ব্রাহ্মণের বাড়ির কাকাতুয়া

অলংকরণ: তুলি

ছাত্রছাত্রী বন্ধুরা, প্রথমে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নাও। শুভেচ্ছাটা যে খুব সজাগভাবে জানাতে পারছি, তা নয়। কারণ, এই মুহূর্তে আমি আসলে ঘুমোচ্ছি। গত পনেরো বছর ধরে আমি দুপুরে ঘুমাই। এটা আমার সিদ্ধান্তে নয়, চিকিৎসকের আদেশে। যেদিন দুপুরে এ রকম অনুষ্ঠান বা জরুরি কিছু থাকে, ঘুমোতে পারি না, সেদিন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়, মস্তিষ্ক বোকা হয়ে যায়। জেগে-জেগে আমি ঘুমোতে থাকি। আমি এতক্ষণ উত্তরা থেকে গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছি এবং আমার ধারণা, ঘুমোতে ঘুমোতেই এসেছি। আমি যে অন্য কোনো মানুষ বা গাড়ির ওপরে আমার গাড়ি তুলে দিইনি তার কৃতিত্ব আমার নয়, তাদের। তারা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে বলেই বেঁচে গেছে। এ রকম অবস্থা নিয়ে তোমাদের এই কর্মসূচিতে কেন ডেকে এনেছি তা ব্যাখ্যা করার জন্য দাঁড়িয়েছি। যদি হঠাৎ বাবার নাম বলতে নানার নাম বলে ফেলি তোমরা হাসবে না কিন্তু। (হাসি)।

মূল কথায় আসি। আমরা যখন দশম শ্রেণিতে পড়তাম, তখন আমাদের একটা প্রবন্ধ পড়তে হয়েছিল; নাম: ‘আকাঙ্ক্ষা’। লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রবন্ধটার প্রথম লাইনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘বৃদ্ধ সেজে আমি তোমাদের উপদেশ দিতে চাইনে।’ কিন্তু ‘চাইনে’ বলে দীর্ঘ দশ পৃষ্ঠা ধরে দুরূহতম বাংলায়, দুর্বোধ্যতম বক্তব্যে উনি যে উপদেশ আমাদের দিয়েছিলেন, সেটা এখনো আমাদের হাড়ে হাড়ে বিঁধে আছে। না, আমার বক্তৃতায় তেমন হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবু কিছু কথা তোমাদের কাছে এখন আমাকে বলতে হবে। সেই বিরক্তিকর পর্বের জন্য আটঘাট বেঁধে বসো। প্রথমে শুরু করি তোমাদের একটা দৈনন্দিন ব্যাপার দিয়েই।

তোমরা যখন সকাল-বিকেল রসগোল্লার দোকানের পাশ দিয়ে যাও, তখন নিশ্চয়ই সেদিকে আড়ে আড়ে চাও। কী, চাও কি না?

(ছাত্রছাত্রীরা: চাই। চাই)।

কেন চাও সেটা বলে আমি তোমাদের লজ্জায় ফেলতে চাই না। (হাসি) পকেটে পয়সা থাকলে হয়তো দোকানে ঢুকে পড়ো। না-থাকলে ‘আমি রসগোল্লা খাই না’ বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে এভাবে পায়ের পাতা নাড়াতে থাকো। (ভঙ্গি ও ছাত্রছাত্রীদের হাসি)

এখন কল্পনা করো, তুমি একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। চোখের ওপর থরে থরে সাজানো আছে পান্তুয়া, রসগোল্লা, প্রাণহরা, চমচম, মিহিদানা, রসমালাই। [কী নাম সব! শুনেই জিবের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।] কিন্তু পয়সার অভাবে সুবিধা করা যাচ্ছে না। সুবিধা না-হবার কারণও আছে। দোকানের দরজার পাশেই বসে আছে একটা অসভ্য রকমের স্বাস্থ্যবান লোক। তার ভীতিকর চাউনি আর বিরাট গোঁফজোড়ার আকার-আকৃতি কোনোটাই খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কাজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকান পেরিয়ে চলে না গিয়ে উপায় কী? কিন্তু ধরো, হঠাৎ যদি ঘটত এমনি একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা: তাকিয়ে দেখলে দোকানের মুখে সেই দৈত্যের মতো লোকটা নেই! কাচের দরজা-জানালাগুলোও পুরো খোলা; লোহার গ্রিলট্রিল অদৃশ্য। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। শুধু সেই থরে থরে সাজানো মিষ্টির অফুরন্ত জগৎ, আর তার সামনে দাঁড়ানো তুমি। কী করতে তখন?

