক্সের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় রিয়াল মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে ইউনাইটেড ছাড়েন বেকহ্যাম।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
‘৭’ নম্বর জার্সির যোগ্য উত্তরসূরির জন্য স্যার অ্যালেক্স পাড়ি জমান পর্তুগালে। ক্যান্টোনা কিংবা বেকহ্যাম, ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বর জার্সি গায়ে চড়ার আগেই সমর্থকদের চোখের মণি ছিলেন তাঁরা। আইকনিক ‘৭’ গায়ে জড়ানোর আগেই তাঁদের নাড়ি-নক্ষত্র জানা ছিল সমর্থকদের। কিন্তু তৃতীয়বার এসে উল্টো পথে হাঁটলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। পর্তুগালের আনকোরা অজানা-অচেনা এক ছেলেকে তুলে নিয়ে এলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। হ্যাংলা-পাতলা খেলোয়াড়ের সেরা অর্জন কী? নেভিল, ফার্দিনান্ডকে এক প্রীতি ম্যাচে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। জহুরির চোখে হিরে চিনতে এটুকুই যথেষ্ট ছিল। হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটার নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
ছয় মৌসুম পর যখন গুঞ্জন উঠল ইউনাইটেড ছাড়ছেন রোনালদো, তত দিনে রোনালদো পৌঁছে গেছেন অন্য উচ্চতায়। জিতেছেন ব্যালন ডি’অর, হাতে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার আর পরিচয়—সিআরসেভেন। ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বর জার্সি তাঁর মতো আপন করে নিতে পারেননি কেউই। আর তাই বলেই হয়তো এর পর থেকেই শুরু হলো ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বরের অভিশাপ।
মাইকেল ওয়েন
রোনালদোর বদলি হিসেবে রেড ডেভিলের ‘৭’ নম্বর জার্সি গায়ে জড়ান ব্যালন ডি’অরজয়ী ফুটবলার মাইকেল ওয়েন। এমনিতেই তাঁর দলবদল নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। ‘৭’ নম্বরের ভার নিতে পারেননি তিনি। ৩০ বছর বয়সী স্ট্রাইকার তিন মৌসুমে গোল করতে পেরেছিলেন মাত্র ১৭টি।
অ্যান্থনি ভ্যালেন্সিয়া
ওয়েনের পর ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বর জার্সি ছিল মিউজিক্যাল চেয়ার, একের পর এক খেলোয়াড় গায়ে জড়িয়েছেন, কিন্তু নিজের নাম উজ্জ্বল করতে পারেননি। ওয়েনের পর ‘৭’ নম্বর জার্সি পেয়েছিলেন উইঙ্গার অ্যান্থনি ভ্যালেন্সিয়া। তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে মৌসুম ছিল সেটা ৪০ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ১ গোল। মৌসুম শেষে জার্সি নম্বর বদলানোর আবেদন করেন তিনি। জার্সি বদলাতেই আবারও ফর্মে ফেরেন ভ্যালেন্সিয়া।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া
ভ্যালেন্সিয়ার বদলি হিসেবে আসেন ডি মারিয়া। দলবদলের মৌসুমের একদম শেষ দিকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাঁকে দলে ভেড়ায় ইউনাইটেড। আর্জেন্টাইন তারকার সূচনাটা ভালোই ছিল। কিন্তু কোচ লুই ফন হালের সঙ্গে মনোমালিন্যতে এক মৌসুমই ছিলেন ‘৭’ নম্বর জার্সিতে। করতে পেরেছিলেন ৪ গোল।
মেম্ফিস ডিপাই
মারিয়ার রেখে যাওয়া ‘৭’ তুলে নেন ডাচ তরুণ মেম্ফিস ডিপাই। এই জার্সির জন্য বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন ডিপাই। কিন্তু ২১ বছর বয়সী তারকা তাঁর প্রতিভার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি ম্যানচেস্টারে। আড়াই বছরের ক্যারিয়ারে গোল করেছেন মাত্র ৭টি!
অ্যালেক্সিস সানচেজ
পুরো এক বছর ফাঁকা থাকার পর ইউনাইটেডের ‘৭’ নম্বর জার্সির ভার তুলে দেওয়া হয় অ্যালেক্সিস সানচেজের কাঁধে। ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করেই তাঁকে কিনে আনে ইউনাইটেড। ছয় মাস পর যাঁকে ফ্রিতে পাওয়া যেত, সেই খেলোয়াড়কে ৪০ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভেড়ায় রেড ডেভিলরা। আর্সেনালে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা খেলোয়াড়কে দিয়েই নিজেদের দুঃসময় ঘুচে যাবে, এমন আশাই ছিল সবার। পিয়ানোর সুরে সুরে সানচেজকে আমন্ত্রণ জানালেও ইউনাইটেডে তাঁর সময়টা ছিল বেদনার সুরে বিহ্বল। দুই মৌসুমে ৪৫ ম্যাচ খেলে তাঁর গোলসংখ্যা ছিল মাত্র ৫!
এডিনসন কাভানি
আবারও এক মৌসুম খালি থাকার পর ২০২০ সালে আবারও মাঠে দেখা মেলে ইউনাইটেডের নতুন ‘৭’। এবার এই জার্সির মালিক হন উরুগুয়ের তারকা এডিনসন কাভানি। তাঁর হাত ধরেই দুর্দশা কাটতে শুরু করে আইকনিক ‘৭’ নম্বর জার্সির। এক মৌসুমই ছিলেন এই জার্সিতে। ৪০ ম্যাচে করেছিলেন ১৭ গোল। এক মৌসুম পরেই আবারও হাতবদল হয় জার্সির।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
১১ বছর আগে যে জার্সি রেখে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতের তারকাদের জন্য, সেই জার্সিতেই আবারও ফিরলেন রোনালদো। তবে তাঁর ফিরে আসাটা তেমন রঙিন হয়নি। ওল্ড ট্রাফোর্ডে যেন রোনালদো ফেরেননি, ফিরেছিল তাঁর ছায়া। তবে ‘৭’ নম্বর জার্সির অপমান করেননি তিনি। দেড় মৌসুমে ৫৪ ম্যাচে ২৭ গোল করেন সিআরসেভেন। গত ১১ বছরে এই পারফরম্যান্সের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেননি কেউ। কিন্তু নামটা রোনালদো বলেই হয়তো ফিকে লাগছে সবটা। বিদায়টাও হয়েছে মাঝপথে, অনানুষ্ঠানিকভাবে।
ম্যাসন মাউন্ট
অনেক জল্পনাকল্পনা শেষে ইউনাইটেডের আইকনিক ‘৭’ নম্বর জার্সির মালিক এখন ম্যাসন মাউন্ট। বেকহ্যাম, ওয়েনের পর তৃতীয় ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে তুলে নিয়েছেন ঐতিহাসিক এই জার্সির ভার। মাউন্টের আগের সবাই ছিলেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। হয় স্ট্রাইকার, নয়তো উইঙ্গার। গোল করাটাই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। মাউন্ট সেদিক থেকে অনেকটাই আলাদা। পুরোদস্তুর মাঝমাঠের খেলোয়াড় মাউন্টের জন্য লড়াইটা তাই অন্য সবার থেকে অনেক আলাদা। কঠিনও বটে। সময়ই বলে দেবে, এই লড়াইয়ে ঠিক কতটা সফল হতে পারেন তিনি।