২ ম্যাচেই ব্যালন ডি’অরের স্বপ্ন শেষ সালাহর
ফুটবল বড্ড অনিশ্চিত একটা খেলা। এখানে এক মিনিট তো দূরের কথা, প্রতি সেকেন্ডে লেপ্টে থাকে অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চ। মাসের পর মাস ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা স্বপ্ন চুরমার হতে প্রয়োজন মাত্র একটা মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক বিরতির ডামাডোলে সেই অনুভূতি যেন কুরে খাচ্ছে মোহাম্মদ সালাহকে। এ যেন ডানাভাঙা পাখির মতো উড়তে উড়তে হঠাৎই মাটিতে গুটিয়ে পড়া।
অল রেডরা এতটা উড়বে, সেটা হয়তো খোদ সমর্থকদেরও ভাবনায় ছিল না। লিভারপুলের মৌসুম শুরু হয়েছিল একগুচ্ছ ভাঙা স্বপ্ন নিয়ে। ৯ বছর ধরে তিলে তিলে গড়া দলটাকে এক ভিডিও বার্তায় বিদায় বলেছেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তাঁর পরিবর্তে দলে যোগ দিলেন এমন একজন, যাঁর কোচিং ক্যারিয়ার মাত্র আট বছরের। ফেইনুর্দ থেকে আসা আর্নে স্লট যেন বন্দী হয়ে ছিলেন নিজের মধ্যে। হেভিওয়েট কোচদের মধ্যে স্লট বড্ড বেমানন। কিপটে মালিকপক্ষের কাছ থেকে খোদ ক্লপই পয়সা বের করতে পারতেন না, সেখানে স্লট তো দলে যোগ দিয়েছেন মাত্র। দলে ছিল না কোনো নতুন মুখ, ক্লপের রেখে যাওয়া লিভারপুলকে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নতুন শুরুর।
নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সালাহও। ইউরোপ-আমেরিকার খেলোয়াড়েরা যখন ইউরো-কোপার ডামাডোলে ব্যস্ত, সালাহ আবিষ্কার করেছেন নিজেকে নতুন রূপে। নিজের আইকনিক ঝাঁকড়া চুল ঝেড়ে ফেলেছেন, তাঁকে দেখে মনে হয়েছে মা–বাবার একান্ত বাধ্যগত সন্তান। কাগজে-কলমে লিভারপুলে শেষ বছর। ৩০ বছরের আক্ষেপ দূর করেছেন, জিতিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগ। ১৪ বছরের অপেক্ষা শেষে ঘরে ফিরেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। একটা দলকে ঠিক যা যা দেওয়া সম্ভব, মোহাম্মদ সালাহ তার সবই নিংড়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন শহরভর্তি সমর্থকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, হয়েছেন বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন। তবু কোথায় যেন একটা আক্ষেপ বাসা বেঁধে ছিল মনে। বিশ্বসেরার তকমা তাঁর নামের পাশে শোভা পায় বটে, কিন্তু শিরোপাটা তাঁর বরাবরই অধরা।
চোখের সামনে দিয়ে ব্যালন ডি’অর বাগিয়ে নিয়েছেন করিম বেনজেমা, লুকা মদরিচ। তিনি থেকে গিয়েছেন ব্রাত্য। গত মৌসুমে তো শীর্ষ ৩০-এও জায়গা হয়নি তাঁর। পারফরম্যান্সে কোনো অংশে খারাপ ছিলেন না। কিন্তু ওই যে ‘স্টার পাওয়ার’, সালাহ বরাবরই আটকে গিয়েছেন সেখানে। এত বছরের ক্যারিয়ারে শীর্ষ তিনে জায়গা করতে পারেননি কখনো। শীর্ষ পাঁচে জায়গা হয়েছে হাতে গুনে দুবার, ২০১৯ আর ২০২২। চ্যাম্পিয়নস লিগের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পুরস্কার ছিল সেটা। ২০১৮ সালে ষষ্ঠ হয়েছিলেন দলকে প্রিমিয়ার লিগ জিতিয়ে। দলকে জিতিয়েছেন, বিশ্বসেরা বানিয়েছেন কিন্তু নিজে বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন সালাহর কাছে আজীবন স্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে।
সালাহ মৌসুমটা শুরু করেছিলেন একেবারে আটঘাট বেঁধে। প্রিমিয়ার লিগে মিস করেননি একটি ম্যাচও। ২৯ ম্যাচের মধ্যে ২৫ ম্যাচেই দেখা পেয়েছেন গোল-অ্যাসিস্টের। যে চার ম্যাচে পাননি, দল হোঁচট খেয়েছে সেখানেই। চার ম্যাচের একটিতে হার, আরেকটিতে ড্র। বাকি দুই ম্যাচেও কষ্টার্জিত দুই জয়। মৌসুম যত গড়াচ্ছিল, আর্নে স্লটের লিভারপুল হয়ে উঠেছিল সালাহর লিভারপুল। ২৯ ম্যাচে ২৭ গোল আর ১৭ অ্যাসিস্ট নিয়ে সালাহ আরোহণ করে আছেন শীর্ষস্থান।