টেলিভিশনে নিশ্চয়ই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটা বিজ্ঞাপন দেখেছ। একটা হাতি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আকাশে উড়তে শুরু করে (সবাই হাসতে থাকে)। আমার ধারণা, তোমারও হতো ও রকমই অবস্থা। ওভাবেই উড়ে গিয়ে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়তে রসগোল্লাদের ওপর। মিষ্টির রস সিরা চোখে-মুখে মেখে, মিষ্টির সাগরে সাঁতার কেটে প্রাণভরে স্বাদ মেটাতে।

আমার এখন প্রশ্ন: মিষ্টির যে স্বাদ আছে, রসগোল্লায় যে এত মজা—এটা তোমরা জানলে কী করে?

(ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে: খেয়েছি বলে)।

ঠিক। খেয়েছ, তাই। আব্বা বাসায় নিয়ে এসেছেন, খেয়েছ। মামার বিয়েতে খেয়েছ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে খেয়েছ। খেতে খেতে এমন হয়েছে, এখন আর রসগোল্লা তোমার মুখের সামনে এনে নাড়াতে হয় না। নাম শুনলেই জিভ ভিজে যায়। মিষ্টি- যে মজা, শিককাবাব- যে মজা, কাচ্চি বিরিয়ানি- যে মজা, এটা তোমাদের জানা হয়ে গেছে। কাজেই কোনো কিছুর আসল মজা জানতে হলে তাকে ভালো করে জানতে হয়, বারে বারে তার স্বাদ নিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটা বিরাট দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, বহু জিনিসের ভেতরেই যে এমন অবিশ্বাস্য মজা লুকিয়ে আছে, সেটা জানার সুযোগ সমাজ বা তার অভিভাবকেরা আমাদের দেয় না। যেমন ধরো, বই। বই সত্যিই একটা মজার জিনিস। সত্যিই ভারি সুন্দর।

[গ্যালারি থেকে একজন ছাত্রের অস্পষ্ট গলা শোনা গেল: ‘হুম। এতক্ষণে লাইনে এসেছে।’]

দেখেছ, ও টের পেয়ে গেছে। এদের নিয়ে মহামুশকিল। এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে এরা ঘুমায় কী করে? (ছাত্রছাত্রীদের হাসি, হইচই)

বুদ্ধির জন্য ওকে প্রশংসা করছি। কিন্তু মনে রেখো: যার অভাবে দেশ আজ ডুকরে কাঁদছে, তা বুদ্ধি নয়, শুভবুদ্ধি। আমাদের দেশে আজ বুদ্ধিমান মানুষের অভাব নেই। অভাব ভালো মানুষের। স্বার্থের প্রশ্নে কারও বুদ্ধির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু একজন মানুষ যা পেতে পারত, নিতে পারত তা নিচ্ছে না, ফিরিয়ে দিচ্ছে, এমন মানুষ আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে না। এসো, তাই আমরা চালাকি ফেলে আজ সহৃদয় আর বোকা মানুষদের খোঁজ করি।

এখন এসো দেখতে চেষ্টা করি বই জিনিসটা ঠিক কী? বলো তো, বই দেখতে কেমন?

(একজন ছাত্র: চারকোনা)

হ্যাঁ, চারকোনা। চারকোনা আর লম্বাটে। ভেতরে সাদা সাদা পৃষ্ঠা আর প্রতি পৃষ্ঠার ওপর ছোট ছোট কালো অক্ষরের টানা টানা সারি। এবার বলো তো, একটা ‘সুন্দর’ বই আসলে কী? এটা কি কেবল বাঁধাই করা কিছু পৃষ্ঠা, কেবল কতগুলো কালো কালো অক্ষরের সারি নাকি আর কিছু?

না, একটা সুন্দর বই তা নয়। এসো, শেখ সাদীর একটা ছোট্ট কবিতা শুনে বোঝার চেষ্টা করি একটা ভালো বা সুন্দর বই জিনিসটা আসলে কী। কবিতাটা এ রকম:

কবি একদিন পথে হাঁটার সময় একটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে পেলেন। ঢেলাটাকে নাকের কাছে আনতেই দেখলেন তার গায়ে মিষ্টি অপরূপ গন্ধ। আচ্ছা, মাটির গন্ধ কি খুব মিষ্টি আর অপরূপ?

(কয়েকজন ছাত্রছাত্রী: না।)

তবে কেমন?

