ক্যাফেটেরিয়ায় কিছুক্ষণ আগেও আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা দিচ্ছিল রোমেলদের আট-দশজনের দলটি। কিন্তু হঠাৎই কথায় কথায়, তর্কে তর্কে বাঁধল মহাবিপত্তি। দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, বাড়তে লাগল ঝগড়ার উত্তাপ, চেয়ার–টেবিল উঠিয়ে একে অন্যের ওপর রীতিমতো চড়াও হলো তারা। কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় সেদিনের মতো শান্ত হলো সবাই। কিন্তু এরপরও একে অন্যকে হারিয়ে দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, একে অন্যের ক্ষতি করার প্রচণ্ড আগ্রাসী মনোভাব দেখা যেতে লাগল তাদের মধ্যে। যতই সময় যেতে লাগল ক্লাবের কাজে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে, ক্লাসে-করিডরে-খেলার মাঠে ক্রমেই সেদিনের ঝগড়ার জের ধরে বাড়তে লাগল একে অন্যের প্রতি সহিংস আচরণ। অথচ পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ঝগড়ার বিষয় ছিল ফুটবল ক্লাব। হ্যাঁ, এমনটা আজকাল প্রায়ই হচ্ছে। ছোট ছোট বিষয়ে মতের অমিলের জের ধরে বাড়ছে শত্রুতা, সহিংসতা। সহনশীলতার অভাব, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার অভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের আশপাশে ঘটছে সহিংস আক্রমণ, দানা বাঁধছে উগ্রবাদী মনোভাব।
চারদিকে সহিংস উগ্রবাদের এ আগ্রাসন রোধ করতে চাইলে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা ভীষণ জরুরি। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে উগ্রবাদী আচরণ, সহিংস মনোভাব যাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। আর শিক্ষার্থীরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে সহিংস উগ্রবাদবিরোধী মনোভাব গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে, জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক পরিচালক দিলারা আফরোজ খান বলেন, ‘মতামতের ভিন্নতা, আচারের ভিন্নতা, আদর্শের ভিন্নতা—এসব মেনে নিতে না পারলেই সাধারণত সহিংস ঘটনাগুলোর সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু এ পৃথিবীর, এমনকি সমগ্র মানবজাতির সৌন্দর্য নিহিত আমাদের ভিন্নতায়, বৈচিত্র্যময়তায়—ডাইভার্সিটি ইজ বিউটিফুল! আমাদের শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু, কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই পারস্পরিক ভিন্নতার স্বাভাবিকত্বের জায়গাটা তাদের কাছে স্পষ্ট হবে, বাড়বে উদারতা, সহনশীলতা।’
শিক্ষকদের করণীয়
প্রতিটি মানুষেরই যে নিজের মতামত প্রকাশের, নিজের মতো করে চলার অধিকার রয়েছে, সামাজিক-সাম্প্রদায়িক-ব্যক্তিগত অবস্থানের ভিন্নতার কারণে যে বিভিন্ন বিষয়ে একে অন্যের মঙ্গে মতামত ও আদর্শের অমিল হওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, তা শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন যেকোনো বিষয় নিয়ে মুক্ত ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, তেমনি একে অন্যের মতামত, আদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চর্চাও শুরু করতে হবে। কেউ যেন কারও আর্থিক অবস্থা, সাম্প্রদায়িক রীতি, আদর্শ বা বিশ্বাসকে হেয় করে মানসিক যন্ত্রণা না দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এমন আচরণ যেমন অমানবিক ও অশোভন, তেমনি সমাজের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ।
সামাজিক, আর্থিক, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে সবার প্রতি বৈষম্যহীন আচরণ করতে হবে এবং শিক্ষার্থীরাও যাতে তা করে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যের বন্ধন প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের বিভিন্ন দলগত কাজে উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠা সহজেই সম্ভব। দলগত কাজের গুরুত্ব নিয়ে দিলারা আফরোজ খান বলেন, ‘ধৈর্য ধরে অন্যের মতামত শোনার, তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করার যে চর্চা, সেটা দলগত কাজের মাধ্যমেই সম্ভব। এ মূল্যবোধগুলোর যথাযথ বিকাশের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কমিউনিটি সার্ভিসের ব্যবস্থা করা উচিত। যেমন শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে আমরা পথশিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারি। সপ্তাহে এক দিন তারা ক্যাম্পাস পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিতে পারে। সমাজের প্রত্যেকের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার এ অভ্যাস থেকেই তারা বুঝতে পারবে ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শ মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে পারে না।’
