লিলিপুটের গল্প

আমার তখন এসএসসি পরীক্ষা চলে। গণিত পরীক্ষার পর ছিল আইসিটি পরীক্ষা। পড়তে পড়তে মাথা নষ্ট! আর ঠিক সে রাতেই বাসায় ঢুকল আমাদের কুকুর লিলিপুট। দেখতে এইটুকুন বলে এই নাম দিয়েছিল ভাবি। পাহাড়ের দেশ সাজেক থেকে ওকে নিয়ে আসে ভাইয়া-ভাবি। বইপত্র ঘেঁটে জানা গেল লিলিপুটের বংশধরেরা মেক্সিকান চিহুয়াহুয়া প্রজাতির। এইটুকু একটা কুকুর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, ওই চোখে কোনো অভিযোগ নেই, চাহিদা নেই, লোভ নেই—আছে শুধু কৌতূহল। দুনিয়ার তাবৎ জিনিসের প্রতি কৌতূহল তার। যেখানেই যায়, যাকেই দেখে আগে তার নাক হাজির হয়ে যায়। শুঁকে শুঁকে দেখার চেষ্টা করে পরিচিত কেউ কি না। হলে আদরের স্বীকৃতিস্বরূপ হাত–পা চেটে দেয়, আর অপরিচিত হলেই ঘেউ!

প্রাণশক্তিতে ভরপুর লিলিপুট। ভেড়ার মতন লোম, সাদার মধ্যে কয়েক জায়গায় যেন কালো ছোপ লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। আকারে ছোট হলে কী হবে, ঘরের ভেতরে ব্যাপক দাপট তার। লিলিপুট আসার পর আমার বিড়াল দুটো ভয়ে তিন-চার দিন ঠিকমতো খেতে–ঘুমাতে পারেনি। মানুষের নাকি অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না, এই প্রথম দেখলাম ভয়ে মাটিতে পা পড়ছে না বিড়ালগুলোর—সারাক্ষণ আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব করে করে দিন পার করে দিচ্ছিল ওরা। লিলিপুটকে যে বাক্সে আনা হয়েছিল, সেটাকে ঘিরে খুব আগ্রহ ছিল বিড়ালগুলোর। লিলিপুট বাক্স থেকে বের হলেই বিড়ালগুলোর ভোঁ–দৌড়। তবে নতুন মানুষ পেয়ে বিরাট খুশি লিলিপুট। কিছুদিন পর বিড়ালগুলোরও বন্ধুত্ব্ হয়ে গেল ওর সঙ্গে। বিড়াল-কুকুর একসঙ্গে খেলে। ওদের খেলা দেখার জন্য বাসার তিনটি কচ্ছপকে নামিয়ে দিই মেঝেতে। খেলা দেখে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে কচ্ছপগুলো।

শুধু ঘরে থাকলে হবে? তাই লিলিপুটকে নিয়মিত আমাদের কলোনির মাঠে নিয়ে যাই। ওর জন্য একটা বেল্ট কিনে এনেছে ভাবি। বেল্ট গলায় পরালেই অশান্ত হয়ে ওঠে লিলিপুট। ঠিকই বোঝে যে এখনই মাঠে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে! গলায় বেল্ট পরাতেই সোজা দরজার দিকে ছুট। দরজা খোলা পেলেই লিফটের গেট ধরে দাঁড়িয়ে যায়।

প্রথমে ভেবেছিলাম নিচে নামালে লিলিপুটের রাগী চোখ দেখে এলাকাবাসী স্তব্ধ হয়ে যাবে। ঘটনা ঘটল পুরো উল্টো—কলোনির সব বাচ্চা খেলা ফেলে দৌড়ে এল ওর দিকে। একটুও ভড়কাল না লিলিপুট, সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দৌড় শুরু করল মাঠে। এক মিনিটের মধ্যেই লিলিপুট সবার বন্ধু! লিলিপুট যেদিকে দৌড়ায়, সেদিকে দৌড়ায় বাচ্চাকাচ্চারা। চারদিকে চিৎকার ‘লিলিপুট, লিলিপুট’। এর মধ্যে একজন তার লেজে হাত দিতেই সে ঘুরে বলল, ‘ঘাউ।’ ব্যস আর যায় কোথায়, কেউ তার গায়ে হাত দেয় না, সামনে সামনে থাকে, লিলিপুট পুরো মাঠ চক্কর দেয় আর এক চোখে সবাইকে চোখে চোখে রাখে। মাত্র এক দিনের মধ্যেই আমাদের লিলিপুট সেলিব্রিটি হয়ে গেল—এলাকার অন্যান্য নেড়িকুকুর মন খারাপ করে দূর থেকে লিলিপুটের রাজত্ব দেখে। একবার একটা কুকুর সামনে এসে কিছু একটা বলতে গেল, লিলিপুট তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘ঘাউ’, ব্যস আর যায় কোথায়! সেই বেচারা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল!