(সবাই নিশ্চুপ)

না, মাটির গন্ধ মিষ্টি বা অপরূপ নয়। মাটির গন্ধ ‘সোঁদা সোঁদা’। কবিতায় আছে: ‘ভেজা মাটি থেকে আসে সোঁদা-সোঁদা গন্ধ’—তেমনি। ভোঁতা বিস্বাদ আর বিবমিষা-জাগানো গন্ধ এর। আমাদের এক দেশপ্রেমিক কবি আবেগ দিয়ে লিখেছিলেন: ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন।’ কিন্তু তুমি কবিকে সবিনয়ে একটা অনুরোধ করতে পারো: ‘কবি সাহেব, মাটির গন্ধটা যখন আপনার এতই পছন্দ, তখন নাকটা ওর ভেতর একবার ভালোভাবে ঠেসে ধরুন না, মধুর ঘ্রাণটা কেমন দেখতে পাবেন।’ আমি জানি, কবি যত বড় দেশপ্রেমিকই হোন, এমন প্রীতিকর বা সুখকর কাজ তিনি করতে চাইবেন না। না, মাটির গন্ধ মিষ্টি-অপরূপ কিছুই নয়। মাটির গন্ধ বিস্বাদ, ভাপসা, নাড়ি-ওগরানো। কিন্তু কবি দেখলেন, মাটির ঢেলায় স্নিগ্ধ অপরূপ গন্ধ। অবাক হয়ে মাটির ঢেলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাটির ঢেলা, তোর গায়ে তো এমন সুগন্ধ থাকার কথা নয় রে। এমন সুঘ্রাণ কী করে এল?’

মাটির ঢেলা তখন কবিকে কী বলল, সেটা একটু ভালো করে শোনো। বলল, ‘কবি তুমি ঠিকই বলেছ। আমার গন্ধ সুন্দর নয়। কিন্তু কি জানো? একটা ব্যাপারে আমি ছিলাম ভাগ্যবান। আমি যে জায়গায় ছিলাম তার ওপরে ছিল একটা বড় আকারের বসরাই গোলাপের গাছ। অপূর্ব গন্ধে ভরা অজস্র বড় বড় গোলাপ ফুটত সে- গাছে, বহুকাল ধরে তাদের সৌগন্ধময় পাপড়িরা ঝরে পড়েছে আমার ওপর। পড়তে পড়তে পড়তে পড়তে তাদের গন্ধ একসময় আমার শরীরের পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে। তাই আমার গন্ধ গোলাপের মতো এমন সুন্দর হয়ে উঠেছে।’

এবার বলো তো, মাটির ঢেলার মতো আমাদের জীবনটাকেও যদি অমন সুন্দর আর অপরূপ করে তুলতে হয়, তবে কিসের সংস্পর্শ আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার?

একজন ছাত্র: বইয়ের।

ঠিক, কিন্তু কেন তা, এসো সেটা তোমাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। বলো তো, সুন্দর, মহৎ বা ভালো বই লেখেন কারা? যাঁরা সুন্দর, মহৎ বা জ্যোতির্ময় মনের অধিকারী তাঁরা, না ক্ষুদ্র হীনচেতা বা অকর্ষিত মনের অধিকারীরা?

(ছাত্রছাত্রীরা: সুন্দর মনের অধিকারীরা)।

এসব সুন্দর মনের মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিগুলো কেমন? সেগুলো কি অমার্জিত-অকর্ষিত নাকি সৌন্দর্যে, মাধুর্যে, ঐশ্বর্যে আর দীপ্তিতে ভরা? (ছাত্রছাত্রীরা: সৌন্দর্যে, মহত্ত্বে, মাধুর্যে, ঐশ্বর্যে আর দীপ্তিতে ভরা)। তাই যদি হয় তবে তাঁদের লেখা একেকটা বইয়ের কেমন হওয়ার কথা? নিশ্চয়ই তাঁদের হৃদয়ের ওইসব কমনীয় মাধুরীতে আর জ্যোতিতে পরিপূর্ণ। তাই না? তাঁদের মনের অপরূপতা আর সুঘ্রাণে আমোদিত।

এটা যদি ঠিক হয় তাহলে রবীন্দ্রনাথের একটা বই মানে কী? রবীন্দ্রনাথের মনের ভেতর যত আনন্দ ছিল, যত সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য দীপ্তি আর মাধুরী ছিল, তাই তো রয়েছে ওই বইয়ে। তাই না? (ছাত্রছাত্রীরা: হ্যাঁ)

তাঁর হৃদয়ের সব আলো আর সৌন্দর্যই তিনি কি রেখে যাননি ওই বইয়ের পাতায় পাতায়? (ছাত্রছাত্রীরা: হ্যাঁ।)

