রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব রসিক মানুষ ছিলেন। কাছের মানুষের সঙ্গে মজার মজার সব ঘটনা আছে। এখানে থাকল তাঁকে ঘিরে পাঁচটি মজার ঘটনা।
ঘরকুনো নিরামিষাশী
১৯৩১ সাল। সাহিত্যিক লীলা মজুমদার তখন শান্তিনিকেতনে পড়াতে গেছেন। প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে তিনি যেতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। লীলাকে দেখেই কবি সারা দিনের কাজকর্মের কথা জিজ্ঞেস করতেন। করতেন নানা রকম রসের গল্প। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ইংরেজি ক্লাসে কী করালে?’ লীলা উত্তর দিলেন, শিক্ষার্থীদের গরুর রচনা লিখতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আবার প্রশ্ন, ‘তা, তাঁরা কী লিখল?’ লীলার উত্তর, ‘একজন লিখল, দ্য কাউ ইজ আ ডমিস্টিকেটেড ভেজেটেরিয়ান!’ (গরু ঘরকুনো নিরামিষাশী)
শুনেই কবি সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘অ্যাঁ! বলো কী! ওটা যে আমার বর্ণনা। আমিও তো ডমিস্টিকেটেড ভেজেটেরিয়ান!’
আসলে ৭০ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ তখন নিজের ঘরেই বেশি সময় কাটাতেন। আর নিরামিষও খেতেন।
অশোক নয়, গাবগাছ
কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রদের একজন। কবির সান্নিধ্যেই থাকতেন। একদিনের কথা। শান্তিনিকেতনের কুয়োর ধারে একটি গাবগাছ ছিল। সেদিন সেখান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথ বিশী যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ গাবগাছের কাছে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘জানিস, একসময় এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এটা অশোক গাছ। তারপরে যখন বড় হলো দেখি, অশোক নয়, গাব গাছ।’
এরপর প্রমথনাথের দিকে তাকিয়ে কবি বললেন, ‘তোকেও অশোক গাছ বলে লাগিয়েছি, বোধ করি গাব গাছ।’
চেয়ারটা সজীব তো?
একদিন এক ভক্তের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে গেছেন। বসার জন্য তাঁকে চেয়ার দেওয়া হলো। চেয়ার দেখে কবি ভক্তকে বললেন, ‘চেয়ারটা বেশ সুন্দর। তা চেয়ারটা সজীব তো?’
ভক্ত কিছুতেই রবীন্দ্রনাথের কথার মানে বুঝে উঠতে পারছিল না। হাঁ করে তাকিয়ে রইল কবির মুখের দিকে।
ভক্তের অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথই বললেন, ‘বুঝতে পারনি বুঝি? আমি জিজ্ঞেস করছি, চেয়ারটা সজীব কি না, মানে এতে ছারপোকা আছে কি না।’
কানাই নয়, একেবারে সানাই
সাহিত্যিক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ের খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক। প্রবেশিকা পরীক্ষা (এখনকার এসএসসি) পাস করে তিনি গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে পড়তে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য বড় ভাই বনফুল একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।
তো অরবিন্দ শান্তিনিকেতনে এলেন। এসেই শুনলেন রবীন্দ্রনাথ কানে কম শোনেন। কথা বলার সময় একটু জোরে কথা বলতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে চিঠিটি দিলেন অরবিন্দ। চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’
উত্তরে অরবিন্দ চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘না, আমি অরবিন্দ।’
কবি এবার হেসে বললেন, ‘না, কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!’
উদ্ভট ছাতু
রবীন্দ্রনাথ খাবারদাবার নিয়ে খুব শৌখিন ছিলেন। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশমতো একবার সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী ছাতু বানাচ্ছিলেন। যব পাওয়া গেল না, অগত্যা মুড়ির ছাতুর তৈরি করতে হলো। রবীন্দ্রনাথ সেই মুড়ির ছাতুতেই একের পর এক জিনিস মেশাতে বললেন।
মারমালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন—কিনা পড়ল ছাতুতে? সব মাখা হলো আধা ঘণ্টা ধরে। মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, ‘রসুনটাই বা বাদ যায় কেন? একটা পেঁয়াজের রসও থাকুক না!’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বটে, ঠাট্টা? খেয়ে দেখো।’
সন্ধ্যায় বসার ঘরে আসর বসল। প্লেটে প্লেটে দেওয়া হলো ছাতু। মৈত্রেয়ী দেবীর দিকে কবি তাকিয়ে আছেন। মুখে তোলা মাত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রকম?’
খেতে তেমন ভালো না লাগলেও চক্ষুলজ্জায় মৈত্রেয়ী বললেন, ‘খুব চমৎকার, এ তো রোজ খেলেই হয়!’