৬৬ মিলিয়ন বছর আগের কথা। টাইম মেশিনে করে তুমি যদি কোনোভাবে ওই সময়ের পৃথিবীতে হাজির হয়ে যেতে, দেখতে অদ্ভুত কিছু প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কারও কারও গায়ে রুক্ষ কাঁটার মতো, লম্বা গলা। চার পায়ে ভর করে ধীরেসুস্থে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাংসাশী এই প্রাণীদের চোখে তুমি যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যাও, তাহলেই সেরেছে! জীবন নিয়ে পালাতে হবে তোমাকে।
কিন্তু হিংস্র এই প্রাণীদের পাশাপাশি একই প্রজাতির নিরীহ প্রাণীও আছে। যারা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে। মসৃণ দেহ। লম্বা গলাটা ধীরে ধীরে কেমন সরু হয়ে এসেছে। পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব করে বেড়ানোর অহংকার নেই একটুও। ডাইনোসর বললেই আমাদের চোখে যে ভয়ংকর প্রাণীর ছবি ভেসে ওঠে, ওরা ছিল মূলত টি-রেক্স। যদিও আমাদের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবে ওদের বেশ খানিকটা পার্থক্য ছিল, কিন্তু ওদের মাংসাশী ও শিকারি স্বভাব আসলে ভয় পাওয়ার মতোই। কিন্তু ওরা ছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রজাতির চমৎকার সব ডাইনোসরও ছিল।
সময় ঘনিয়েছে। টাইম মেশিনের ভেতরে ঢুকে বসো। আমরা এখানে যে কারণে এসেছি, সেটা দেখার জন্য আমাদের চলে যেতে হবে ইউকাটান পেনিনসুলা, মেক্সিকোতে। ভালোভাবে দেখার জন্য আসো, আমাদের টাইম মেশিন ব্যবহার করে সময়টাকে একটু ধীর করে দিই। আকাশের দিকে তাকাও। কী দেখছ?
হ্যাঁ, ওটা দেখলে মনে হবে অগ্নিগোলক। ১৫ কিলোমিটার বা ৯ মাইলের এই অগ্নিগোলকটি আসলে একটি গ্রহাণু। ১০ হাজার হিরোশিমা বোমার শক্তি নিয়ে ছুটে আসছে গ্রহাণুটি। মুহূর্তখানেক পরে এটি যখন পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়বে, প্রবল বিস্ফোরণে এলোমেলো হয়ে যাবে সবকিছু। তাত্ত্বিকভাবে এই আঘাতের পরেও ২৫ কেজির কম ভরের প্রাণীরা বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু স্বয়ং পৃথিবী যখন নরকে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখন আর বাঁচার উপায় কী? এই বিস্ফোরণের ফলে সম্ভবত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও আগুন ধরে যাবে। ধুলাবালু, বিস্ফোরণের অবশেষ, বিভিন্ন পদার্থের চূর্ণ দিয়ে ঢাকা পড়ে যাবে আকাশের নীল। এই ধূসর পর্দা ভেদ করে এমনকি সূর্যের আলোও পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে পারবে না। সব মিলিয়ে এই বিপদ কাটতে কাটতে পুরো পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ডাইনোসরের দল।
আর এই সংঘর্ষের মুহূর্তে এখানে থাকলে আমাদের টাইম মেশিনটাও গুঁড়িয়ে যাবে। কাজেই চলো, আর বসে না থেকে এবার ফেরা যাক!