কাজেই তুমি যখন তাঁর কোনো বই পড়ো তখন কি রবীন্দ্রনাথের মনের ওই সব সৌন্দর্য, আনন্দ, মেধা, দীপ্তি বা আলো তোমার ওপর ছড়িয়ে পড়ে না? এখন ধরো, তুমি যদি তার অনেকগুলো বই পড়ে ফেলো তাহলে কী হলো? অমনি সৌগন্ধময় হাজারো বসরাই গোলাপ তোমার ওপর কি ঝরে পড়ল না? (ছাত্রছাত্রীরা: হ্যাঁ)। ঝরে ঝরে তোমাকে আরও সুন্দর আর অনুপম করে তুলল না? তুমি কি আর তখন তুমি থাকলে? নাকি তোমার চেয়ে আরও সুন্দর আর আলোময় মানুষ হয়ে উঠলে? রবীন্দ্রনাথের মতন অমন অনবদ্য দেহকান্তি বা চুল-দাড়ি হয়তো তোমার না হতে পারে, কিন্তু দেখবে তোমার ভেতরেও কেমন যেন একটু রবি - রবি ভাব এসে গেছে। একইভাবে তুমি যদি পৃথিবীর সেরা লেখকদের সেরা আর সুন্দর বইগুলো পড়তে থাকো তখন কি তুমি আজকের এই সাধারণ মানুষটি থাকবে? ওই অনবদ্য বইগুলো সারাক্ষণ গোলাপের পাপড়ির মতো তোমার মনের ওপর ঝরে ঝরে তোমাকে কি সাধারণের চাইতে অনেক সুন্দর আর বড় করে তুলবে না?

(ছাত্রছাত্রীরা: তুলবে)

নিশ্চয়ই তুলবে। এ জন্যই সুন্দর আর আলোকিত হয়ে ওঠার জন্য বই আমাদের পড়তে হয়। বড় হতে চাইলেও পড়তে হয়। কিন্তু সবকিছু জেনেও আমরা কি পৃথিবীর সবচেয়ে আলোময় বইগুলো পড়ি? পড়ি না। কীভাবে আমরা বইয়ের মতো এমন জ্যোতির্ময় জিনিসকে হাতের কাছে পেয়েও অবহেলা করি এসো তা তোমাদের দেখিয়ে দিই।

২.

বলো তো, রবীন্দ্রনাথ কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন?

(একজন ছাত্র: মারা গেছেন)।

কোন সালে?

(অন্যজন: ১৯৪১ সালে)।

ঠিক বলেছ। সত্যিই তো তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু ধরো, হঠাৎ যদি এমন অদ্ভুত একটা কথা শোনা যেত যে তিনি মারা যাননি। বেঁচে আছেন। কেবল বেঁচে আছেন না, তিনি ঠিক করেছেন আজ এই ২২ জানুয়ারি বিকেল চারটা পঁয়ত্রিশেই তিনি ঢাকা শহরে আসবেন। না, শুধু ঢাকা শহরে নয়, তিনি আসবেন সোজা আমাদের এই ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’। হ্যাঁ, এখানে, যেখানে তোমাদের সঙ্গে আমি কথা বলছি। তোমাদের না দেখতে পেয়ে তাঁর নাকি অনেক দিন ঘুমই হচ্ছে না। তোমাদের দেখার জন্য তিনি একেবারে অস্থির আকুল।

এখন ধরো, শোনা গেল তিনি এসে গেছেন, হ্যাঁ ওইখানে—ওই গেটটার সামনে। ধরো, শুনতে পেলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন—ওই অবস্থায় কী করতে তোমরা? এখানে বসে থাকতে? বসে বসে আমার এই ছেঁদো কথা শুনতে? নাকি, হইচই, দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি করে ছুটে যেতে গেটের দিকে? (একজন ছাত্র: ছুটে যেতাম)।

নিশ্চয়ই যেতে। আর যদি হঠাৎ সেই সঙ্গে শুনতে অভাবনীয় সংবাদ—কেবল রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুল ইসলামও আসছেন তাঁর সঙ্গে। তাহলে কী হতো? হুলুস্থুলটা আরও বেশি হতো, না কম? (ছাত্রছাত্রীদের হাসি)। বেশি হতো, তাই না? ধরো যদি শুনতে, শুধু রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নন, শেক্সপিয়ারকেও মাইল দেড়েক দূরে দেখা গেছে। তিনিও আসছেন। তাহলে? (সবার হাসি)

না, কেবল এঁরা নন, ধরো যদি শুনতে আসছেন পৃথিবীর সব বড় বড় মানুষ, শ্রেষ্ঠ মনীষীরা—অ্যারিস্টটল আসছেন, প্লেটো আসছেন, আসছেন সক্রেটিস, আইনস্টাইন, রুশো, কালিদাস, দান্তে, খৈয়াম—সবাই। ওইখানে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ওই গেটের সামনে, এক্ষুনি, এই মুহূর্তে। কী করতে তখন? পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে না তাঁদের ওপর। তাঁদের দেখার জন্য, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য দাপাদাপি খুনোখুনি করতে না? একটা হাজার টন বোমা পড়ার মতো অবস্থা হতো না?