চ্যাম্পিয়নস লিগের লিভারপুল যেন আরও বেশি সালাহনির্ভর। গ্রুপ পর্বের ৭ ম্যাচের ৭টিতে জয়। সব কটিতেই মূল একাদশের অংশ ছিলেন সালাহ। নামের পাশে ছিল ৩ গোল ২ অ্যাসিস্ট। প্রথম স্থান নিশ্চিত ভেবে স্লট বসিয়ে দিলেন এক ম্যাচে, সে ম্যাচটাই কাল হলো। সেই যে লিভারপুল খেই হারাল, আর ফেরা হলো না ফর্মে।
সালাহ যেন এ মৌসুমে নেমেছিলেন সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে। ক্রিসমাসের পর সালাহ ভালো খেলেন না, নতুন বছরের সালাহ খেই হারিয়ে ফেলেন। কয়েক বছর ধরে অনলাইনে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি গুজবকে রীতিমতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন সালাহ। বড়দিনের পরের সালাহ আবির্ভূত হয়েছিলেন আরও ভয়ানকরূপে। কিন্তু এরপরই হানা দিল সেই ভয়ানক সপ্তাহও। একটা সপ্তাহ, দুটো ম্যাচ; লুটপাট হয়ে গেল সালাহর শত স্বপ্ন, শত আশা।
গ্রুপ পর্বের শীর্ষে থাকায় সরাসরি জায়গা করে নিয়েছিল গ্রুপ অফ সিক্সটিনে। প্রতিপক্ষ নকআউট খেলে আসা পিএসজি। প্যারিসে পিএসজিকে ধরাশায়ী করেছিল হেসেখেলে। গোল-অ্যাসিস্ট কিছুই ছিল না, কিন্তু সালাহ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পিএসজির ভিত। ধরেই নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় লেগটা নিজের করে নেবেন। কিন্তু এতটা নিষ্প্রভ সালাহকে দেখা যায়নি পুরো মৌসুমে। পুরো ম্যাচ ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। ম্যাচ যখন গড়াল টাইব্রেকারে, এগিয়ে এলেন সালাহ। শুরুটা করে দিলেন তিনিই। কিন্তু পরের দুই শট থামিয়ে দিলেন জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মা, আট মাস ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন যেন চুরমার হয়ে গেল মুহূর্তেই। পুরো মৌসুমের দুর্দান্ত ফর্ম সালাহ যেন হারিয়ে ফেললেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এসে।
কে জানত, দুঃস্বপ্নের সপ্তাহের শুরু মাত্র। চ্যাম্পিয়নস লিগের ক্ষত অল রেডরা সামাল দিতে চেয়েছিল কারাবাও কাপ দিয়ে। ৭০ বছর ধরে অজেয় নিউক্যাসলকে হারাতে তেমন আর কী করতে হবে? সালাহ এবারও থাকলেন নিজের ছায়া হয়ে। ড্যাং বার্ন আর আলেক্সান্ডার ইসাক ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন শিরোপা। হতাশ সালাহ উদ্যাপন দেখলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরো বছরের সাধনা, পরিশ্রম, স্বপ্ন; চুরমার হয়ে গেল একমুহূর্তের ভুলে। সেখানে যতটা না দোষ নিজের, তাঁর থেকে বেশি সতীর্থদের।
সালাহর নামের পাশে শিরোপার অভাব নেই। ব্যক্তিগত শিরোপা থেকে শুরু করে দলীয়, সব শিরোপাতে হাত রাঙা তাঁর। প্রিমিয়ার লিগের সেরা ফুটবলার হয়েছেন দুবার। গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনবার। পেয়েছেন পুসকাসও। তবু বিশ্বসেরা হওয়ার যে আক্ষেপ, হতাশা কুরে কুরে খেয়েছে তাঁকে প্রতিবার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ মৌসুমই হয়তো ইউরোপিয়ান ফুটবলে সালাহর শেষ মৌসুম। মার্চ পেরিয়ে গেছে, এখনো চুক্তি বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব আসেনি বোর্ড থেকে। মৌসুম শেষে হয়তো ফ্রিতে অন্য দলের জার্সিতে দেখা যাবে তাঁকে। আর পাঁচ ম্যাচ জিতলেই দ্বিতীয়বারের মতো প্রিমিয়ার লিগ জিতবেন। কিন্তু সালাহ নিজেও জানেন, সেরা হতে এটুকু যথেষ্ট নয়। ফুটবল সবাইকে হাত খুলে দেয় না। কেউ কেউ সব দেওয়ার পরও হাত পেতে কিছু পায় না। সালাহ বোধ হয় দ্বিতীয় পক্ষের হয়েই থাকবেন আজীবন।