দুই
আচ্ছা, ডাইনোসররা যদি সেদিন বিলুপ্ত না হয়ে যেত? যদি সেই গ্রহাণুটি পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে চলে যেত কোনো কারণে? কী হতো তাহলে? ডাইনোসররা কি আজও রাজত্ব করত পৃথিবীর বুকে? আর আমরা? কী হতো আমাদের? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। বিজ্ঞানের চোখে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে ইতিহাসের আঁকবাঁক।
প্রথমেই মনে করা যাক, পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ধ্বংসযজ্ঞ কেবল একবারই ঘটেনি। বেশ কয়েকটি এ ধরনের বড় বিপর্যয় হয়েছে। যেমন ১১ মিলিয়ন বছরের মতো এগিয়ে এলেই আরেকটি বড় বিপর্যয়ের দেখা পাব আমরা। সে সময় পৃথিবীর তাপমাত্রা বর্তমান তাপমাত্রা থেকে প্রায় ৮ ডিগ্রির মতো বেড়ে গিয়েছিল। সেটা অবশ্য সে সময়ের পৃথিবীর উদ্ভিদের জন্য খুব একটা সমস্যা ছিল না। রেইনফরেস্ট বেড়ে উঠছিল দারুণভাবে। কিন্তু সমস্যা হলো এই উদ্ভিদগুলোতে জমা শক্তির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। উদ্ভিদভোজী ডাইনোসররা হয়তো এ সময় টিকে যেতে পারত, কিন্তু তাদের আকার অনেকটা ছোট হয়ে যেত বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। খাবারের জন্য প্রাণীর এ ধরনের অভিযোজন আমরা এখনো প্রকৃতিতে দেখতে পাই। নিচের দিকে খাবারের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গেছে বলে মনে করেন জীববিজ্ঞানীরা। সে যেন ওপরের দিকের খাবারগুলো খেতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। আবার উল্টোটাও হয়েছে। পাখিরা আকারে অনেক ছোট হলেও এরা একসময়ের প্রবল পরাক্রমশালী ডাইনোসরেরই বংশধর। ফলে উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরদের আকার ছোট হওয়ার এই ধারণা বাস্তবসম্মত। এদিকে মাংসাশী ডাইনোসররা ভালো বিপদে পড়ে যেত এ সময়। আদৌ এই সময়টা তারা টিকে যেতে পারত কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়েই আছে।
এর ২০ মিলিয়ন বছর পরে পৃথিবী একটা বিশাল ভাঙনের মধ্যে দিয়ে গেছে। এ সময় দক্ষিণ আমেরিকা ও অ্যান্টার্কটিকা ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে। এ সময় এসে ডাইনোসরের দল ভালো সুবিধা পেত। অন্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় তাদের তীক্ষ্ণ দাঁত, নখর এবং দৃষ্টিশক্তি ছিল দারুণ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, টিকে থাকলে ডাইনোসররা এ সময় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত৷ আজকের মানুষের মতোই, আক্ষরিক অর্থেই ওরা হয়তো দখল করে নিত পৃথিবী।
আসলেই এমন হলে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মানুষ আদৌ পৃথিবীতে টিকতে পারত বলে মনে হয় না। এর পেছনে আবারও সেই খাবার এবং বাসস্থানের কথা উঠে আসে। প্রাচীন মানুষ আদৌ কি থাকার জায়গা পেত তখন? পর্যাপ্ত খাবার কি পেত? বন্য প্রাণীদের বনের সীমানায় বেঁধে রেখেছিল মানুষ। তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল। ডাইনোসরের জন্য মানুষ যদি হুমকি হয়ে উঠত, ভাগ বসাত ওদের খাবারে, ডাইনোসররাও কি মানুষের সঙ্গে একই কাজ করত না? তাড়িয়ে বেড়াত না মানুষকে? তাহলে ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষ কি আদৌ মনোযোগ দিতে পারত সভ্যতার উন্নয়নে? এটা একটা বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। এমনিতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মানুষের খুব একটা আশা নেই। কিন্তু মানুষের টিকে যাওয়ার পক্ষেও কিছু যুক্তি আছে।
