‘প্রতিদিনই তো মাছ খাই। আজ কেন খাব না, মা?’
‘কেন মেয়েটাকে মাছ খেতে দিচ্ছ না?’
‘মেয়েদের সবকিছু পুরুষদের জানতে হয় না।’
সভাকক্ষজুড়ে নেমে এল দীর্ঘশ্বাস। কিশোর আলোর সভাকক্ষে তখন মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটিকা ভাঙো কুসংস্কারের জাল। পিরিয়ডের সময়ে রিতা নামের এক কিশোরীকে তার মা স্কুলে যেতে দিচ্ছেন না। বারণ করেছেন মাছ খেতে। এমনকি রিতা এবং তার বাবা-ভাইয়ের মধ্যে তুলে দিয়েছেন ‘মেয়েদের ব্যাপার’ নামের দেয়াল। রিতার গল্প তুলে ধরতে নাট্যকর্মীর ভূমিকায় রয়েছে ১২ জন কিশোরী। ওরা সবাই রূপগঞ্জের চনপাড়ার বাসিন্দা। জায়গাটি নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। প্রজনন স্বাস্থ্য এবং করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ওরা নিজেদের এলাকায় একটি গবেষণা জরিপ চালিয়েছে। এ কাজে ওদের সহযোগিতা করেছে একশনএইড বাংলাদেশ।
গবেষণা জরিপে পাওয়া ফলাফল নিয়ে মতবিনিময় করতে ২১ ডিসেম্বর ১২ জন কিশোরী এসেছিল কিআ সভাকক্ষে। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিল কিশোর আলোর ১১ জন নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক। ভাঙো কুসংস্কারের জাল নাটিকাটি লেখা হয়েছে চনপাড়ার ৩০ জন কিশোরী, ৩২ জন নারী, ৯ জন পুরুষ এবং ৬ জন কিশোরের ওপর চালানো এক গবেষণা জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। নাটিকার একের পর এক সংলাপে পিরিয়ড নিয়ে জনসাধারণের ভ্রান্ত বিশ্বাস যখন ফুটে উঠছিল, তখন সহজেই টের পাওয়া যাচ্ছিল উপস্থিত সবার বিষাদ। তবে নাটিকার শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, রিতার শিক্ষিকা ভুল ধারণা এবং কুসংস্কারগুলোর অযৌক্তিকতা দারুণভাবে তুলে ধরছেন। তাঁর কথা শুনে রিতার মা অনুধাবন করতে পারেন এবং সচেতন হয়ে ওঠেন অন্যান্য করণীয় সম্পর্কেও।
নাটিকা শেষে শুরু হয় মতবিনিময় পর্ব। কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবকেরা জানায় নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেন্সট্রুয়েশন-বান্ধব শৌচাগার, পর্যাপ্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া গেলে কতটা সুবিধা হতো, সে কথা আলোচিত হয় গুরুত্বের সঙ্গে। পিরিয়ড কী, কেন হয়, করণীয়—বিশদ তথ্য পাওয়া উচিত একদম ছোটবেলা থেকেই, পাওয়া গেল এমন অভিমত। উঠল পাঠ্যবই সংস্কারের দাবি।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পর পর তা পরিবর্তন করার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভুললে চলবে না। কেননা, পরিচ্ছন্নতার অভাবে হতে পারে ইনফেকশন। এমনকি সেটি চলে যেতে পারে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ পর্যায়ে—আলোচনার একপর্যায়ে এমনটাই জানায় কিআ স্বেচ্ছাসেবক জোবায়দা সুলতানা।
একশনএইড বাংলাদেশের মেডিকেল অফিসার ও এল আর পি ম্যানেজার ডা. নুসরাত কাদির বলেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার ক্ষেত্রে উদাসীন হওয়া যাবে না। পরিবেশদূষণ রোধ এবং অর্থ সাশ্রয়ের জন্য মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।
একশনএইডের সহায়তায় চনপাড়ার কিশোরীদের করা জরিপ নিয়ে হয় আলোচনা। যাদের নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, তাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? উত্তরে চনপাড়ার কিশোরীরা জানায়, মেয়েরা প্রথম প্রথম ইতস্তত বোধ করলেও জড়তা কাটিয়ে উঠেছিল দ্রুতই। গবেষণাটি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পেছনে তাদের অনেকখানি ভূমিকা রয়েছে। একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার মরিয়ম নেছা বললেন, এই গবেষণার মেন্টর হিসেবে মোশফেক আরা শিমুল থাকলেও মূলত কিশোরীরাই ঠিক করেছে তারা কী নিয়ে কীভাবে গবেষণা করবে। এমনকি, ফলাফল উপস্থাপনের জন্য নাটিকা মঞ্চস্থ করার আইডিয়াটিও তাদের।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি জানান, কিশোরী দলের গবেষণার গভীরতা, ফলাফল উপস্থাপনে চমকপ্রদ পদ্ধতি অবলম্বন তাঁর খুব ভালো লেগেছে। বলেন, ‘ওদের সপ্রতিভ আচরণে আমি মুগ্ধ। কতটা স্মার্টনেসের সাথে ওরা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছে! দারুণ!’
