জি তে গুগল

একবার মার্কিন গণিতবিদ এডওয়ার্ড কাসনার বড় সংখ্যা নিয়ে ভাবছিলেন। হঠাৎ তিনি এমন একটি সংখ্যা লিখলেন, যা কিনা ১-এর পর ১০০টি শূন্য। এই দানবীয় সংখ্যাটি লিখে কাসনার ভাবলেন, এর এমন একটা নাম দেওয়া দরকার, যাতে সহজে মনে রাখা যায়। কিন্তু কী নাম দেওয়া যায়, তা ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলেন না তিনি।

সেই মুহূর্তে তার পাশেই ছিল মিল্টন সিরোট্টা নামের তার নয় বছরের এক ভাতিজা। কাসনার কী মনে করে মিল্টনকে এই বিশাল সংখ্যাটির নাম কী হতে পারে জিজ্ঞেস করলেন। মিল্টন এক মুহূর্ত চিন্তা করে জবাব দিল, গুগল ( Googol)। ব্যস, তাতেই জন্ম নিল গুগল নামের দানবীয় এক সংখ্যা। ঘটনাটি ছিল ১৯২০ সালের। এরপর ১৯৪০ সালে কাসনার গণিতের ওপর লেখা একটি বইতে এই নতুন সংখ্যাটির নাম উল্লেখ করেন। পরবর্তী সময়ে গুগল নামটি জনপ্রিয়তা পায়। সংখ্যাটি দেখতে ঠিক এ রকম: ১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০।

তবে এই সংখ্যাটি দেখে যতই ভয় লাগুক না কেন, একে আরও সহজ করে লেখা সম্ভব। সে জন্য আমরা সূচক ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ ১০-এর ওপর পাওয়ার বা ঘাত হিসেবে ১০০ লিখলেই ঝামেলা চুকে যাবে। মানে এভাবে ১০১০০। এখন নিশ্চয়ই ভয় লাগছে না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গুগল সংখ্যাটি আসলে কত বড়? এর উত্তর হচ্ছে, পুরো পৃথিবীতে যতগুলো বালুকণা আছে (একবার গুনে দেখবে নাকি), তার চেয়েও বড় সংখ্যা গুগল। আবার পৃথিবীতে ঘাসের যত পাতা আছে তার চেয়েও বড় সংখ্যা গুগল। পৃথিবীর সব মানুষের মাথার চুল একসঙ্গে যোগ করার পরও তা গুগলের সমান হবে না। মনে রেখো, পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি। আর একটি মানুষের মাথায় কমসে কম এক লাখ চুল থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। এবার নিজেই হিসাব করে দেখতে পারো পুরো বিশ্বের সব মানুষের মাথার চুলের সংখ্যা কত। পৃথিবীর কথা বাদই দিলাম, এই মহাবিশ্বে যতগুলো কণা আছে তার চেয়েও অনেক বড় সংখ্যা গুগল। জানো হয়তো, মহাবিশ্বে সবগুলো কণার সংখ্যা ১০৮০। আশা করি, গুগল সম্পর্কে এখন একটু একটু বুঝতে পারছ।

তাই বলে ভেবে বোসো না, পৃথিবীতে গুগলই সবচেয়ে বড় সংখ্যা। না, এর চেয়ে বড় সংখ্যাও আছে। তার একটি হচ্ছে সেন্টিলিয়ন। সেন্টিলিয়নের কথা বলার আগে এর চেয়ে ছোট কিছু সংখ্যার কথা বলে নিই। একের পর তিনটি সংখ্যা বসালে হয় এক হাজার (১,০০০), এটা কে না জানে। তেমনি দশ হাজার (১০,০০০), এক লাখ (১০০,০০০), দশ লাখ বা এক মিলিয়ন, এক কোটি (১০,০০০,০০০), এক বিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০) কিংবা এক ট্রিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০,০০০)-এর নিশ্চয়ই তোমাদের অনেকেরই জানা। কিন্তু এক কোয়াড্রিলিয়ন সমান কত? পারছ না তো! একের পিঠে ১৫টি শূন্য বসালে পাওয়া যাবে সংখ্যাটি। অর্থাৎ ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০  বা ১০১৫। আবার একের পিঠে ১৮টি শূন্য বসালে পাওয়া যাবে এক কুইন্টিলিয়ন (১০১৮)। তেমনি একের পিঠে ২১টি শূন্য বসালে এক সেক্সট্রিলিয়ন (১০২১), ২৪টি শূন্য বসালে এক সেপ্টিলিয়ন (১০২৪), ২৭টি শূন্য বসালে এক অকটিলিয়ন (১০২৭), ৩০টি শূন্য বসালে এক ননিলিয়ন (১০৩০), ৩৩টি শূন্য বসালে এক ডেসিলিয়ন (১০৩৩), ৩৬টি শূন্য বসালে এক আনডেসিলিয়ন (১০৩৬), ৩৯টি শূন্য বসালে এক ডুয়োডেসিলিয়ন (১০৩৯), ৪২টি শূন্য বসালে এক ট্রেডিসিলিয়ন (১০৪২), ৪৫টি শূন্য বসালে এক কোয়াটুয়োরডেসিলিয়ন (১০৪৫), ৪৮টি শূন্য বসালে এক কুইনডেসিলিয়ন, ৫১টি শূন্য বসালে এক সেক্সডেসিলিয়ন, ৫৪টি শূন্য বসালে এক সেপ্টেনডেসিলিয়ন, ৫৭টি শূন্য বসালে এক অক্টোডেসিলিয়ন, ৬০টি শূন্য বসালে এক নভেমডেসিলিয়ন, ৬৪টি শূন্য বসালে এক ভিগিনট্রিলিয়ন পাওয়া যাবে। আর একের পিঠে কতটি শূন্য বসালে গুগল পাওয়া যাবে সেটি তো এরই মধ্যে তোমরা জেনেই গেছ। এভাবে একের পর ৩০৩টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে, তাকে বলে এক সেন্টিলিয়ন। সেন্টিলিয়নের আসল চেহারাটা এ রকম: ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০।

