মাথার ওপরে কড়া রোদ। এক পাশে সমুদ্র, আরেক পাশে বালুর চর। যেদিকেই চোখ যায়—নীল পানি। দূরে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকাও দেখা যাচ্ছে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ কানে লাগছে। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় অনুভূতি বলতে পারো। কিন্তু হঠাৎ করেই তীব্র ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল। শীতে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আরকি। ব্যাপারটা কী? মাত্রই তো বেশ রোদ পোহাচ্ছিলাম। হঠাৎ শীতই–বা লাগছে কেন?
এক বিরাট ঝাঁকিতে ঘুম ভেঙে গেল। লঞ্চ আরেকটা লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। পাশের জানালা দিয়ে শীতের ঠান্ডা হাওয়া ঢুকেই আসলে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যাচ্ছি ভোলার এক চরে। নাম চর কুকরিমুকরি। কী অদ্ভুত নাম। প্রথমবার শুনে তো ভেবেছিলাম চর কুড়মুড়ি!
ঢাকায় ইদানীং কী শীতটাই না পড়ছে! ঘরে লেপ–কাঁথা মুড়ি দিয়েও থাকা যায় না। সেখানে লঞ্চের শীতের কথা না–ই বললাম। একটানা নদীর ঠান্ডা বাতাস খেয়েছি। বুঝতেই পারছ, কী অবস্থা হয়েছিল। লঞ্চে ১০ ঘণ্টার এক শীতের যাত্রা, মনে হলো অনন্তকালের মতো। ভোলার বেতুয়ায় নেমে দুটি টি–শার্ট আর সোয়েটারের ওপর আরও দুটি শার্ট পরে নিতে হলো। সঙ্গে চাদর। তা–ও শীত বাধা মানে না। আমাকে খুঁজেই নিল।
সেখান থেকে মোটরসাইকেলে চলে এলাম চরফ্যাশন। চরগুলোর নাম বড়ই অদ্ভুত। ‘চরফ্যাশন’ নামকরণ কীভাবে হলো জানার ইচ্ছা হয়েছিল। ১৮৮৫-৮৭ সালের দিকে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ জে এইচ ফ্যাশন সাহেব নাকি এ এলাকায় একটি বাজার বানান। পরে এ এলাকার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে চরফ্যাশন বাজারটি। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নামানুসারে এই নাম।
বাসে কচ্ছপিয়া ঘাটে এসে উঠে পড়লাম স্পিডবোটে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সময় ঢাকায় পড়ছে হাঁড়কাপানো শীত, কিন্তু কুকরিমুকরিতে উঠেছে মিষ্টি রোদ। এখানে আসা যে বৃথা হয়নি, তা মনে করে বেশ গর্ব হচ্ছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঘাট থেকে কুকরিমুকরি যাওয়ার সময় আশপাশের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। যারা সুন্দরবনে গেছ, নিশ্চয় জানো, লঞ্চে বা বোটে যাওয়ার সময় নদীর দুই ধার ঘেঁষে সারি সারি গাছ দেখা যায়। মনে হয়, বনের ভেতরের কোনো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। চর কুকরিমুকরি যাওয়ার সময়ও এটাই মনে হবে। মনে হবে, ভোলার মধ্যে এক টুকরো ‘সুন্দরবন’। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাবে, একটু পরপরই বড় বড় নৌকা বানানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও মাঝিদের জালভর্তি নৌকা দেখা যাচ্ছে।
চর বলতে আমরা বুঝি, একপাশে বালুর এক বিরাট ভূমি, তীর ঘেঁষে নদী। কিন্তু চর কুকরিমুকরি বা চরফ্যাশন মোটেও সে রকম না। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা একটি দ্বীপই হচ্ছে এই কুকরিমুকরি। যেখানে মানুষ বাস করে, কৃষিকাজ করে, মাছ ধরে, নৌকা বানায়। ‘দ্বীপকন্যা’ হিসেবে পরিচিত এ চরের বয়স ৪০০ বা ৫০০ বছরের কাছাকাছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখানে শুরু হয় বনায়ন। শুরুতে শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন করা হলেও ধীরে ধীরে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর ইত্যাদি গাছ লাগানো হয়। কুকরিমুকরির শীতকালের চেহারা একটু আলাদা। সেখানে তখন উড়ে বেড়ায় হরেক রকমের অতিথি পাখি।
কুকরিমুকরিতে দ্বীপের মাঝখান দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অনেক খাল। নিজেদের বানানো নৌকা দিয়েই জেলেরা খাল থেকে নদীতে, তারপর সাগরে গিয়ে মাছ ধরেন। আবার মনুষ্যসৃষ্ট এখানকার বনেও রয়েছে হরেক রকমের প্রাণী। লাল কাঁকড়া, বুনো মহিষ, বানর, বনবিড়াল, শেয়াল, বনমোরগ ইত্যাদি। ইচ্ছা ছিল, যদি কোনো হরিণের দেখা পাই তো আলাপ–পরিচয় হবে। কিন্তু হরিণ মহাশয় দেখাই দিলেন না। এ ছাড়া কুকরিমুকরিতে রয়েছে বিরাট এক নারকেলবাগান।
অনেকটা সময় হাতে নিয়ে না গেলে পুরো চর ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। শহুরে চাপ থেকে খানিকটা স্বস্তি পেতে, একটু গ্রাম, সাগরের ছোঁয়া পেতে ঘুরে আসতেই পারো চর কুকরিমুকরি। তবে হ্যাঁ, বন্ধুরা মিলে গেলে বাসা থেকে অনুমতি নিয়ে যেতে ভুলো না যেন। আর পরিবারের সঙ্গে গেলে তো কথাই নেই!