বই পড়া, খেলাধুলাসহ অন্যান্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। কারণ, মনোজগতের বিকাশের জন্য এসবের কোনো বিকল্প নেই। আর মনোজগতের যথাযথ বিকাশ থেকেই মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, উদারতার চর্চা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে দিলারা আফরোজ খান বলেন, ‘ক্লাসের বাইরেও বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম, আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা শিক্ষকদের সংস্পর্শে থেকে, নিজের বন্ধুদের গ্রুপটির বাইরেও অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিশে জীবনের সুন্দর দিকগুলো উপভোগ করতে শেখে।’
কোনো শিক্ষার্থী সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে দিলারা আফরোজ খান বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী যেন কোনো অবস্থায় নিজেকে একা না মনে করে, এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। যখন হতাশা, ব্যর্থতা তাকে ঘিরে ধরেছে, যখন সহিংসতার মধ্যেই সে সমাধান খুঁজে পাচ্ছে, আমরা তাকে দূরে ঠেলে দেব না, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সেন্টার থাকা উচিত, যেখান থেকে সঠিক প্রক্রিয়ায় তাকে সংশোধন করা সম্ভব।’
শিক্ষার্থীদের করণীয়
এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই কিছু নিজস্বতা রয়েছে। আমরা একেকজন একেক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমাদের ভাবনাচিন্তায় পার্থক্য থাকা তাই পুরোপুরিই স্বাভাবিক। তাই তোমার মতামত, আদর্শ বা বিশ্বাসের সঙ্গে না মিললেই যে তোমার বন্ধুর মতামত, আদর্শ বা বিশ্বাস ভুল, তা নয়।
মতামতের ভিন্নতার ব্যাপারটি সহজ ও সুন্দরভাবে নিতে শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চর্চা শুরু করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। অন্যের ধর্ম, পরিবার, সম্প্রদায়, রীতিনীতি, বিশ্বাস, জীবনাচরণ নিয়ে খেলাচ্ছলে বিদ্রূপ করা থেকেও তাই আমাদের বিরত থাকা উচিত।
ঝগড়া, অন্যকে দোষারোপ, অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে আলোচনা ও গঠনমূলক বিতর্কের পরিবেশ তৈরি করো। এর মাধ্যমে তোমার আশপাশের বৈচিত্র্য সম্পর্কে যেমন তুমি জানতে পারবে, তেমনি দূর হবে তোমার সংকীর্ণ মনোভাব।
নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সম্মেলন, স্বেচ্ছাসেবামূলক ও সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে যতটা সম্ভব অংশগ্রহণ করো। নিজের পরিচিত গণ্ডির বাইরে এসে বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ সম্পর্কে তুমি সহজেই জানতে পারবে। যেকোনো পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চর্চাও এখান থেকে শুরু করা সম্ভব।
যদি তোমার পরিচিত কেউ বা কোনো বন্ধুকে সহিংস উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যেতে দেখ, তবে দ্রুত শিক্ষক, মা–বাবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাও। মনে রাখবে, যেকোনো সহিংস কর্মকাণ্ড আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী অবৈধ এবং তা তোমার নিজের দেশ ও সমাজের জন্যই ক্ষতি ডেকে আনবে।
বর্তমান পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ সহিংসতার শিকার হচ্ছে। উগ্রবাদের উত্থানের ফলে প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে একটি সমাজে বসবাস করতে হলে ধর্ম, সংস্কৃতি, আদর্শ বা মতামতের ভিন্নতা থাকবেই। যার যার ধর্ম অনুযায়ী ইবাদত বা উপাসনা, উৎসব বা পার্বণের ভিন্নতা থাকাটাও স্বাভাবিক। যার যার ধর্ম তার তার, যার যার সংস্কৃতি তার তার। উৎসব আমাদের সবার। তাই, যে সহিংসতা, যে উগ্রবাদ সমাজের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে, তা প্রতিহত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমাদের সবার উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা ভুলে গিয়ে উদার হওয়া। কারণ, সহিংসতা ও উগ্রবাদকে রুখে দাঁড়াতে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির কোনো বিকল্প নেই।