প্রথম আলো কার্যালয়ে লেখকেরা আসেন নিয়মিতই। তাই পত্রিকার কর্মীদের কাছে এটা বেশ স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তবে ২৭ জুন বিকেলটা ছিল অন্য রকম। লেখকদের মেলা বসেছিল বটে, তবে বয়সে তারা একেবারেই ছোট। কেউ কেউ তো এখনো পেরোয়নি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি। বয়সে ছোট হলেও লেখালেখির প্রতিভায় তারা বেশ বড়। প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র গোল্লাছুটের ‘এসো গল্প লিখি ২০২২’ প্রতিযোগিতার বিজয়ী তারা। আজ বিকেলে প্রথম আলোর সভাকক্ষে এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সব খুদে সাহিত্যিক।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গোল্লাছুটে খুদে লিখিয়েদের কাছে গল্প আহ্বান করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিভাগ ছিল দুটি। ক বিভাগ (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ও খ বিভাগ (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি)। প্রায় এক মাসে ই-মেইল, সরাসরি ও ডাকযোগে গল্প জমা পড়েছিল এক হাজারের বেশি। অনেক বিচার–বিশ্লেষণের পর এপ্রিল ও মে মাসে দুই বিভাগের সেরা ছয়টি গল্প ছাপা হয় গোল্লাছুটের পাতায়। এ ছাড়া বিশেষ স্থানজয়ী আরও চারটি গল্প জায়গা করে নেয় গোল্লাছুটে।
আজ দুই বিভাগের ছয়জন বিজয়ীকে পরিবারসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রথম আলোর কার্যালয়ে। সাধারণত মা-বাবা পরিচয় করিয়ে দেন সন্তানদের। এই অনুষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রম—প্রত্যেক বিজয়ী তাদের মা-বাবাকে পরিচয় করিয়ে দেয় উপস্থিত সবার সঙ্গে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ ও কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হকসহ আরও অনেকে।
অল্প কথায় খুদে লেখকদের অভিনন্দন জানান প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি সব অভিভাবককে ধন্যবাদ জানান সন্তানদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। দেশের ভবিষ্যৎ লেখকদের কাছে পেয়ে খুব খুশি হন তিনি।
সবাইকে বেশি বেশি করে ভালো বই পড়ার পরামর্শ দেন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। আরও মনে করিয়ে দেন, ‘লেখালেখির পাশাপাশি পড়ালেখাতেও ভালো ফল করতে হবে। আর ভালো লেখক হতে হলে লিখতে হবে অনেক।’
বিজয়ীদের গল্প ও পুরস্কার
ক বিভাগে প্রথম পুরস্কার জিতেছে আফরা ইবনাত। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে সে। আফরার গল্পের চরিত্রগুলো খুব মজার। এক বুড়ো ডাইনোসর ও তার নাতি–নাতনিদের গল্প লিখেছে সে। আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিল সে।
মীর রাগীব তাজওয়ার জিতেছে একই বিভাগের দ্বিতীয় পুরস্কার। গল্প লেখার সময় কেমন পরিবেশ লাগে তাজওয়ারের? খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিল সে, ‘গান শুনে কাজ করতে আমার রিল্যাক্স লাগে’। সাউথব্রিজ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী শুধু লেখকই না, একই সঙ্গে ইউটিবারও। একদম অলরাউন্ডার!
এই বিভাগে তৃতীয় পুরস্কারটি জিতেছে নাজিফা নাওয়ার। ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। দুই দিন আগে মানুষ থেকে ভূত হওয়া ধাপ্পা সাহেবের দারুণ এক গল্প লিখেছে নাজিফা। ভূত হতে হলে যে কত রকম পরীক্ষা দিতে হয়, গল্পে সেটা মানুষদের জানিয়ে দিয়েছে সে। এমন গোপন তথ্য জানানোর জন্য তো একটা পুরস্কার নাজিফা পেতেই পারে!
ছোটদের গল্প তো হলো। এখন ছোটদের মধ্যে একটু বড় যারা, তাদের গল্প বলি। খ বিভাগে প্রথম পুরস্কার জিতেছে সারাহ্ তাসনীম। ‘রক্তের জুস’ শিরোনামে গল্প লিখে পাঠিয়েছিল সারাহ্। অদ্ভুত এই নাম নজর কেড়েছিল বিচারকদের। গল্পটাও দারুণ। তবে লেখা পাঠানোর পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা শেষেও যখন পত্রিকায় নিজের নামটা দেখছিল না সারাহ্, ভেবেছিল তার গল্প বুঝি বাদই পড়ে গেছে। সারাহ্র মুখেই শুনছিলাম সে কথা, ‘সে সময়টা খুব মন খারাপ হয়েছিল। একসময় তো মাকে বলেই ফেলছিলাম, আম্মু, আমি কি এত খারাপ লিখি?’ নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়ম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে সে। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করে খুব খুশি সারাহ্। বড় হয়ে লেখক হতে চায় সে।
খ বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী রাফাহ তাসনিয়া এসেছে সুদূর রাজশাহী থেকে। সরকারি পিএন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে সে। ছোটবেলা থেকে লেখালেখিতে খুব আগ্রহ তাসনিয়ার। বাকিটা শোনা যাক তাসনিয়ার মুখে, ‘গোল্লাছুটে প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেখেই বসে যাই লিখতে। আইডিয়া জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে কিছু একটা দাঁড় করাই। সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম গোল্লাছুটে। তবে অনেক দিন কেটে যাওয়ায় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন পর গোল্লা ভাইয়ার কল পেয়ে জানতে পারি আমি পুরস্কার পেয়েছি। খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম। প্রকাশের দিন না দেখলেও পরে অনেক খুঁজে নিজের গল্প ছাপা অক্ষরে পাই। পত্রিকার পাতায় প্রথম ছাপা অক্ষরে নাম। ব্যাপারটাই আলাদা!’
মুমতাহিনা মিজান পড়ে ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউটে দশম শ্রেণিতে। সে জেতে খ বিভাগের তৃতীয় পুরস্কারটি। মুমতাহিনা বলল তার লেখা গল্পের পেছনের গল্প, ‘প্রতিদিন বাবা রাতে বাসায় ফেরার পর আমি বাবাকে গল্প শোনাই। একদিন আমি বইয়ের ভেতর আমার লেখা গল্পটা রেখে বাবাকে পড়ে শোনাচ্ছিলাম। যেন বাবা বুঝতে না পারে গল্পটা কার লেখা। গল্প শুনে বাবা বলল, খুব সুন্দর গল্প। কে লিখেছে? বললাম আমি লিখেছি। বাবা বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না যে গল্পটা আমার লেখা। আর যেদিন গল্পটা ছাপা হলো, বাবার মতো আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!
অনুষ্ঠানের শেষ অংশে অতিথিদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে বিজয়ীরা। প্রতি বিভাগের প্রথম বিজয়ী পায় পাঁচ হাজার টাকার বই, দ্বিতীয় বিজয়ী পায় তিন হাজার টাকার বই ও তৃতীয় বিজয়ী পায় দুই হাজার টাকার বই। কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন কিআর বিভিন্ন উপহার।
পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর ফিচার বিভাগের প্রধান সুমনা শারমীন। ভবিষ্যতে গোল্লাছুট আর কিশোর আলো আরও মজার মজার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে যাচ্ছে। সেগুলোর খবর জানতে নিয়মিত চোখ রাখো গোল্লাছুট আর কিশোর আলোর ওয়েবসাইটে।