সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে...

বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধির সূত্র মুখস্থ করতে করতে অনেকে অস্থির হয়ে যায়। কেউ তাদের দেখিয়ে দেয় না, এগুলো আসলে কোনো না কোনো ধরনের সমীভবন। সমীভবন হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে এক ধ্বনির প্রভাবে পাশের ধ্বনিটি বদলে যায়। ব্যাপারটা অনেকখানি সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশের মতো। উদাহরণ দিয়েই দেখানো যাক।

উদাহরণ-১: বিপদ + জনক = বিপজ্জনক

এখানে যোগ চিহ্নের আগের আর পরের ধ্বনিটি লক্ষ করো। ডান পাশে রয়েছে ‘জ’ আর বাঁ পাশে রয়েছে ‘দ’। ডান পাশের ‘জ’ ধ্বনির পাশে থাকতে থাকতে বাঁ পাশের ‘দ’ হয়ে গেছে ‘জ’।

উদাহরণ-২: চলত্ + চিত্র = চলচ্চিত্র

এখানে কী ঘটছে বুঝতে পারছ? ওই যে বললাম, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ! ডান পাশের ‘চ’-এর পাশে থাকতে থাকতে ত্ হয়ে গেল ‘চ’।

এবার আরেকটু কঠিন উদাহরণে যাই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ব্যঞ্জনসন্ধি সবগুলোই সমীভবনের নিয়ম মেনে চলবে। তার আগে ব্যঞ্জনসন্ধির সংজ্ঞাটা একটু মনে করিয়ে দিই। ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা স্বরধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। আগের দুটি উদাহরণে কী সূত্র পাওয়া গেল নিজে বের করতে পারছ? প্রথমটিতে দ্ + জ = জ্জ হয়েছে। আর দ্বিতীয়টিতে ত্ + চ = চ্চ হয়েছে। দুটি উদাহরণেই দেখা যাচ্ছে, ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলন হয়েছে।

উদাহরণ-৩: উত্ + শ্বাস = উচ্ছ্বাস

অনেক সময় দুটি ধ্বনির প্রভাবে দুটি ধ্বনিই বদলে যায়। ওপরের উদাহরণে যোগ চিহ্নের আগে রয়েছে খ্ল-ত এবং যোগ চিহ্নের পরে রয়েছে তালব্য-শ। দুটি ধ্বনিই পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে ‘চ’ এবং ‘ছ’ হয়েছে। এটিও কিন্তু সমীভবন। তার মানে, সমীভবনে অনেক সময় দুটি ধ্বনিই পরস্পরকে পরিবর্তন করতে পারে। অনেকে বলতে পারে ত্ + শ = চ্ + ছ হলো কেন? ত্ + শ = ক্ + খ কিংবা অন্য কিছু হলো না কেন? তাহলে বলি। ‘শ’ হলো তালব্যধ্বনি। তালব্যধ্বনি শ-এর প্রভাবে তালব্যধ্বনি ‘চ’ এবং ‘ছ’ তৈরি হয়েছে।

উদাহরণ-৪: বাক্ + দান = বাগদান

এটা আরেকটু কঠিন উদাহরণ। বাক্ + দান = বাগদান হলো কেন? অর্থাৎ, এখানে ‘ক’ পরিবর্তিত হয়ে ‘গ’ হলো কেন? তাহলে, ‘দ’ কেমন ধ্বনি আগে বলে নিই। বর্গের তৃতীয় ধ্বনিগুলো ঘোষ অল্পপ্রাণ। ‘দ’ হলো তার লাইনের তৃতীয় ধ্বনি। এই ‘দ’-এর প্রভাবে ‘ক’ হয়ে গেল ‘গ’। ‘গ’ ধ্বনিটিও তার লাইনের তৃতীয় ধ্বনি—মানে ঘোষ অল্পপ্রাণ। অর্থাৎ ঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনির প্রভাবে ‘ক’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে ঘোষ অল্পপ্রাণ ‘গ’ হয়ে গেল। এবার, দিক্ + বিজয় = দিগ্বিজয় সন্ধিটি নিজে পরীক্ষা করে দেখো।

উদাহরণ-৫: বাক্ + ধারা = বাগ্‌ধারা

আগেরটার সঙ্গে মিলিয়ে এবার এই উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা যাক। ডান পাশের ‘ধ’ ধ্বনির প্রভাবে বাঁ পাশের ‘ক’ ধ্বনিটি ‘গ’ হয়ে গেল। কারণ, ‘ধ’ হলো ঘোষধ্বনি। ফলে অঘোষধ্বনি ‘ক’ পরিবর্তিত হয়ে ঘোষধ্বনি ‘গ’ হয়ে গেল। অনেকে বলতে পারে, ‘ধ’ তো তার বর্গের চতুর্থ ধ্বনি। তাহলে ‘ক’ পরিবর্তিত হয়ে চতুর্থ ধ্বনি ‘ঘ’ হওয়া উচিত ছিল? না, তা হবে না। কারণ, বর্গের চতুর্থ ধ্বনিগুলো মহাপ্রাণও বটে। একসঙ্গে দুটি মহাপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারণ করা কঠিন হয়। তাই, অল্পপ্রাণ ধ্বনি ‘গ’ তৈরি হয়েছে। যেমন, উত্থান শব্দের যুক্তধ্বনিতে আছে ‘ত্’ এবং ‘থ’। অর্থাৎ, প্রথমটি অল্পপ্রাণ, পরেরটি মহাপ্রাণ। আবার উত্ + ঘাটন = উদ্‌ঘাটন শব্দের ‘দ’ অল্পপ্রাণ, ‘ঘ’ মহাপ্রাণ।

