মার্চের কোনো এক সন্ধ্যায় সোমলতা অস্থির হয়ে পড়ে। তার এমন একটা অনুভূতি হয়—ঠিক এই মুহূর্তে, পৃথিবীর কোথাও, কোনো এক স্থানে, কোনো একটা যুদ্ধ হচ্ছে আর সেই যুদ্ধে একটা বাচ্চার জীবন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষের না, ঠিক একটা বাচ্চার জীবন।
হয়তো আসলেই কোনো যুদ্ধ হয়েছিল সেই সন্ধ্যায়। হয়তো একজন-দুজন নয়, ১০০ মানুষ মারা গিয়েছিল যুদ্ধে। কিন্তু এর কোনো কিছুই সোমলতাকে তাড়িত করে না। সে অস্থির হয়ে পড়ে কেবল এই কারণে যে কল্পনায় একটা বাচ্চার জীবন এলোমেলো হয়ে যেতে দেখে সে। দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়ে ভাসে তার চোখের সামনে, জলরঙে আঁকা কোনো ছবির মতো। একরকম ঘোরের মধ্যে রংপেনসিল তুলে নেয় সোমলতা এবং ঘরের দেয়ালে বড় বড় করে লেখে—
‘কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে!’
দেয়ালজুড়ে শব্দগুলো লিখে সোমলতা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, অনন্তকাল ধরে।
আদৌ কি সেই সন্ধ্যায় কোনো যুদ্ধ হয়েছিল? ঠিক কোন বাচ্চাটা হাজির হয়েছিল সোমলতার কল্পনায়?
এটা বলা কঠিন; কিন্তু আমরা কয়েকটা অনুমান করতে পারি।
অনুমান ১
বাচ্চাটা রোহিঙ্গা শিবিরের ১৪ বছর বয়সী একটা মেয়ে। নাম সাজিদা।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে গণহত্যা চালায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর, সেই ঘটনায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ। যারা একটু ভাগ্যবান, কোনোভাবে প্রাণটা নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পেরেছে। যারা আরও দুর্ভাগা, তারা নিরাপদ জায়গাটুকু পর্যন্ত খুঁজে পায়নি, তার আগেই মারা গেছে।
নিজের বাসা ছেড়ে শরণার্থী হয়ে থাকা কোনো আনন্দের বিষয় নয়। তাই, এমনটা কী হতে পারে যে সোমলতা আসলে সাজিদার কথা ভাবছিল মার্চের সেই সন্ধায়?
অনুমান ২
অথবা এমনও হতে পারে, বাচ্চাটার বাড়ি ইয়েমেনে, আর তার নাম খালেদ। বয়স, এই হয়তো ১২।
২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেখানে বাস্তুহারা হয়েছে অসংখ্য মানুষ। কেউ কেউ নিজের ঘরে বসে মারা গেছে, বোমার আঘাতে। কেউ মারা গেছে স্কুলে বোমার আঘাতেই। আর যারা বোমায় মরেনি, তারা মারা গেছে এমন কিছু কারণে, চাইলেই যেগুলো থামানো যেত। অল্প একটু খাবার দিলে, কিংবা কিছু ওষুধ পেলে।
আমরা যে বাচ্চাটার কথা অনুমান করছি খালেদ, সে আহত হয় নিজের স্কুলবাসে বসে। বাসটা যখন স্কুলে যাচ্ছিল, একটা বিমান আকাশ থেকে গোলাবর্ষণ করে। একটা গোলা এসে পড়ে খালেদের স্কুলবাসে। সেই বাসে যারা ছিল, বেশির ভাগই একেবারে শিশু। ৪০ জন শিশু সেখানেই মারা যায়।
খালেদ আহত হয় নিদারুণভাবে। প্রায় মাসখানেক পরে একটা হাসপাতালে তার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরার পর, কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে যেত সে। খালেদের বন্ধুরাও আসত, তাকে দেখতে।
এরপর একটা সময় সবার আসা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, তারা মারা গেল, সবাই। নিয়তির কোনো এক কারণে খালেদ বেঁচে থাকল, একা।
কোনো কোনো দিন খালেদ কবরস্থানে যায়, যেখানে তার বন্ধুরা শুয়ে আছে। গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সুতরাং এটা অসম্ভব না যে, মার্চের সেই সন্ধ্যায় সোমলতা খালেদের কথা ভাবছিল।
অনুমান ৩
আবার এটাও হতে পারে, সোমলতা ভাবছিল টিনার কথা। মধ্য আফ্রিকার দেশ, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর একটা মেয়ে। বয়স ১১।
প্রায় দুই দশক ধরে সংঘাত চলছে টিনাদের দেশে। হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই কোনো স্কুলে কিংবা কোনো হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একেকটা সময়ে মহামারির মতো কলেরা কিংবা এবোলা ছড়িয়ে পড়ছে। ওষুধ নেই।
টিনা তার গ্রামে শান্তিতেই ছিল। হুট করে একদিন সেখানে সংঘর্ষ শুরু হলো সরকার আর স্থানীয় অস্ত্রধারীদের মধ্যে। সেই সংঘর্ষের মধে৵ টিনাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে পাওয়া খবরে টিনা জানতে পারল মেরে ফেলা হয়েছে তার বাবাকে। প্রাণে বাঁচার জন্য মাকে নিয়ে টানা ৩০ কিলোমিটার হেঁটে আশ্রয় নিল টিনা, দূরে কোথাও।
টিনারা যেখানে থাকে এখন, সেটা ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। অল্প একটু জায়গায় তারা জনাবিশেক মানুষ থাকে। কোনো কোনোদিন খাবার জোটে, সেদিন সে খায়।
স্কুলে যাওয়া সে বন্ধ করে দিয়েছে কারণ, প্রতিটা স্কুলেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। টিনা চিন্তিত এই নিয়ে যে, যদি পড়াশোনা করতে সে না পারে, বড় হয়ে সে আর ডাক্তার হতে পারবে না।
কাজেই এটা ঘটাও সম্ভব যে, মার্চের সন্ধ্যায় সোমলতা যার কথা ভাবছিল, তার নাম টিনা।
অনুমান ৪
আগের তিনটা অনুমানের ভিত্তি আছে। তিনটাই বাস্তব ঘটনা।
কিন্তু এমনটা হতেই পারে যে, সোমলতার কল্পনায় যে এসেছিল, সে বাস্তব কোনো মানুষ না। সে মেয়ে না, ছেলে না, নির্দিষ্ট কোনো দেশের না। ইউক্রেনের খারকিভ থেকে বাংলাদেশের রামু, চীনের শিনজিয়াং থেকে আমেরিকার স্ট্যাটন আইল্যান্ড—সেসব জায়গার। তার নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই, জাত নেই, নেই কোনো পূর্ব-পশ্চিম। বোমা কিংবা আগুনে সে এতটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, কেবল ‘মানুষ’ ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে তাকে চেনার উপায় ছিল না।
আমার কেন যেন মনে হয়, এই অনুমানটাই হয়তো সত্যি। কারণ, মার্চের যে সন্ধ্যায় সোমলতার মধ্যে সেই অস্থিরতাটুকু ভর করে, তার কয়েক দিন বাদেই আমি গিয়েছিলাম তার বাসায়। গিয়ে দেখি, ঘরের কোনো দেয়াল আর সাদা নেই, প্রতিটা দেয়ালজুড়ে যুদ্ধবিরোধী কোনো গানের কথা লেখা।
তার মধ্যে বড় করে চোখে পড়ে জন লেননের একটি ছবি। নিচে লেখা, ‘গিভ পিস আ চান্স।