এবার বলি আসল কথা। আমি যদি বলি যে যে মনীষীর জন্য তোমরা এভাবে ছুটে যেতে, সত্যি তাঁরা অনেক আগেই এসে গেছেন আমাদের এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে; কেবল এসেছেন নয়, তাঁরা অনেক দিন থেকেই এখানে রয়েছেন। না, দূরে নয়, ওপরের তলার ওই লাইব্রেরির ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক দিন থেকে তোমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন—কথাটা কি বিশ্বাস হবে?

যদি বলি, ওই যে লাইব্রেরির বইভর্তি তাকগুলো—সেখানে তাঁদের সবাই তোমাদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন, বিশ্বাস হবে? ওইখানে দাঁড়িয়ে বইয়ের ভেতর থেকে জাগ্রত হৃদয়ে তোমাদের ডাকছেন। তাঁরা আজ শারীরিকভাবে বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁদের অন্তরের যত লাবণ্য, যত সৌন্দর্য, যত বিভা, যত আলো, যত বাণী—সবকিছু নিয়ে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওই বইগুলোর ভেতর। বিশ্বাস হবে?

(একজন ছাত্র: হবে)।

কেন হবে?

(ছাত্রটি: ওসব বই তো তাঁদেরই লেখা। ওই বইগুলো তো তাঁরাই)। তাহলে, তোমরা তাঁদের ডাকে সাড়া দিচ্ছ না কেন? চিত্কার হুড়োহুড়ি করে পাগলের মতো তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছ না কেন? তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছ, এই বইগুলো আসলে সব জীবন্ত মানুষ! পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আর জ্যোতির্ময় মানুষেরা! আবেগদীপ্ত গলায় তাঁরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন, তোমরা কেন কথা বলছ না! হয়তো ব্যাপারটা তোমরা এভাবে কখনো ভাবইনি। কারণ, বইকে তোমরা চিনেছ অদ্ভুতভাবে— পাঠ্যপুস্তক হিসেবে, যার ভেতর দিয়ে এই জ্যোতির্ময় মানুষদের চেনার কোনো উপায় নেই।

কিন্তু ধরো তোমরা যদি তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে, তাঁদের সান্নিধ্যে জীবন কাটাতে, ওই জ্যোতির্ময় মানুষদের সব সৌন্দর্য, আলো, স্বপ্ন আর দীপ্তির স্পর্শে মাটির ঢেলাটার মতো সৌগন্ধময় হয়ে উঠতে; কী সুন্দর আর অনবদ্য মানুষই না তোমরা হয়ে উঠতে পারতে!

৩.

এবার এসো বলি, বই আমাদের কী উপকার করে। বলো তো, এটা কী? (হাত উঁচু করে দেখিয়ে)।

(একজন ছাত্র: হাত)।

বলো তো, একজন মানুষ তার নিজের কয় হাতের সমান? (একজন ছাত্রী: সাড়ে তিন হাতের)।

এখন বলো তো, শুধু নিজের হাতের সাড়ে তিন হাত লম্বা একটা ঘর হলে কি আমাদের চলে?

(একজন: চলে)। (সবার হাসি)

বেশ। তাহলে এসো, সাড়ে তিন হাত লম্বা একটা লোহার বাক্স তৈরি করে তোমাকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে তালা মেরে সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখি। দেখি কেমন লাগে তোমার?

(ছাত্রছাত্রীদের হাসি)

না, সাড়ে তিন হাত ঘর হলে আমাদের চলে না। বলো তো কত বড় ঘর আমাদের দরকার?

(একজন ছাত্রী: অনেক বড় ঘর)।

হ্যাঁ, যে মানুষ যত বড় তার তত বড় ঘর দরকার। যে রাজা, তার বাঁচার জন্য গোটা রাজ্য লাগে। না হলে তার বাতাসের অভাব হয়ে যায়। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

কেবল বড়দের কেন, আমাদের সবারই বড় ঘর দরকার। নিশ্বাস নেওয়ার মতো, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বড়সড় একটা ঘর। আমরা তো আশরাফুল মাখলুকাত, কত বুদ্ধি, মেধা, আলো, প্রেম, ক্ষমা নিয়েই না আমাদের জন্ম! এমন যারা বড় তাদের কি ছোট ঘর হলে চলে? এবার আমার একটা কথার উত্তর দাও। কেবল বড় ঘর হলেই কি আমাদের চলে? নাকি সে ঘরের মধ্যে আরও কিছু থাকতে হয়?

(সবাই নিঃশব্দ)

বলো তো, যে ঘরের জানালা নেই, তার নাম কী?

(একজন ছাত্র: কবর)! ঠিক বলেছ। কবরের জানালা নেই। কিন্তু আমরা অত আধ্যাত্মিক ঘরদোর নিয়ে টানাহেঁচড়া করব না। এসো আমরা এমন ঘর খুঁজি, যে ঘর সব সময় আমাদের চারপাশে দেখি, অথচ যার জানালা রাখা হয় না—বলো তো কী নাম সেই ঘরের?

