রাগী চেহারা, গম্ভীর মুখ, শক্ত চোয়াল, সংসারের ভাগ্যের চাকার ঘানি টানা মানুষটার নাম বাবা। পরম স্নেহ, মায়া, মমতা, শাসন, নির্ভরতার পরম আশ্রয় তিনি। প্রতিবছর জুনের তৃতীয় রোববার এলেই পুরো পৃথিবীজুড়ে জানান দেয় পরিশ্রমী, চাপা কষ্টের আড়ালে হেসে যাওয়া, নিজের স্বপ্ন হত্যা করে পরিবারের স্বপ্নকে আগলে রাখার এক শ্রেষ্ঠ মানুষ ‘বাবা’র কথা।
ছেলেবেলা থেকেই বাবাকে তেমন করে কাছে পাওয়া হয়নি। ভাগ্যের চাকাকে উজ্জ্বল করতেই বাবা পাড়ি জমায় প্রবাসে। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও বাবার ভালোবাসার একবিন্দু পরিমাণও কমতি লক্ষ করিনি। শৈশবে পৃথিবীতে দেশ হিসেবে দুটো জানতাম। একটা আমার বাংলাদেশ, একটা বাবা যেখানে পাড়ি জমিয়েছে ‘বিদেশ’। এখন বড় হয়ে পৃথিবীতে দেখি অনেক দেশ, কিন্তু বাবার সেই বিদেশ নামক শব্দটির অনুভূতি এখনো হৃদয়ে জানান দেয়।
সময়টা ২০০৬, আমাদের এলাকায় তখন মুঠোফোন তেমন একটা আসেনি। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যমে ছিল ডাকযোগে চিঠি। আমরা তিন ভাইবোন চিঠি কীভাবে লিখতে হয় জানতাম না। লিখতেন মা। আমাদের নামেই বেশি লিখতেন। পরম যত্নে ভালোবাসার সাদা খামে ভরে দিতেন মায়ের হাতের লেখা চিঠি।
প্রিয়তম,
কেমন আছ? আমরা বাসার সবাই ভালো আছি। নিজের যত্ন নিয়ো। সাবধানে কাজ কোরো। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি,
তোমার আদরের পরিবার।
ডাক হরকরার কাছে চিঠি দিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হতো মাসের পর মাস৷ বাবার চিঠি কবে আসবে সেই অপেক্ষা করতাম। অপেক্ষার পালা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতো। মাস পেরিয়ে যেত, আমাদের অপেক্ষা যেন মৃত্যুর সমান যন্ত্রণা নিয়ে আসত। বাবা চিঠি পেয়ে উত্তর দিতেন মাস দুই পর। কতটা আগ্রহ আর ভালোবাসা নিয়ে আমরা হারিকেনের কিংবা কুপির আলোয় চিঠি পড়তাম। দেখতাম, দরজা বন্ধ করে মাঝেমধ্যেই মা বাবার চিঠি বুকে নিয়ে কাঁদত।
ঠিক ওই শৈশবে, আকাশে অ্যারোপ্লেন দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মাকে বলতাম, উড়োজাহাজ দিয়ে বাবা আসছে। মা–ও তখন খুশি করার জন্য বলত, হ্যাঁ, তোর বাবা আসছে। সেই শুরু, শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই অ্যারোপ্লেন দেখলে বলতাম, আমার বাবা আসতেছে বিদেশ থেকে।
শৈশবের স্মৃতিগুলো পুরোটা ছিল বাবাময়।
কিন্তু আজ আধুনিকতার যুগে, বিজ্ঞানের যুগে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও নিমেষেই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, ভালোবাসা, আগ্রহ, আর উদ্দীপনা যেন দিন দিন কমতি করছি। এখন আর মা হারিকেনের আলোয় চিঠি লেখে না, চিঠির অপেক্ষায় আমরাও কাতর হই না, মা–ও কাঁদে না, উড়োজাহাজ দেখলে বন্ধুদের বলি না বাবা বিদেশ থেকে আসছে। তবে ভালোবাসা টের পাওয়া যায়।
এই মহামারি করোনায়ও বাবা প্রবাসে থেকে দিনরাত আমাদের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত। তাই তো দিন শেষে বলা যায়, দিন শেষে জানানো যায়, তুমি দূরে অন্য ভূমিতে।
ভালোবাসি প্রতি মুহূর্তে, বাবা।