আমার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। হংকং গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের ১০০ বছর পূর্তি উদ্যাপিত হবে। সে উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী বেইজিং-ইনার মঙ্গোলিয়া ট্যুর আয়োজন করে তারা। আমন্ত্রিত হয় বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনসহ আরও পাঁচটি দেশের গাইডরা। তাই ২৪ জুলাই বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে বেইজিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করি আমরা চারজন। আমি একজন গাইড। আমার সঙ্গে রেঞ্জার হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আজিজা ফেরদৌস ও লাভলী আক্তার এই ক্যাম্পিংয়ে অংশ নেন। আর ময়মনসিংহ জেলা গাইড কমিশনার ও বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাছিমা আক্তার আমাদের গাইডার।
খারাপ আবহাওয়ার কারণে বেইজিং পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায় আমাদের। পৌঁছানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় জেংঝউ বিমানবন্দরে। ভাষা নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়েছিলাম আমরা। চায়নিজরা ইংরেজি বোঝে না। আমরাও ওদের মান্দারিন ভাষা বুঝি না। কী যে বিপদ! তবু তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে আমাদের সাহায্য করার জন্য। সৌভাগ্যবশত কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিল ওই ফ্লাইটে। ফলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। তা ছাড়া একসঙ্গে থাকার কারণে মনোবল ভাঙেনি আমাদের। গন্তব্যে পৌঁছানো নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও হাসি মুখে সময়টা উপভোগ করেছি। যেদিন গাইড হিসেবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, সেদিন থেকেই জানি প্রতিকূল অবস্থা হাসিমুখে প্রতিরোধ করে গাইড। যদিও ফ্লাইটে দেরি হওয়ায় প্রথম দুদিনের ক্যাম্পিংয়ে অংশ নিতে পারিনি আমরা। তবে হতাশ হইনি।
তৃতীয় দিনেই অন্য গাইডদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। ব্যাজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুত্বও হয়ে গেল সবার সঙ্গে। হংকং, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানের গাইডরা ছিল আমাদের সঙ্গে। সবার আচরণ, কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল যেন কত দিনের চেনা! ইন্টারন্যাশনাল বাসে একসঙ্গে গান গাইতে গাইতে স্যানড রেভারাইন মরুভূমিতে পৌঁছে যাই। মরুভূমিতে এই প্রথম পা রাখলাম আমি। প্রচণ্ড রোদ। কাপড়ের তৈরি বালুনিরোধক জুতা পরে বালুর ওপর হেঁটে চললাম আমরা। স্যানড ড্রাইভিং, স্যানড ডাইভিং, কেবল কারসহ বিভিন্ন রাইডে চড়েই দিনটা কাটিয়ে দিলাম।
চতুর্থ দিন, ২৮ জুলাই, আমরা রওনা দিই ইনার মঙ্গোলিয়ার পথে। চীনেরই একটি অঞ্চল। সেখানে প্রথমবারের মতো ঘোড়দৌড় দেখলাম। অন্যদের সঙ্গে আমাদের দেশের গাইডিং এবং চীনের গাইডিং সম্পর্কে নানা রকম তথ্য আদান-প্রদানও চলছিল। কথা হয়েছে আমাদের দেশে নারীদের মূল্যায়ন ও উন্নতি নিয়েও। আর ব্যাজ আদান-প্রদান তো ছিলই।
ক্যাম্পফায়ার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল বিকেলে। আমাদের আগুন জ্বেলে গান গাইতে খুব ভালো লাগছিল। রাতে একটা খোলা মাঠে বসে তারাও দেখেছি। আকাশটা এত সুন্দর! হাজার হাজার তারা আকাশে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। গাইডার আমাদের বোঝাচ্ছিলেন কোনটা কোন তারা। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে।
আমরা ইনার মঙ্গোলিয়া জাদুঘর দেখতে গেলাম পঞ্চম দিনে। কীভাবে চীনে মানুষ বসতি স্থাপন করল, একে একে সভ্যতার বিবর্তনটা কীভাবে হলো, তার উপস্থাপন ছিল জাদুঘরে। অন্য অংশটি সাজানো হয়েছে প্রাচীন ডাইনোসরদের নিয়ে। ডাইনোসরের ফসিলগুলো দেখে চমৎকৃত হলাম আমি।
ষষ্ঠ দিনটা ছিল সংস্কৃতি বিনিময়ের দিন। সবাই যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরলাম। আমরা পরলাম জামদানি শাড়ি। আমাদের পোশাকের প্রশংসা করল সবাই। আমরাও অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জামদানির ইতিহাস ব্যাখ্যা করলাম। পরে ইনার মঙ্গোলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার একত্র হলাম সবাই। প্রত্যেকে তার সংস্কৃতির দিকগুলো তুলে ধরল। ‘ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে’ গানটার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করলাম আমরা।
এবার দেশে ফেরার পালা। আবার বেইজিং ফেরার জন্য বটোও থেকে ট্রেনে উঠলাম আমরা। একসঙ্গে সেটাই ছিল আমাদের শেষ জার্নি। শেষবারের মতো একসঙ্গে গান করলাম আমরা, আড্ডা দিলাম, তারপর একসময় এভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে সবাইকে বিদায় জানিয়ে একরাশ ভালোবাসা, অভিজ্ঞতা, আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।