(একজন ছাত্র: গুদাম)?

হ্যাঁ, গুদাম। গুদাম সেই ঘর যাতে জানালা নেই। এখন বলো তো, গুদামে কি মানুষ থাকতে পারে?

(ছাত্ররা: না)।

সত্যি ওখানে মানুষ থাকা সম্ভব নয়। যার জীবন আছে, বিকাশ আছে, স্বপ্ন আছে, তার থাকা সম্ভব নয়। ওখানে যা থাকতে পারে তা মানুষ নয়, মাল। চালের বস্তা, সিমেন্টের বস্তা, আলুর বস্তা, গমের বস্তা। বলো তো কেন মানুষ সেখানে থাকতে পারে না?

(একজন ছাত্রী: আলো নেই বলে)।

হ্যাঁ, আলো নেই। ঠিক। আর?

(একজন ছাত্র: বাতাস নেই বলে)।

হ্যাঁ, বাতাস নেই। আর?—

(একজন ছাত্রী: বাতাসের চলাচল নেই বলে)।

তোমাদের সব কথা ঠিক, সব সত্যি। আসলে চারপাশের আলো-ঝলমল বিপুল পৃথিবীটাই যে নেই ওর মধ্যে! চারপাশের দৃশ্যের জগৎ—রূপের জগৎ আলোর জগৎ মুক্তির জগৎ—কিছুই নেই। এ ঘর বন্ধ। এ ঘরে জানালা নেই। অথচ এই যে বিরাট ঘরটায় এই মুহূর্তে তোমরা বসে আছ, কত জানালা দেখেছ এর? মনে হয় যেন জানালাই আছে ঘরটাতে, দেয়ালই নেই। কেন এত জানালা এতে? বলো তো, একটা জানালা দিয়ে আমরা কি পাই? তাকাও না আমার ডান পাশের এই জানালা দিয়ে। কী দেখছ?

(একজন ছাত্র: একটা দৃশ্য)

হ্যাঁ, গাছপালা, একটা পুকুরের খানিকটা, আর একটা ছোট্ট মাঠ। এবারে তাকাও পরের জানালার দিকে। একই দৃশ্য দেখছ কি? নাকি সম্পূর্ণ নতুন কিছু?

(ছাত্ররা: সম্পূর্ণ নতুন)

এবার তাকাও ওই জানালায়। আগের দৃশ্যগুলোই দেখছ, নাকি আরও নতুন কিছু?

(কয়েকজন ছাত্রছাত্রী: আরও নতুন কিছু)। এবার তাকাও না সবগুলো জানালা দিয়ে। কী দেখা যাচ্ছে? সারা বিশ্ব, তাই না?

হ্যাঁ, সারা পৃথিবী। তোমরা এতগুলো মানুষ যাতে প্রাণ খুলে এখানে বাঁচতে পারো, তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ সবকিছু জীবনের ভেতরে আহরণ করতে পারো, তাই এই ঘরে এত জানালা। গুদামের ভেতরে এই বিপুল বিশ্বজগৎ নেই। তাই সেখানে মানুষ বাঁচে না।

তোমরাই বলেছ বাঁচার জন্য বড় ঘর দরকার। বড় ঘর মানে কী? বড় ঘর মানে আলো-বাতাস-জানালা-দরজা-বিশ্বচরাচরওয়ালা একটা ঘর। এই ঘর বহু অনিন্দ্য জিনিস দিয়ে আমরা বানাতে পারি।

যেসব অনবদ্য জানালা দিয়ে আমরা জীবনের ঘর সুন্দর আর খোলামেলা করতে পারি, বই তার একটা। ওই যে জানালার কথা বললাম, আমরা কি একেকটা বইকে অমনি একেকটা জানালার সঙ্গে তুলনা করতে পারি? (একজন ছাত্র: পারি)।

কীভাবে?

(একেকটা জানালার মতো একেকটা বইও আমাদের আলাদা আলাদা জগৎ দেখায়।)

ঠিক বলেছ। ধরো, প্রাচীন মিসরের ওপর একটা বই পড়লাম। কী হলো তখন? আমাদের চোখের সামনে প্রাচীন মিসর, ফারাও, পিরামিড আর মমির জগত্টা জ্বলজ্বল করে উঠল। যদি ক্যাপ্টেন কুকের ভ্রমণকাহিনি পড়ি, তবে তার ভ্রমণপথ, অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপ, স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে তাঁর মৃত্যু—এসব ছবি চোখের ওপর জ্বলজ্বল করে উঠল। যদি চাঁদের অভিযানের গল্প পড়ি, তবে মহাশূন্যচারী, নভোযান, চাঁদের পিঠে মানুষের অবতরণ—এমনি সব ছবি আমাদের চোখের সামনে জেগে উঠল। এমনিভাবে আমরা যদি এক এক করে এক হাজার বা পাঁচ হাজার বই পড়ে ফেলতে পারি, তবে কী হবে? আমাদের জীবনটা এক হাজার বা পাঁচ হাজার বড় উজ্জ্বল জানালাওয়ালা এক বিশাল খোলামেলা বিশ্ব হয়ে যাবে। আমরা একটা বিশাল বিচিত্র পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকব। বইয়ের এই অসম্ভব ক্ষমতার কথা তোমরা ভুলো না।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

৪.

একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। গল্পটা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের। গল্পটা এ রকম: একদিন খুব ভোরবেলায় এক ভদ্রলোক এক ব্যাধের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। ব্যাধ কাকে বলে জানো তো?

(একজন ছাত্র: শিকারি)।

ঠিক। ব্যাধরা একধরনের শিকারি। কিন্তু কোন ধরনের শিকারি তা তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। কসাই কাদের বলে জানো?

(একজন ছাত্র: যারা মাংস বিক্রি করে)।

ঠিক বলেছ। কসাই হচ্ছে তারা, যারা হাট থেকে পশু কিনে প্রথমে তাদের জবাই করে, তারপর সেই মাংসকে কেটে টুকরো টুকরো করে ওজন করে মানুষের কাছে বিক্রি করে। খুবই নির্দয় নৃশংস কাজ করতে হয় বলে তাদের মনটাও হয়ে ওঠে কঠোর, নির্দয়। কিন্তু ব্যাধদের করতে হতো আরও ভয়ংকর কাজ। কসাইদের মতো পশুদের তারা হাট থেকে কিনে আনত না, অস্ত্র হাতে সোজা জঙ্গলে ঢুকে পশুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রথমে তাদের হত্যা করত, তারপর তাদের টুকরো টুকরো করে কেটে ওজন দরে মানুষের কাছে বিক্রি করত। কাজেই যেমন শক্তিশালী তেমনি দুর্ধর্ষ আর ভয়ংকর লোক ছিল এই ব্যাধেরা।

এবার সেই গল্প। একদিন খুব ভোরবেলায় এক ভদ্রলোক ও রকম এক ব্যাধের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন, এমন সময় দেখেন দরজার পাশে বসে আছে সুন্দর একটা কাকাতুয়া। যেমন চমৎকার তার রং, তেমনি অনিন্দ্য তার শোভা। রঙে-সৌন্দর্যে থৈ থৈ করছে।

দেখে তো তিনি মহাখুশি। ‘বাহ্, ভারি সুন্দর তো!’ বলে তিনি কাকাতুয়াটাকে ভালোভাবে দেখার জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলেন।

তোমরা তো জানো, কাকাতুয়ার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। বলো তো কী?

(ছাত্রছাত্রীরা: কাকাতুয়া কথা বলতে পারে)।

ঠিক। এখন ভদ্রলোক তো খুশি হয়ে এগিয়ে গেলেন কাকাতুয়াটার দিকে। ভাবলেন এত আশ্চর্য সুন্দর কাকাতুয়া—হয়তো কত সুন্দর করেই না তার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু এগোতেই ঘটল বিপরীত ঘটনা। তাকে দেখেই কাকাতুয়াটা হঠাৎ বিশ্রী অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল। উনি তো অবাক। ‘একি! এত সুন্দর পাখি, আর এত কদর্য কথা? না, না, জায়গাটা তো ভালো নয়। যাই অন্য কোথাও যাই।’ এই বলে সেখান থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক গেলেন এক ব্রাহ্মণের বড়িতে। বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন এমন সময় দেখেন, দরজার পাশে বসে আছে এক কাকাতুয়া। ব্যাধের বাড়িতে যেমন দেখেছিলেন, হুবহু তেমনি। তেমনি আশ্চর্য সুন্দর, তেমনি অনিন্দ্য! সেই রং, সেই রূপ, সেই চেহারা। এবার তিনি কী করবেন? এগিয়ে যাবেন, না পালাতে চেষ্টা করবেন?

(একজন ছাত্রী: পালাতে চেষ্টা করবেন)।

সত্যি। পালাতেই চেষ্টা করলেন তিনি। তাড়াতাড়ি পেছন ফিরেই উল্টোদিকে দৌড় দিতে গেলেন। ভাবলেন: ওরে বাবা, সেই কাকাতুয়া! আবার না জানি কী সব বীভৎস কথা শুনতে হয়।

কিন্তু আশ্চর্য, তিনি চলে যাচ্ছেন দেখে সেই কাকাতুয়া হঠাৎ সুমিষ্ট কণ্ঠে মধুর ভাষায় তাকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করল। মধুর কণ্ঠে বলল: ‘আসুন, বসুন, অপেক্ষা করুন। আমার গৃহস্বামী বাইরে গেছেন। এক্ষুনি ফিরে আসবেন। অনুগ্রহ করে অল্প একটু অপেক্ষা করুন।’

তার সেই সুমিষ্ট কণ্ঠের সম্ভাষণ শুনে ভদ্রলোক তো অবাক।

একই কাকাতুয়া, একই চেহারা। অথচ আচরণে কী পার্থক্য! একজনের মুখে অশ্রাব্য অশ্লীল কথা, অন্যজনের মুখে মধুর প্রীতিময় সম্ভাষণ!

