তুমি কোন সে ঘাতক?
যে তুমি কেড়ে নিলে এ দেশের স্বপ্নজয়ী পিতাকে?
তুমি কোন সে ঘাতক?
তোমার বুলেটে ছিন্ন হয়ে গেল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি,
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তুমি কোন সে ঘাতক?
যে তুমি কেড়ে নিলে
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে
কেড়ে নিলে ভাইকে, স্বজনকে
কেড়ে নিলে ছোট্ট সোনাভাই রাসেলকে!
শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১। বাঙালি জাতি শিক্ষা নিয়েছে প্রতিরোধে-প্রতিশোধে জেগে উঠবার। এ চেতনার উত্স আমাদের মাতৃভাষা, আনন্দ উত্সব ও সংস্কৃতি। এসব আমাদের অমূল্য সম্পদ। বাঙালির বরপুত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির সংগ্রামমুখর ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি আমাদের দিয়েছেন মুক্ত স্বদেশ ও বিজয় পতাকার গর্বিত উত্তরাধিকার। আমাদের নিরন্তর পথচলার তিনিই প্রদর্শক, শক্তি ও উদ্দীপনার উত্স। সংগ্রামমুখর জীবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশকেই গড়ে তোলেননি, বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে গেছেন উচ্চতর আসনে। দেশের নেতা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন গর্বিত জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির গর্ব। সমগ্র জীবন তিনি উত্সর্গ করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে। ধারাবাহিক সংগ্রাম-আন্দোলন, সর্বোপরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ফিরে পায় আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি এবং স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল-সবুজের পতাকা।
বাল্যকাল থেকেই গভীর আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ ও জাতিকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। বাঙালি জাতির ওপর ইংরেজ ও পাকিস্তানি শোষণ-নিপীড়ন দেখে তিনি ভাবতেন, কীভাবে পরাধীনতার এই শিকল থেকে জাতিকে মুক্ত করা যায়। দেশপ্রেমের চেতনায় বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে হৃদয়বান সাহসী মানুষটি একটু একটু করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে লাগলেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের গৌরবে বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিলেন জাতীয় সংগীত—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
ইংরেজ শাসকেরা চলে যাওয়ার পর এ উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই ভাগে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলাকে ১২ হাজার মাইল দূরের পাকিস্তান নামের অদ্ভুত এক দেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের এ নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তুলতে যে মানুষটি নেতৃত্ব দেন—তিনি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তখন এ ঘোষণার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে যে সাহসী মানুষটি ছিলেন, তিনি বাঙালির প্রাণের নেতা আমাদের বঙ্গবন্ধু।
পরাধীনতা ও শাসন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ধাপে ধাপে বীরের জাতিতে রূপান্তর করেন। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি ঘোষণার পর সমগ্র বাঙালি জাতি তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও বাঙালি শাসনক্ষমতা পেল না। এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গর্জে উঠল বাঙালি জাতি। আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল পূর্ব বাংলা। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে জেগে উঠল বাঙালি। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে।
২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নারী, পুরুষ, শিশুসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে লাগল। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। নিপীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত বাঙালি বীর বাঙালিতে পরিণত হলো। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে বিশ্ববাসীর সামনে স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের গৌরবে বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিলেন জাতীয় সংগীত—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
কিন্তু যে মহান নেতা আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ গড়ে দিলেন, সেই নেতা প্রাণ হারালেন ঘাতকের বুলেটে, স্বাধীন দেশে, নিজ গৃহে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হবার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাঙালি জাতির ইতিহাসে এল শোকাবহ একটি দিন। এদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে থমকে দেওয়া হয়েছিল। থমকে গেল বাঙালির প্রাণ! দেশ ফের চলা শুরু করল উল্টো পথে, অন্ধকারের দিকে। আবারও প্রতিরোধ গড়ে তুলল বাঙালি জাতি। দূর হলো অন্ধকারের কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা এগিয়ে চলছি আলোর পথে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুদের প্রিয় বন্ধু। সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেও তিনি শিশুদের ভোলেননি। শিশুদের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। জাতিসংঘ কর্তৃক শিশুসনদ ঘোষণার অনেক আগেই ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শিশুস্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে শিশু আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর শিশুপ্রেমকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। এদিন শিশুরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিজেদের জীবনকে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করে।
দেশকে ভালোবেসে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন কারাবন্দী হয়ে। এ সময় মেধা-প্রজ্ঞা আর সাহসে বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল সহযোদ্ধার ভূমিকা রেখেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি আমাদের বঙ্গমাতা, স্বপ্নজয়ের সারথি।
একদিন জেলগেটে এসে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।’ সঙ্গে খাতাও দিলেন তিনি।
বঙ্গমাতার কথামতো বঙ্গবন্ধু লেখা শুরু করলেন। প্রথম লাইনটি এ রকম—আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে... লিখতে লিখতে যে শব্দমালা রচিত হলো বঙ্গবন্ধুর কলমে, সেই শব্দমালা বাঙালি জাতির ইতিহাস হয়ে উঠল। হয়ে উঠল সময়ের প্রতিচ্ছবি। প্রকাশ পেল বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জীবনের একেকটি দিনের কথা। আমরা পেলাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা। বই দুটিতে ঠাঁই পেয়েছে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আজকের শিশু-কিশোর। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন, সেই বাংলাদেশের আগামী নেতৃত্ব আজকের শিশু-কিশোরদের কাছে। দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি–সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে আজকের শিশু-কিশোরদের চিনতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে চেনা মানেই বাংলাদেশকে চেনা। আগামী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আজকের শিশু-কিশোরদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করতে হবে। সত্যকে জানতে হবে। মানবিক হতে হবে। উদার হতে হবে। এই গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃত ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়েই চেনা যাবে বঙ্গবন্ধুকে, চেনা যাবে বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধুকে জানো, বাংলাদেশকে জানো।