ততক্ষণে সভা সমাপ্তির ঘোষণা আসে। টের পাওয়া যায় কিআর কাছে নিজেদের গবেষণা, চাওয়া তুলে তুলে ধরতে পারায় চনপাড়ার কিশোরী দল কতটা আপ্লুত।
১০ বছর আগে এমন কিছু বিষয় ছিল, যা নিয়ে আমরা কথাই বলতে পারতাম না। এখন পারছি। তাই শিগগিরই পিরিয়ডকে ট্যাবু ভাবার দিনও শেষ হবে। ‘পিরিয়ড শেমিং’-এর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে কেবল অভিধানে—বাড়ি ফেরার পথে সবাই জানালেন নিজেদের প্রত্যাশার কথা।
সুরাইয়া, সুমাইয়া, তানজিলা, পূর্ণিমা, সুরভী, রাহিমা, নুরজাহান, শ্রাবন্তী, শীলা, মীম, স্মৃতি এবং কল্পনা—এই গবেষক কিশোরীদের জরিপের ফলাফল কী ছিল, সবশেষে তাহলে সেটা জানা যাক।
চনপাড়ায় কিশোরীদের করা গবেষণা জরিপে পাওয়া ফলাফল
৯০ শতাংশ কিশোরী এখনো পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে।
অধিকাংশ মেয়ে উচ্চমূল্য হওয়ার কারণে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারে না।
৯০ শতাংশ মেয়ের সচেতনতার অভাবে বাল্যবিবাহ হয়।
অধিকাংশ মেয়ে কিশোরী বয়সে মা।
বাল্যবিবাহের অন্যতম একটি কারণ মোবাইল আসক্তি।
অধিকাংশ ছেলে মাদকাসক্ত।
মেয়েরা যৌন হয়রানির ভয়ে ঘরের বাইরে যেতে ভয় পায়।
মেয়েরা এলাকার কোনো স্থানই নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করে না।
মেয়েরা এখনো মা–বাবার সঙ্গে মনের কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
জরিপ থেকে আরও জানা যায়
অধিকাংশ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে—
পিরিয়ডের সময় মেয়েদের মাছ খেতে হয় না।
পিরিয়ডের সময় দুপুরে ও সন্ধ্যায় মেয়েদের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না।
বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে পিরিয়ডের আলোচনা করা লজ্জার বিষয়।
গবেষক কিশোরীদের চাওয়া
প্রতিটি মেয়ে স্বাধীনভাবে তার পূর্ণ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক।
এই সমাজের পরিবর্তন।
ভয়হীনভাবে, আনন্দ নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতে পারার সুযোগ।
প্রতিটি স্কুলে বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার জন্য এলাকায় কাউন্সেলিং বুথ।
স্কুলে পিরিয়ডের সচেতনতা বিষয়ে আলোচনা করা হোক।
পিরিয়ড বিষয়ে কুসংস্কার দূর হোক।
পিরিয়ডের সময়ে মেয়েদের দেওয়া হোক পুষ্টিকর খাবার।
বাল্যবিবাহ বন্ধে স্কুলে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হোক।
এলাকায় মেয়েদের জন্য নাচ, গান, অভিনয়, গল্প করার স্থান।