বিকেল হলেই ব্যাট-বল নিয়ে মেয়েদের যেতে দেখা যায় রংপুর স্টেডিয়ামের দিকে। ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমির’র ছাত্রী তারা। মেয়েদের বিনা মূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই একাডেমিতে। ভবিষ্যতের নারী ক্রিকেটার গড়ার লক্ষ্যে এই একাডেমি পরিচালনা করছেন সাবেক ক্রিকেটার আরিফা জাহান।
বেলা তিনটায় রংপুর স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা গেল এক পাশে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত ৪০-৫০ জন মেয়ে। শুক্রবার ছাড়া ছয় দিনই বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলে এখানে। প্রশিক্ষণার্থী এসএসসি পরীক্ষার্থী মোহসিনা জানাল, ‘এক বছর ধরে ক্রিকেট খেলার অনুশীলন করে আসছি। এই প্রশিক্ষণে কোনো টাকা দিতে হয় না। বিনা পয়সায় চলে প্রশিক্ষণ।’
‘নিজের খরচে প্রতিদিন এখানে এসে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছি। অক্লান্ত পরিশ্রম করে বীথি (আরিফা) আপা আমাদের নানা ধরনের কৌশল শেখান। শুধু রংপুরের মাঠে নয়, ঢাকার মাঠ কিংবা জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন আছে।’—দৃঢ়প্রত্যয় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদার কণ্ঠে।
কোনো কিছুতে সফলতা আনতে গেলে কষ্ট তো করতেই হবে। সেই ছোটবেলা থেকে কষ্ট করছি। নারী ক্রিকেটে এই অঞ্চল থেকে যেন প্রতিবছর জাতীয় দলে কিংবা ঢাকার ক্রিকেট লিগে চার-পাঁচজন অংশ নিতে পারে, এই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি।
জাতীয় দলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল আরিফারও। খেলেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট। ঢাকার ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, কলাবাগানসহ বিভিন্ন ক্লাবের ওপেনিং ব্যাটার আরিফাকে ইনিংস থামাতে হয় হঠাৎই। ২০১৭ সালে অসুস্থতার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে ক্রিকেট থেকে বিদায় জানান আরিফা। ফিরে আসেন রংপুরে। তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী।
কিন্তু ক্রিকেট তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাই ক্রিকেট তাঁকে ছাড়লেও তিনি ক্রিকেট ছাড়েননি। ভাবলেন, তাঁর যে স্বপ্ন থেমে গেছে, সেই স্বপ্ন দেখাবেন রংপুরের মেয়েদের। গড়ে তুলবেন নারী ক্রিকেট একাডেমি। তা–ও আবার বিনা মূল্যে। কিন্তু রংপুরে ক্রিকেট শিখতে মেয়েরা আসবে কোথা থেকে? তাই ক্রিকেট খেলতে আগ্রহী মেয়েদের সন্ধানে আরিফা ছুটে চললেন বিভিন্ন স্কুলে। ২০১৯ সালে ৩০ জন মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলেন। ২৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে শুরু হলো ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’র যাত্রা। মেয়েদের জন্য বিনা মূল্যে ক্রিকেট শেখার প্রথম একাডেমি এটাই।
নূরপুর এলাকায় মা-বাবা-ভাইকে নিয়ে থাকেন আরিফা। বাবা মফিজুল ইসলাম একটি তেলপাম্পে চাকরি করতেন। সেই চাকরিও চলে গেছে। মা মাজেদা বেগম গৃহিণী। বড় ভাই অটোরিকশাচালক। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ছে বিনা মূল্যের ইউসেফ স্কুলে। আরিফা বোঝেন অভাবের কষ্ট। তিনি জানেন, টাকা দিয়ে ক্রিকেট শেখার মতো অবস্থা নেই অনেক মেয়েরই। কিন্তু নিজের স্বপ্নটা শত শত মেয়ের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আরিফা। অভাব–অনটনের সংসারে কষ্টের সঙ্গে লড়ে বড় হয়েছেন। নিজের পড়ালেখার পর্যাপ্ত বইখাতাও ছিল না। বন্ধুবান্ধবসহ অন্যের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েছেন। সেই আরিফা এখন পড়ছেন সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের মানবিক বিভাগে, ডিগ্রি শ্রেণির শেষ বর্ষে।
এইচএসসি পাস করার পর আরিফার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। বিয়ের জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন। বরের অপেক্ষায় সেজেগুজে বসে ছিলেন আরিফা। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হওয়ার পর তাঁর কানে এল এই বিয়ে হচ্ছে না। পরিবারের নানা কারণে বর পিছু হটে গেছেন বলে জানা যায়।
বিয়ে ভাঙার পর ক্রিকেটটাকেই নিয়েই আছেন আরিফা। পরিবার থেকে প্রথমে বাধা ছিল। কিন্তু সবাইকে বুঝিয়েছেন, মেধাবী ও অসচ্ছল মেয়েদের ক্রিকেট শেখাতেই তাঁর এই উদ্যোগ। আরিফার হাত ধরে এখন প্রায় ২৫০ জন মেয়ে উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি থেকে ক্রিকেটের হাতেখড়ি নিচ্ছে। তাদের সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করছে এই একাডেমি।
শুধু রংপুর নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় নারীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিতে ছুটে যান আরিফা। প্রশিক্ষণ বাবদ কিছু সম্মাননাও পান সেখান থেকে। সঙ্গে যোগ হয় আউটসোর্সিং করে পাওয়া টাকা। আরিফা ভেবেছিলেন একটা স্কুটি কিনবেন। যাতায়াতের সুবিধা হবে তাতে। প্রায় ৮০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেনও। কিন্তু এই স্বপ্নটা ভেঙে দিল করোনাভাইরাস। দুস্থ–অসহায় পরিবারের সাহায্যার্থে টাকা ব্যয় করেছেন আরিফা। আর একাডেমির মেয়েদের খেলার জন্য ব্যাট-বল, গ্লাভস, প্যাড ও জার্সিও কিনতে হয়েছে। কখনো কখনো কারও রিকশাভাড়াও দিয়েছেন।
আরিফা বলেন, ‘কোনো কিছুতে সফলতা আনতে গেলে কষ্ট তো করতেই হবে। সেই ছোটবেলা থেকে কষ্ট করছি। নারী ক্রিকেটে এই অঞ্চল থেকে যেন প্রতিবছর জাতীয় দলে কিংবা ঢাকার ক্রিকেট লিগে চার-পাঁচজন অংশ নিতে পারে, এই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি।’
একাডেমি নিয়ে আরিফার স্বপ্ন অনেক বড়। তিনি চান মেয়েরা পিছিয়ে না থাকুক। এগিয়ে যাক ক্রিকেটসহ সব ধরনের খেলাধুলায়। মেয়েরা বাল্যবিবাহের কবল থেকে বাঁচুক। তবে সে জন্য আরিফাকে লড়তে হবে আরও।
‘এখনো একাডেমির নিজস্ব জায়গা নেই। প্রশিক্ষণার্থীদের মুখে নাশতাও তুলে দিতে পারি না। পারিনি একাডেমির নিজস্ব ড্রেস কিনতে। এরপরও একাডেমির কাজ চালিয়ে যাব।’
গোটা রংপুর এখন স্বপ্ন দেখছে ভবিষ্যতের সালমা-জাহানারা আসবে আরিফার একাডেমি থেকেই।