সূচক ব্যবহার করে এই ভয়ংকর চেহারাকে কিছুটা সুন্দর করে তোলা সম্ভব। সেই চেহারাটি হবে এ রকম: ১০৩০৩

দাঁড়াও, দাঁড়াও, এখানেই শেষ নয়। এর চেয়েও বড় সংখ্যাটির নামটি আগে জেনে নাও। গুগল আর সেন্টিলিয়নের চেয়ে বড় সংখ্যাটির নাম গুগলপ্লেক্স ( Googolplex)। গুগল তো বুঝেছ, কিন্তু গুগলপ্লেক্স কী! অনেক গণিতবিদ বলেন, ১-এর পিঠে শূন্য বসাতে বসাতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে তখনই পাওয়া যাবে গুগলপ্লেক্স। তবে এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ যারা গণিতকে ভয় পায়, তারা তো অল্প কয়েকটি শূন্য বসিয়েই ক্লান্ত হয়ে যাবে। অপরদিকে আইনস্টাইনের মতো কাউকে যদি পাওয়া যায়, যার গণিতে কোনো ক্লান্তি নেই। তাহলে তো ১-এর পিঠে শূন্য বসানো কখন শেষ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে? অনেক গণিতবিদ বলেন, ১-এর পিঠে এক গুগল শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে সেটিই গুগলপ্লেক্স। তবে অনিবার্য কারণবশত সেই সংখ্যাটি এখানে লেখা যাচ্ছে না। কারণ সংখ্যাটি এতই বড় যে কিশোর আলোর অনেকগুলো পাতা লাগবে সেটি লিখতে। তার চেয়ে সূচক ব্যবহার করে সংখ্যাটির চেহারাটা একবার দেখে নিতে পারো।১০১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভয় লাগছে, তাই না!

তবে আরেকবার সূচক ব্যবহার করে গুগলপ্লেক্সকে সহজভাবে লিখতে পারি আমরা। গুগল হচ্ছে: ১০১০০। গণিতবিদেরা কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা গুগল আর গুগলপ্লেক্সের চেয়েও বড় আরেকটি সংখ্যার প্রস্তাব করেছেন। তার নাম হচ্ছে গুগলপ্লেক্সিয়ান ( Googolplexian)। ১-এর পিঠে এক গুগলপ্লেক্স শূন্য বসালে পাওয়া যাবে এই দানবীয় সংখ্যাটি। গুগলপ্লেক্সিয়ানের চেহারা কেমন হতে পারে সেটা শুধু মনে মনে একবার কল্পনা করে দেখো!

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় বড় সংখ্যা আসলে কী কাজে লাগে? মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব সংখ্যা এখন পর্যন্ত সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে লাগানো যায়নি। তবে অন্য বড় সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করতে উদাহরণ হিসেবে মাঝে মাঝে এই দানবীয় সংখ্যাগুলোকে টেনে আনেন গণিতবিদেরা। ওই যেমন মহাবিশ্বে কণার সংখ্যা কিংবা পৃথিবীতে বালুকণার সংখ্যা, যার কথা আগেই বলেছি।

অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনেকেই গুগল অর্থ না জানলেও গুগলের সঙ্গে এখন সবাই পরিচিত। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সার্গেই বিন আর ল্যারি পেজ যৌথভাবে এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম গুগল ইনকরপোরেট। তবে তারা গণিতবিদ কাসনার প্রস্তাবিত গুগল ( Googol) শব্দটির বানান ভুল করে লিখেছিলেন  Google। বিন আর পেজের লক্ষ্য ছিল, তাঁরা ইন্টারনেটে গুগল সংখ্যক তথ্য নথিভুক্ত করবেন, যাতে সেগুলো সর্বজনীনভাবে সবাই ব্যবহার করতে পারে। সে কারণেই গুগল নামটি বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই বছরই ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। ১৯৯৮ সালে এই সার্চ ইঞ্জিনটি প্রতিদিন ইন্টারনেট থেকে ব্যবহারকারীদের ১০ হাজার পৃষ্ঠা খুঁজে দিতে পারত। এখন গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ক্ষমতা বেড়ে রীতিমতো জায়ান্টে পরিণত হয়েছে। তাই সত্যি সত্যিই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে দানবীয় গুগল নামটি যথার্থ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। আর গুগলের সদর দপ্তরের নাম দেওয়া হয়েছে গুগলপ্লেক্স। এই নামটি সঠিক হয়েছে কি না, সেটি তুমিই বিবেচনা করে দেখো।

(লেখাটি কিশোর আলোর এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)