বদলে যাওয়া বাংলা ব্যাকরণ

ভাষা হলো মানুষের দেহের মতো। আর ব্যাকরণ হলো তার পোশাক। দেহের আকার অনুযায়ী পোশাক বদলাতে হয়। তেমনি ভাষার বদল অনুযায়ী ব্যাকরণেরও বদল করতে হয়। অনেকে মনে করেন, ভাষাকে ব্যাকরণ মেনে চলতে হয়। ব্যাপারটা আসলে ঠিক এর বিপরীত। ব্যাকরণকেই ভাষা মেনে বদলাতে হয়।

আজ থেকে এক শ বছর আগেও মনে করা হতো, বাংলা ভাষা এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। এ ধারণা থেকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ হয়েছে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের মতো। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেই বলেছেন, বাংলা ব্যাকরণের বদল করা দরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যাকরণের বদল ঘটাতে কেউ সাহস করছিলেন না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সাহসী এই কাজই করেছে। বাংলা ভাষার প্রবণতা অনুযায়ী বদল করেছে বাংলা ব্যাকরণের। কতটুকু বদলে গেল বাংলা ব্যাকরণ, এর কিছু নমুনা দেখা যাক।

পদ

বাংলা পদ পুরোনো ব্যাকরণে আছে পাঁচ প্রকার। নতুন ব্যাকরণে দেখানো হয়েছে আট প্রকার—বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণ, অনুসর্গ, যোজক ও আবেগ। পুরোনো ব্যাকরণের বিশেষণ পদ থেকে ক্রিয়াবিশেষণ আলাদা করা হয়েছে। আর বিভিন্ন ধরনের অব্যয়কে আলাদা করে অনুসর্গ, যোজক ও আবেগ শব্দে ভাগ করা হয়েছে। ইংরেজি ব্যাকরণের ‘পার্টস অব স্পিচ’–এর সঙ্গে এবার বাংলা পদ বেশ মিলিয়ে পড়া যাবে।

উপসর্গ

যেসব অর্থহীন শব্দাংশ অন্য শব্দের শুরুতে বসে নতুন শব্দ গঠন করে, সেগুলোকে উপসর্গ বলে। পুরোনো ব্যাকরণে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত উপসর্গকে বাংলা, সংস্কৃত ও বিদেশি—এই তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে। নতুন ব্যাকরণে এসব ভাগ দেখানো হয়নি। আর উপসর্গকে বাংলা শব্দগঠনের প্রধান প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রত্যয়

শব্দের পরে যেসব প্রত্যয় যুক্ত হয়, সেগুলোকে বলে তদ্ধিত প্রত্যয়। আর ধাতুর পরে যেসব প্রত্যয় যুক্ত হয়, সেগুলোকে বলে কৃৎ প্রত্যয়। পুরোনো ব্যাকরণের এই ধারণায় কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। তবে উপসর্গের মতো এখানেও বাংলা, সংস্কৃত, বিদেশি—এ রকম ভাগ দেখানো হয়নি। উপসর্গের মতো প্রত্যয়ও অর্থহীন শব্দাংশ। শব্দগঠনের প্রধান উপায়ের মধ্যে প্রত্যয়কেও দেখানো হয়েছে।

সমাস

অব্যয়ীভাব সমাসের উদাহরণে আগে হয়তো পড়েছ উপকূল, প্রতিদিন প্রভৃতি শব্দ। কিন্তু লক্ষ করে দেখো, এসব শব্দ উপসর্গের মাধ্যমে গঠিত। কারণ, উপ+কূল = উপকূল; প্রতি+দিন = প্রতিদিন। দেখা যায়, অব্যয়ীভাব সমাসের উদাহরণ হিসেবে দেওয়া শব্দগুলো গঠনগতভাবে উপসর্গের মধ্যে পড়ে। ফলে নতুন ব্যাকরণে অব্যয়ীভাব সমাস রাখা হয়নি। সংস্কৃত ব্যাকরণে কিন্তু অব্যয়ীভাব সমাসের প্রয়োজন আছে। কারণ, সংস্কৃত ভাষায় উপসর্গ বসে ধাতুর আগে আর শব্দের আগে উপসর্গ বসলে সেগুলো অব্যয়ীভাব সমাসের উদাহরণে যায়। নতুন ব্যাকরণে দ্বিগু সমাসকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কর্মধারয় সমাসের মধ্যে।

সন্ধি

বাংলা শব্দগঠনের প্রধান তিন উপায়—উপসর্গ, প্রত্যয় ও সমাস। সন্ধি শব্দ গঠন করে না, তবে এই তিন প্রক্রিয়ায় শব্দগঠনের ক্ষেত্রে সন্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সন্ধির সূত্র পড়তে পড়তে যারা আগে অস্থির হয়ে যেত, তাদের এবার সুবিধাই হবে। কারণ, ব্যঞ্জন সন্ধিকে দেখানো হয়েছে সমীভবনের প্রক্রিয়া হিসেবে। ফলে অনেক সূত্র মুখস্থ করার আর প্রয়োজন হবে না।

কারক

কারক সবাই পড়েছে ছয় প্রকার। বাংলায় সম্প্রদান কারকের প্রয়োজন নেই, এ কথা রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলেছিলেন। নতুন ব্যাকরণে সম্প্রদান কারক বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার সম্বন্ধ কারক বলে নতুন কারক যুক্ত করা হয়েছে। তাই আগের মতোই কারক আছে ছয় প্রকার।

বিভক্তি

সংস্কৃত ভাষায় বিভক্তি অনুযায়ী কারক নির্দেশিত হয়। যেমন কর্তৃকারকে সব সময় শূন্য বিভক্তি, কর্মকারকে দ্বিতীয়া বিভক্তি, করণ কারকে তৃতীয়া বিভক্তি, সম্প্রদানে চতুর্থী, অপাদানে পঞ্চমী আর অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি হয়। তবে বাংলা ভাষায় বিভক্তি আর কারকের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া বাংলায় চতুর্থী বিভক্তি বলে আলাদা বিভক্তি রাখার প্রয়োজন হয় না। তৃতীয়া ও পঞ্চমী বিভক্তি আসলে অনুসর্গ। ফলে বাংলায় তিন ধরনের বিভক্তি দেখানো হয়েছে।

বাক্য

বাক্যের মধ্যে একাধিক শব্দ দিয়ে গঠিত বাক্যাংশকে বর্গ বলে। বর্গ হলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত শব্দের গুচ্ছ। যেমন আমার চাচাতো ভাই সকাল আটটার সময়ে রওনা হয়েছে। এই বাক্যে ‘আমার চাচাতো ভাই’, ‘সকাল আটটার সময়ে’, ‘রওনা হয়েছে’—এ রকম তিনটি বর্গ বা শব্দগুচ্ছ আছে। বর্গের ধারণা পুরোনো ব্যাকরণে ছিল না। নতুন ব্যাকরণে ‘বাক্যের বর্গ’ নামে আলাদা পরিচ্ছেদ আছে। আমরা কথা বলার সময় শব্দের পর শব্দ না বসিয়ে আসলে বর্গের পর বর্গ বসাই।

ছোট-বড় আরও অনেক ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছে নতুন ব্যাকরণে। যারা এ বছর নবম শ্রেণিতে উঠেছ, তারা পরিবর্তনের ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো টের পাবে। নতুন ব্যাকরণে একেকটি বিষয়কে একেকটি পরিচ্ছেদে রেখে আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদ সংক্ষিপ্ত হওয়ায় পড়তেও বেশ সুবিধা হবে।