এ কী করে হলো?

রহস্য জানার জন্য তিনি সেই কাকাতুয়াকে জিজ্ঞেস করলেন: কাকাতুয়া, কিছুক্ষণ আগে আমি অমুক ব্যাধের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম হুবহু তোমার মতোই এক কাকাতুয়া। কিন্তু আমাকে সে জঘন্য আর কদর্য ভাষায় গালাগাল করেছে। অথচ দেখতে একই রকম হয়েও তুমি মধুর মিষ্টি ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলছ। এমনটা কেন হলো বলো তো।

শুনে সেই কাকাতুয়া তাকে যে উত্তর দিয়েছিল, এবার সেটা তোমাদের বলছি। উত্তরটা অসাধারণ। তোমরা মনে রাখার চেষ্টা কোরো। সে বলল, ‘দেখুন, ওই বাড়িতে যে কাকাতুয়াকে আপনি দেখেছেন, সে আর আমি একই মায়ের সন্তান। আমরা যমজ ভাই। চেহারাতে তাই আমাদের এত মিল। কিন্তু ভাগ্যদোষে সে পড়েছে ব্যাধের হাতে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে সে ব্যাধদের অশ্রাব্য, কদর্য ভাষার কতাবার্তা শুনতে পায়। শুনতে শুনতে ওটাই তার ভাষা হয়ে গেছে। আর সৌভাগ্যবশত আমি পড়েছি ব্রাহ্মণের হাতে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি তাই শুনি ব্রাহ্মণদের কণ্ঠে সুমধুর সামবেদের গান আর তাদের সুমিষ্ট সুললিত কথাবার্তা। সেসব শুনতে শুনতে আমার ভাষা হয়ে গেছে সুমিষ্ট আর মধুর। সুতরাং তার কথা যে কদর্য সেটা যেমন তার দোষ নয়, আমার কথা যে সুন্দর এটাও আমার গুণ নয়।’

কেন বলো তো, কেন হলো এমন পার্থক্য?

(ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে: পরিবেশের জন্য)। ঠিক, পরিবেশের কারণে। পরিবেশ যদি সুন্দর হয়, উন্নত হয়; মানুষ সে পরিবেশে বেড়ে উঠলে সেও হয়ে ওঠে উন্নত আর সুন্দর। কিন্তু পরিবেশ যদি হয় অকর্ষিত বা কদর্য, তাহলে সেখানে মানুষও হয়ে পড়ে অমনি কদর্য। এবার বলো, আমাদের দেশে আজ কাদের রাজত্ব? অমার্জিত স্থূল দুর্বৃত্তদের, না সুন্দর সভ্য আলোকিত মানুষদের?

(ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে: অমার্জিত, স্থূল, দুর্বৃত্তদের)।

আজকের বাংলাদেশ কি ব্রাহ্মণের বাড়ি, না ব্যাধের বাড়ি?

(সমস্বরে: ব্যাধের বাড়ি)।

তোমরা কি সেই ব্যাধের বাড়ির কাকাতুয়া হতে চাও?

(ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে: না)।

তবে কোন বাড়ির কাকাতুয়া?

(ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে: ব্রাহ্মণের বাড়ির)।

আবার বলো।

(সবাই কণ্ঠ চড়িয়ে: ব্রাহ্মণের বাড়ির)।

তাই যদি চাও, তবে আমাদের এই সুন্দর সপ্রাণ রুচিসম্মত পৃথিবীতে এসো। এখানে আমরা তোমাদের জন্য সেই ব্রাহ্মণের বাড়ি বানিয়ে রেখেছি। এখানে এসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর সুন্দর বইগুলো পড়ে মনকে সমৃদ্ধ করো, এর সাংস্কৃতিক পরিবেশে হূদয়কে সুমার্জিত করে তোলো। আলোকিত হও। চারপাশের শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকারের ভেতর আজ আলোর বড় অভাব। আমরা তোমাদের দিকে আহ্বানের হাত বাড়িয়ে রেখেছি।

(বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একাদশ শ্রেণির বইপড়া কর্মসূচির উদ্বোধনী বক্তৃতা, ঢাকা: ১৯৯২)