নেটের এক পাশ থেকে শাঁই করে বল ছুটে গেল আরেক পাশে। পুঁচকে এক ছোট্ট মেয়ে টেনিস র্যাকেট হাতে ছুটে গেল বলের দিকে। ব্যাটের তীব্র আঘাতে আবার প্রতিপক্ষের কোর্টে বল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও প্রতিপক্ষ যেন সামলে উঠতে পারল না এ যাত্রায়। এমন দুর্দান্ত সব টেনিস ম্যাচের তারকা হলো আমাদের বাংলাদেশের টেনিস খেলোয়াড় মাসফিয়া আফরিন।
বাবা বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনে কাজ করার সুবাদে ছোট থেকে স্বপ্ন জড়ানো এই দুরন্ত কোর্টে যাওয়া–আসা ছিল তার। বাবার হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতেই টেনিসের হাতেখড়ি হয় সাড়ে চার বছরের ছোট্ট মাসফিয়ার। বাবাও একটু–আধটু চাইতেন, মেয়েটা যেন খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। নিয়মিত না হলেও বাবার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতেই ব্যাট হাতে টেনিস মাঠে দেখা যেত মাসফিয়ার দৌড়ঝাঁপ। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ছোট্ট মাসফিয়া অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন আয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার জব্বার মেমোরিয়াল খুদে টেনিস টুর্নামেন্টে। প্রথমবার জয় না পেলেও বাবা ঠিকই বুঝতে পারেন মেয়ের স্বপ্নের কথা। এবার একেবারে হাতে–কলমে শুরু হয় মাসফিয়ার টেনিস প্রশিক্ষণ। কয়েক মাসের প্রশিক্ষণের পরেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ওই বছরই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক টেনিস টুর্নামেন্টে সেরা আটে জায়গা করে নেয় মাসফিয়া। বছর পেরোতেই রানার জাতীয় টেনিস টুর্নামেন্টে সবাইকে ছাড়িয়ে প্রথম হওয়াটাই যেন জানান দিচ্ছিল মাসফিয়ার আগামী দিনের। তাই দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু হয় তার।
খেলাধুলার এত ঝক্কি–ঝামেলা সামলেও পড়াশোনায়ও বেশ ভালো করছে মাসফিয়া। সারা দিন টেনিস অনুশীলনের পর মাসফিয়ার সামান্য অবসর কাটে গান শুনে। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দেই দিন কাটে তার।
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা আন্তস্কুল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বৈত ও একক ক্যাটাগরিতে পাঁচটি চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার উঠে আসে মাসফিয়ার ঝুলিতে। ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে মাসফিয়া ২০১৬ সালে রানার গ্রুপ আয়োজিত টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও জাতীয় টেনিস টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় সে। নিজের পেছনের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সেই বছরই ওয়ালটন ফার্স্ট ওপেন টেনিস টুর্নামেন্ট ও ইউরো গ্রুপ টেনিস টুর্নামেন্টে দুবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উঠে আসে তার হাতে। ২০১৭ সালের শুরু থেকেই নিজের খেলাধুলা নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দিনভর টেনিস ফেডারেশনের মাঠে প্র্যাকটিস করতে হতো তাকে। পাশাপাশি পড়াশোনাও সমানতালে চালিয়ে গেছে মাসফিয়া।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেয় মাসফিয়া। সেবার দুটি ম্যাচ জিততে পারলেও চূড়ান্ত বিজয় ধরা দেয় না। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশেই শুরু হয় এশিয়ান অনূর্ধ্ব–১৪ টেনিস সিরিজ। সেখানে শ্রীলঙ্কার সাজিদা রাজির সঙ্গে জুটি বেঁধে দ্বৈত বিভাগে সেরা জুটি নির্বাচিত হয়। এককে সেমিফাইনাল পর্যন্ত এগোলেও একটু যেন ঘাটতি থেকে গিয়েছিল পরিশ্রমে। তাই নিজের সেরা দিতে আবার প্র্যাকটিসে মন দেয় মাসফিয়া।
গত মাসেই আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন অনুমোদিত ‘আইটিএফ এশিয়ান অনূর্ধ্ব–১৪ ডেভেলপমেন্ট চ্যাম্পিয়নশিপস ২০১৯’–এ বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেয় মাসফিয়া আফরিন। থাইল্যান্ডে এই আয়োজনে অংশ নেয় বাইরের সব বাঘা দল। তাদের সঙ্গে খেলেই কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয় মাসফিয়া। সেখানে কোনো পুরস্কার না পেলেও সবার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন কোচ। দেশে ফেরার পরই আন্তর্জাতিক ফলাফল দেখে চমকে গেল সবাই। বালিকা অনূর্ধ্ব–১৪–এর আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে ৩২তমতে উঠে আসে মাসফিয়ার নাম। গত কয়েক বছরে কোনো বাংলাদেশি মেয়ে টেনিস খেলোয়াড়ের র্যাংক এত ওপরে আসেনি বলে জানায় বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন।
খেলাধুলার এত ঝক্কি–ঝামেলা সামলেও পড়াশোনায়ও বেশ ভালো করছে মাসফিয়া। সারা দিন টেনিস অনুশীলনের পর মাসফিয়ার সামান্য অবসর কাটে গান শুনে। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দেই দিন কাটে তার। প্রিয় বাবার অনুপ্রেরণাতেই টেনিস কোর্টে যেন বিজয়ের নেশাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। বাবার মুখে হাসি ফোটাতেই যেন এত সংগ্রাম। এত কিছুর পাশাপাশি কিশোর আলোর প্রতিটি আয়োজনেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপস্থিত থাকে মাসফিয়া। এ বছর নবম শ্রেণিতে উঠেছে সে। পড়াশোনার প্রতি খেয়াল রেখেই সমানতালে চলছে মাসফিয়ার টেনিস র্যাকেট। সব সামলে চলাটা অনেক কষ্ট হলেও পরিবার আর দেশের মানুষের মুখের হাসিটা ধরে রাখতে এভাবে পরিশ্রম করতে তার খারাপ লাগে না বলে জানায় মাসফি। বড় হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টেনিসের মাধ্যমে দেশকে তুলে ধরতে চায় সে। আমরাও অপেক্ষা করি, যেন ভবিষ্যতে বিদেশের কোনো টেনিস মাঠের সেরা তারকা হয়ে ওঠে আমাদের এই খুদে মাসফিয়া।