উষ্কখুষ্ক জট ধরা লালচে চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ভালোভাবে আঁচড়াতে জানে না সে। পরনে ময়লা ছেঁড়া প্যান্ট আর ফুটবল খেলোয়াড়ের জার্সি। কোন দেশের, তা তার জানা নেই। চোখজোড়া চাঞ্চল্যে ভরপুর আর খানিকটা মায়াবীও বটে। তবে এই মায়াবী ভাবটা কারও চোখে ধরা দেয় কি না সন্দেহ। আর চাঞ্চল্য প্রায়ই বদমায়েশি রূপে ধরা দেয়। লেগুনার মরচে পড়া হ্যান্ডেলটা আলতো করে ধরে রেখেছে এক হাত দিয়ে, আরেক হাতের আঙুলের ফাঁকে গোছা দশ, বিশ টাকার নোট। ভর্ৎসনা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, খুবই বাস্তব। প্রায়ই জেরার মুখে পড়তে হয়। ড্রাইভার মশাইকে প্রতিটা টাকার হিসাব দিতে না পারলে লাথি–গুঁতাও খেতে হয়। কারণ, কৌশলে দুই–তিনটা নোট পকেটে পুরে নেয় সে। কখনো শুনতে হয় যাত্রীদের কটু কথা। মন খারাপ করে না রাজু। ভালোভাবে কথা বলার ব্যাপারটা তার জানা নেই। গালিও দিতে পারে সে।
কে তাকে শেখাবে যে গালি দেওয়া ভালো নয়। মারামারিতে সে ওস্তাদ। রুগ্ণ শরীরটা দেখলে তা ঠাহর করা মুশকিল। স্নিগ্ধ ব্যস্ত বিকেলে হয়তোবা ছুটির দিনে একজন ভদ্রলোক তাঁর ছেলেকে আর মেয়েকে আদর করে পিতৃস্নেহে চকলেট কিনে দিচ্ছেন। চোখে পড়েছে তার। তবে মাথা ঘামায়নি। কারণ, এরূপ স্বর্গীয় দৃশ্য তার চিন্তার বাইরে।
বাবাকে কখনো দেখেনি সে। রাস্তাঘাটের সব টেম্পো হেলপার (ছোট ছোট শিশু) আর টোকাই শিশুদের ও চেনে। সবার সঙ্গে তার ভাব ও শত্রুতা। টিভি দেখতে বড় ভালোবাসে। আকবর চাচার চায়ের দোকানের সামনে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখতে জড়ো হয় সবাই। ভিড়ের মধ্যে সে মিশে যায়। মাশরাফিকে সে ভীষণ পছন্দ করে। আকবর চাচা মানুষটা খারাপ নন। তাকে দেখলে ভ্রু কুঁচকে রাখেন। তবে তাড়িয়ে দেননি কখনো।
মাঝেমধ্যে পাঁচ টাকার পাউরুটি দুই টাকায় দেন তাকে। দিনটা এভাবে কাটে তার। মাঝেমধ্যে মিনারেল ওয়াটারের নামে ভুয়া পানিও বেচে। টাকাকড়ি পায় খুব কম। সকালে ধবধবে সাদা স্কুলড্রেস পরা ছেলেমেয়েদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখে। তার কাছে তা বিশেষ কিছু মনে হয় না। শিক্ষা কী জিনিস, তা সে জানে না। জানাবেই–বা কে? কখনো স্বপ্নও দেখেনি যে স্কুলে যাবে। তাই বলে কি রাজুর ছোট ছোট মায়াবী চোখজোড়া স্বপ্ন দেখে না? অবশ্যই দেখে। বস্তির সেই খাঁচার মতো ঘরটিতে শুয়ে আছেন রাজুর প্যারালাইসড মা। ছোট বোন রানীর লাল ফ্রকটা একপাশে ঝুলে থাকে।
লেগুনার মরচে পড়া হ্যান্ডেলটা আলতো করে ধরে রেখেছে এক হাত দিয়ে, আরেক হাতের আঙুলের ফাঁকে গোছা দশ, বিশ টাকার নোট। ভর্ৎসনা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, খুবই বাস্তব।
ঈদে আবদার করেছিল একটা নতুন টকটকে লাল রঙের ফ্রক কিনে দিতে হবে। কিন্তু টাকা কোথায়। কিনে দিতে না পারায় ছোট বোনের সে কী কান্না! মালিক রোজ হাতে দু–তিনটা ময়লা নোট পুরে দেয়। সেখান থেকে একটা নোট সরিয়ে রাখে রাজু। রাজুর স্বপ্ন যখন অনেক টাকা জমাতে পারবে, তখন মায়ের চিকিত্সা করাবে আর রানীকে টকটকে লাল রঙের ফ্রক কিনে দেবে। ফ্রক পরলে রানীকে নিশ্চয়ই পরির মতো লাগবে। ডানা ছাড়া পরি। সেই চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে ক্লান্তিমাখা দেহ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছেঁড়া কাঁথার ওপর। আর স্বপ্নে দেখে মা হাসিমুখে পায়েস রাঁধছেন। রানী তার হলুদ দাঁত বের করে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। পরনে লাল টকটকে জামা। আনন্দে কেঁপে ওঠে ছোট দেহটা।