উদাহরণ-৬: দিক্ + অন্ত = দিগন্ত

এই উদাহরণে ‘ক’ কেন ‘গ’ হয়ে গেল? সমীভবনের মূলসূত্রে কী বলেছিলাম? একটা ধ্বনির প্রভাবে আরেকটা ধ্বনি বদলে যাবে। এখানে ডান পাশের ‘অ’ ধ্বনির প্রভাবে বাঁ পাশের ‘ক’ হয়ে গেল ‘গ’। তাহলে, ‘অ’-এর বৈশিষ্ট্য কী? স্বরধ্বনিগুলো ঘোষবত্ মানে ঘোষধ্বনির মতো। এর মানে, ডান পাশের ঘোষধ্বনির প্রভাবে বাঁ পাশের অঘোষধ্বনিটিও ঘোষ হয়ে গেল। একইভাবে সত্ + উপায় = সদুপায়—এই উদাহরণটি তুমি বোঝার চেষ্টা করো।

উদাহরণ-৭: দিক্ + নির্ণয় = দিঙ্‌নির্ণয়

ওরে বাবা! এই উদাহরণ দেখে অনেকের চোখ গোল গোল হয়ে যাবে। দিঙ্‌নির্ণয়ের মতো শব্দও বাংলায় আছে? এখানে কী ঘটেছে ব্যাখ্যা করতে পারো? আমি সাহায্য করছি। কারণটা না বুঝতে পারো, কিন্তু ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছ। এখানে ডান পাশের ‘ন’ ধ্বনির প্রভাবে বাঁ পাশের ‘ক’ হয়ে গেছে ‘ঙ’। তাহলে এবার চেষ্টা করো। ‘ন’ ধ্বনির এমন কী বৈশিষ্ট্য আছে, যে কারণে ‘ক’ হয়ে গেল ‘ঙ’। ‘ন’ হলো নাসিক্যধ্বনি। ফলে ‘ক’ পরিবর্তিত হয়ে নাসিক্যধ্বনি ‘ঙ’ হয়েছে। অনেকে বলতে পারে, নাসিক্যধ্বনি তো আরও ছিল। যেমন ঞ, ণ, ম। তাহলে ‘ঙ’ হলো কেন? আসলে ‘ক’ হলো কণ্ঠ্যধ্বনি। তাই ক-বর্গের নাসিক্যধ্বনি ‘ঙ’ হয়েছে। যোগ চিহ্নের বাঁ পাশে ‘ক’ না থেকে ‘ত’ থাকলে কী হতো অনুমান করতে পারো? তবে এ উদাহরণটি দেখো। তত্ + মধ্যে = তন্মধ্যে।

উদাহরণ-৮: ‘সম্’ দিয়ে সন্ধি যত

‘সম্’ উপসর্গ যোগে অনেক শব্দ আছে। সন্ধিতে তোমরা পড়েছ, এ রকম কয়েকটি নমুনা নিচে দেওয়া হলো :

সম্ + গীত = সংগীত

সম্ + চয় = সঞ্চয়

সম্ + তাপ = সন্তাপ

সম্ + ভার = সম্ভার।

এবার এই ব্যঞ্জনসন্ধিগুলো ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথম উদাহরণে ‘গ’-এর প্রভাবে ‘ম’ হয়ে গেছে ‘ঙ/ং’। দ্বিতীয় উদাহরণে ‘চ’-এর প্রভাবে ‘ম’ হয়ে গেছে ‘ঞ’। তৃতীয় উদাহরণে ‘ত’-এর প্রভাবে ‘ম’ হয়ে গিয়েছে ‘ন’। শেষ উদাহরণে ‘ভ’-এর প্রভাবে ‘ম’-এর কোনো পরিবর্তনই ঘটেনি। এগুলোর ব্যাখ্যা আমি বলে দেওয়ার আগেই কেউ কেউ বুঝতে পারবে। তবে যারা বুঝতে পারবে না, তাদের পরীক্ষা নিচ্ছি পরে। আগে বুঝিয়ে দিই। প্রথম উদাহরণে, ‘গ’ হলো কণ্ঠ্যধ্বনি। তাই নাসিক্যধ্বনি ‘ম’ পরিবর্তিত হয়ে নাসিক্য কণ্ঠ্যধ্বনি ‘ঙ/ং’ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণে, ‘চ’ হলো তালব্যধ্বনি। তাই নাসিক্যধ্বনি ‘ম’ পরিবর্তিত হয়ে নাসিক্য তালব্যধ্বনি ‘ঞ’ হয়েছে। তৃতীয় উদাহরণে একইভাবে দন্ত্যধ্বনি ‘ত’-এর প্রভাবে নাসিক্যধ্বনি ‘ম’ পরিবর্তিত হয়ে নাসিক্য দন্ত্যধ্বনি ‘ন’ হয়েছে। শেষ উদাহরণে ‘ভ’ হলো ওষ্ঠ্যধ্বনি। ‘ম’ নিজেও ওষ্ঠ্যধ্বনি। তাই এখানে নাসিক্যধ্বনিটি অপরিবর্তিত রয়েছে। এগুলো যদি বুঝতে পারো, তবে তোমাদের জন্য এই নিয়মের আরও চারটি উদাহরণ দিয়ে দিচ্ছি: সম্ + কল্প = সংকল্প; সম্ + জয় = সঞ্জয়; সম্ + দেহ = সন্দেহ এবং সম্ + বোধন = সম্বোধন। এগুলোর ব্যাখ্যা এখন তুমি নিজে নিজেই দিতে পারবে।