প্রিয় সাকিব ভাইয়া,
আমি যখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি, তখন প্রায়ই আব্বু আমাকে বকা দিত, বাঁ হাতে লিখতাম, ব্যাটিং-বোলিং করতাম বলে। এমনও হয়েছে, বিকেলে খেলার সময় মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকত আব্বু। আমি বাঁ হাতে ব্যাট ধরতেই আব্বু দূর থেকে ধমকে উঠত, ‘ডান হাতে ব্যাট ধর বেয়াদব!’ বাধ্য হয়ে আমাকে ডান হাতেই ব্যাটিং করতে হতো। এসব নিয়ে বন্ধুরা অনেক হাসাহাসি করেছে তখন। কিন্তু এখন আমি বাঁ হাতে লিখি, ব্যাটিং-বোলিং করি, আব্বু কিচ্ছু বলে না। কারণটা কি জানেন? কারণ হলেন আপনি। আপনার খেলা দেখেই আব্বু পুরো পাল্টে গেছে। ধমক না দিয়ে বলে, ‘বাঁ হাতে ব্যাটিং করতে ভালো লাগলে করবি। কোনো সমস্যা নাই। সাকিব আল হাসানও বাঁহাতি। কিন্তু ওর মতো পরিশ্রম করতে হবে...’।
শুধু আব্বুই না, বাসার সবাই আপনার ভক্ত। আর আমি তো আপনার মহা ভক্ত। পরীক্ষার পড়া আমার মনে থাকে না, কিন্তু আপনার সব ইনিংসের কথা মনে থাকে। মনে থাকে সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা, কবে কার সঙ্গে পাঁচ উইকেট পেলেন, অ্যাভারেজ, ইকোনমি রেট সব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার রোল ১১ না হয়ে ৭৫ হলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আম্মু মারবে বলে সে চেষ্টা করি না কখনো। তবে ৭৫ নম্বর জার্সি কিন্তু আছে কয়েকটা। আমরা বাসায় যে পত্রিকা রাখি, তারা খুব বেশি ভালো না। মেসি, নেইমারের পোস্টার দেয়, কিন্তু আমাদের সাকিবের পোস্টার কখনো দেয় না। তাই নিজেই ইন্টারনেট থেকে আপনার ছবি নিয়ে প্রিন্ট করে পড়ার টেবিলে টাঙিয়ে রাখি। পড়তে বসলে কিংবা বিছানায় শুয়ে প্রায়ই সেই ছবিগুলোর দিখে তাকাই, আর মনে পড়ে ১১ মার্চ ২০১২-এর কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ছিল রোববার। এশিয়া কাপের ফাইনাল। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ! দেশের সবাই চাইছিল বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হোক। কিন্তু কীভাবে যেন আমরা হেরে গেলাম! খেলা শেষ হওয়ার পর সবাই কেঁদেছে, আমি একটুও কাঁদিনি। সবাইকে সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে এমন কান্না এল...অঙ্ক পরীক্ষায় ফেল করলেও বোধ হয় আমি এত কাঁদতাম না। কয়েকটা দিন মন এত খারাপ ছিল, কিছুই ভালো লাগত না।
সে রকম মন খারাপ আবার হয়েছে কয়েক দিন আগে। যখন জানলাম ছয় মাস আপনি বাংলাদেশ দলে খেলবেন না। আপনাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনি শৃঙ্খলাভঙ্গ করতে পারেন না। তাহলে কি আপনি এত নিয়মতান্ত্রিক বোলিং করতে পারতেন? শেষ টেস্টেও আপনি ৩৪ ওভারে ১৪৮ রান দিয়ে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন।
ভাইয়া, বাংলাদেশ দলকে আমি জীবন দিয়ে ভালোবাসি। কিন্তু এটাও ঠিক, আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ দল কল্পনাও করা যায় না। সাকিব আল হাসানের কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। আমরা যারা ক্রিকেট খেলি, ক্রিকেট নিয়ে ভাবি, তাদের সবার স্বপ্ন সাকিব হওয়া। আপনি যখন মাঠে নামেন, তখন পুরো গ্যালারি কেঁপে ওঠে হাততালি আর ‘সাকিব সাকিব’ ধ্বনিতে। আগামী ছয় মাস আপনি মাঠে নামবেন না, আপনার একেকটা শটে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করতে পারব না, এটা ভাবতেই আমার চোখে পানি চলে আসে। প্লিজ ভাইয়া, আপনি দ্রুত মাঠে ফিরে আসুন, আর সব সমালোচনা পুল করে উড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিন। এমনভাবে খেলুন, এমনভাবে থাকুন যাতে কোনোভাবেই কেউ কোনো অভিযোগের বাউন্সার আপনার দিকে ছুঁড়ে দিতে না পারে।
আমরা সবাই আপনাকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া, সব সময় ভালোবাসব। ভালো থাকবেন।
(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)