এখন লিলিপুট অনেক বড় হয়ে গেছে। ছোট্ট বাক্সে এখন আর তার জায়গা হয় না। টেবিলের তলায় নিজের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছে সে। ঘরের কোথাও খুঁজে না পেলেও টেবিলের তলায় উঁকি দিলেই দেখা যায় সে চার হাত-পা ছড়িয়ে হাঁ করে ঘুমাচ্ছে! কেউ কলবেল বাজালেই ঘরের যেখানেই থাকুক না কেন, দৌড়ে যায়, গেট ধরে তাকিয়ে থাকে—গেটের নিচ দিয়ে নাক নিয়ে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। পরিচিত হলে চেটেপুটে একাকার, আর অপরিচিত হলেই, ‘ঘাউ!’

একবার আমাদের বাসায় গ্যাসের সিলিন্ডারের কাজে একজন লোক এল। লিলিপুট ভাবল এই ব্যাটা রান্নাঘরে কী করে—চোর বুঝি! ওমনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার, পারে তো লাফ দিয়ে তার কলার কামড়ে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যাটা, না বলে ঘরে ঢুকছিস কেন! আম্মু অনেক কষ্টে তাকে ঠান্ডা করে, একটা মুরগির রান নাকের সামনে দিয়ে ওকে এক কোনায় বসায়, লিলিপুট মুখের ভেতরে মুরগির রান নিয়ে আরেক চোখে আড়চোখে সিলিন্ডার মেকানিকের দিকে নজর রাখে!

দিনে দিনে ওর খ্যাতি পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেল, সবাই জানে এই বাসায় লিলিপুট আছে, ময়লাওয়ালা এসে আস্তে করে কলবেল চাপে, পেপারওয়ালা গেটের নিচ দিয়ে পেপার অর্ধেক ঢোকালেই লিলিপুট বলে, ‘ঘাউ’, সে সঙ্গে সঙ্গে পুরো পেপার ঠেলে দিয়ে পগার পার। ছোট বাচ্চাকাচ্চা আমাদের ঘরে এসে সারাক্ষণ হাউকাউ করত, তাদের এখন লিলিপুট এক চোখে দেখে রাখে, ফলে এখন আর আগের মতো ঘর নষ্ট করে না পোলাপানগুলো।

মাঝেমধ্যে খাবার নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু করে লিলিপুট আর বিড়ালগুলো। সেটা থামানোর জন্য আম্মু এসে দেয় এক ধমক। ধমক খেয়েই বিড়াল আলমারিতে, লিলিপুট টেবিলের তলায়। মাঝেমধ্যে সে বিড়ালের খাবার ছিনতাই করে নিয়ে আসে। বেচারা বিড়ালগুলো অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে। তবে সুযোগ পেলেই বিড়ালগুলো প্রতিশোধ নিতে ভোলে না, আস্তে করে লিলিপুটের মাথায় থাবড়া মেরেই আলমারির ওপরে উঠে বসে থাকে। বেচারা লিলিপুট অত ওপরে তো আর উঠতে পারে না, তাই নিচ থেকেই বলে, ‘ঘাউ’। লিলিপুটের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো বিড়ালের হাতে মার খাওয়া!

লিলিপুটের বয়স এখন প্রায় ৯ মাস, তাকে টিকা দেওয়া হয়েছে। যাতে তার থেকে কোনো রোগ না ছড়ায়। আমাদের ছোট্ট লিলিপুট এখন অনেক বড়, এখনো সে লাল বেল্ট দেখলে বাইরে যাওয়ার জন্য উথালপাথাল, লাফালাফি করে, এখনো গোসল করানোর সময় এক্কেবারে চুপ করে গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে, এখনো কলবেল বাজলে সবার আগে দৌড়ে ছুটে যায় গেটে। তোমরা যদি কখনো আমার বাসায় লিলিপুটকে দেখতে আসো, তাহলে আগে থেকে জানিয়ে রাখবে, আমি লিলিপুটকে বলে রাখব তোমাদের কথা। ও খুব লক্ষ্মী, কিছু বললে ঘাড় কাত করে, কান খাড়া করে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। কথা তার মনমতো হলে হফ হফ করে সামনের দুই পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে, আর পছন্দসই কিছু না হলেই বলে, ‘ঘাউ!’

সময় করে একদিন চলে এসো আমাদের বাসায়, আর আসার সময় সঙ্গে করে অনেক অনেক আদর নিয়ে এসো—আমাদের লিলিপুট আদর ভীষণ পছন্দ করে।