বাঘ বা সিংহের মতো হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি, ছাগল-ভেড়ার মতো প্রাণীকে মানুষ সযত্নে বশ মানিয়েছে। অন্যান্য প্রাণীকে এভাবে বশ মানিয়ে ব্যবহার করার উদাহরণ প্রকৃতিতে আর কোথাও কি চোখে পড়ে? হ্যাঁ, বনের প্রাণীদের মধ্যেও একটা সম্পর্ক থাকে। থাকে বাস্তুসংস্থান। কিন্তু তাদের এভাবে ব্যবহারের কথা বললে সেটা ডাইনোসরদের মধ্যে ঠিক দেখা যায় না।
তারপর পৃথিবীতে এসেছে আইস-এইজ বা বরফ যুগ। সেটা মোটামুটি ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন বছর আগের কথা। অনেক প্রাণীই এই প্রচণ্ড শীত সহ্য করতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কথা হলো, ডাইনোসররা কি সেটা পারত? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ডাইনোসরের অভিযোজন ক্ষমতার কথা বিবেচনা করলে কিছু প্রজাতির ডাইনোসর হয়তো টিকে যেতে পারত।
তিন
এখন প্রশ্ন আসে, এসব বাধা পেরিয়ে ডাইনোসর যদি বর্তমান পৃথিবীতে টিকেও যেত, কেমন হতো তাদের অবস্থা? এখানে, তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যের কথা ভাবা যায়। এক. ডাইনোসরের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকা অসহায় মানুষ আজকের এই সভ্য জাতিতে পরিণত হতে পারত না। এই সম্ভাবনার কথা আগেও বলেছি। এ রকম হলে পৃথিবীটা মূলত ডাইনোসরের দখলেই থাকত।
কিন্তু যতই বুদ্ধিমান হোক, ডাইনোসর সেই চারপায়ে চরে বেড়ানো প্রাণীই ছিল। আর মানুষ মাথা তুলে তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। এদিক থেকে ভাবলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি উঁকি দিয়ে যায়। মানুষ হয়তো সভ্যতার পথে কিছুটা এগিয়ে যেতই। আর মানুষের ইতিহাস ডাইনোসরের চেয়ে অনেক নির্মম। অস্ট্রেলিয়ার দিকে মানুষ যখন প্রথম পা রাখে, তার হাজার বছরের মধ্যে সেখানকার দশ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মানুষের শিকার, জায়গা ও খাবারের দখল এবং আত্মরক্ষার জন্য বিপুল পরিমাণ ডাইনোসর মারা পড়ত। তাতে প্রজাতিটি গ্রহাণুর হাত থেকে বাঁচলেও মানুষের হাত থেকে আদৌ বাঁচত বলে মনে হয় না।
আর তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো মানুষ আর ডাইনোসরের সহাবস্থান। হয়তো সময়ের সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে ওঠা ডাইনোসর মানুষের সঙ্গেই সহাবস্থান করত। আজকের পাখিরা বরং এই চিত্রটির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এ রকম হলে হয়তোবা হাতি-ঘোড়ার পিঠে না চড়ে ডাইনোসরের পিঠে চড়ে বিভিন্ন দেশের সম্রাট যুদ্ধে যেতেন। প্রশিক্ষিত শিকারি ডাইনোসর ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে ফেলার চেষ্টা করতেন। কে জানে!
এসব কেবলই বিজ্ঞানীদের ধারণা। আসলে জীবন এত অনিশ্চিত একটা ব্যাপার যে এত বিশাল সময়ে কোনো জীব কীভাবে অভিযোজিত হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই। কিন্তু একটি প্রাণের আধিপত্যের সময়ে আরেকটি একই রকম বা আরও বেশি বুদ্ধিমান প্রাণী গড়ে ওঠার উদাহরণ প্রকৃতিতে খুব একটা দেখা যায় না।
সেই হিসাবে মনে হয়, মানুষের পৃথিবীতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াই হয়তো ছিল ডাইনোসরের পরম নিয়তি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, হোয়াট ইফ; স্যাপিয়েন্স, ইউভাল নোয়াহ হারারি