খুব ছোটবেলার একটা বইয়ের কথা মনে পড়ে, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা। বইটির লেখক ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। এই বই যখন প্রিয় ছিল, তখন হয়তো পড়তাম ক্লাস ওয়ানে।
ওই সময় আমি যেতাম কবীর স্যারের ঘরে। স্যার আমাদের স্কুলের হোস্টেলের একটা রুমে থাকতেন। আমাদের কোয়ার্টারও ছিল ওই ভবনেই। আমি তাঁর ঘরে গিয়ে আবিষ্কার করি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই। সেই বইয়ে কবিতা ছিল ‘লিচু–চোর’, ‘খুকী ও কাঠ্বেরালি’। আমি সেসব কবিতা পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলতাম।
আমরা থাকতাম পিটিআই নামের একটা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে। আব্বা চাকরি করতেন সেখানে। আমরা সেটার প্রাইমারি স্কুলেই পড়তাম। বিশাল লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরি দেখতেন বিএসসি স্যার। তাঁর কাছে আমরা যেতাম, ইচ্ছেমতো বই নিয়ে আসতাম। পরের সপ্তাহে আবার বইগুলো ফেরত দিয়ে আসতাম।
ওই সময় আমার প্রিয় ছিল কতগুলো বাঁধাই করা সংকলনজাতীয় বই। এগুলো হতো ডাবল ডিমাই আকারের। বোর্ড বাঁধাই। পাতায় ছবি থাকত, অনেকগুলো ছবি হতো রঙিন। বইগুলোর নাম ছিল এমন—ছুটির দিনের উপহার, পুজোর দিনের উপহার, ঠানদিদির থলে। সেই সংকলনগুলোয় গল্প থাকত, কবিতা থাকত, কমিকস থাকত, ধাঁধা থাকত। শিবরামের হাসির গল্প আমি ওই সংকলনেই পড়েছিলাম। গোবর্ধন হর্ষবর্ধনের কাণ্ডকীর্তি পড়ার জন্য আমরা আকুল হয়ে থাকতাম। আমি যখন ফোর ফাইভে পড়ি, আমার তখন ভালো লাগত রূপকথার গল্প। এই সংকলনে যেসব রূপকথার গল্প থাকত, তা আমি খুব মন দিয়ে পড়তাম। কিন্তু যেসব বাস্তবধর্মী গল্প থাকত, সেসব পড়তে আমার ভালো লাগত না। ভালো লাগত জাদু বা ম্যাজিক। পিসি সরকারের জাদু থাকত। আমি সেসব জাদু নিজে নিজে প্র্যাকটিসও করতাম।
আমাদের ছোটবেলায় বাংলাদেশের প্রকাশনাজগৎ উন্নত ছিল না। বই পাওয়া যেত না। যা পাওয়া যেত, তা হলো কলকাতার পাইরেটেড বই। খুব খারাপভাবে ছাপা, নিউজপ্রিন্ট কাগজ, মলাটও ছিল পাতলা কাগজের। সেসব বই–ই আমরা পড়তাম। ফাল্গুনী, নিমাই, নীহাররঞ্জন। ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তর গোয়েন্দা গল্প ছিল, তাঁর একটা গোয়েন্দার নাম ছিল কিরীটী রায়, আরেকটার নাম বীরূপাক্ষ। সেসব বই পড়তাম। বইয়ে এমন কিছু থাকত, যা ছোটদের পড়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা পড়তাম। নিজেদের মতো করে বুঝে নিতাম, যাতে কোনো মালিন্য ছিল না।
কিন্তু লাইব্রেরি থেকে এনে পড়া হতো শরৎচন্দ্র, কিংবা জসীমউদ্দীনের বোবাকাহিনী, শওকত ওসমানের ওটেন সাহেবের বাংলো, রাহাত খানের দিলুর গল্প। ছোটবেলার খুব প্রিয় একটা বইয়ের নাম বাঙ্গালীর হাসির গল্প, জসীমউদ্দীনের সংগ্রহ করা।
আমার আব্বা ছিলেন পরহেজগার মানুষ, তিনি পড়াতেন শিশুমনোবিজ্ঞান, বলতেন, যেকোনো একটা বই পড়ো, বসে থেকো না। বলতেন, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আর বলতেন, জগতে খারাপ বই বলতে কিছু নেই। বইমাত্রই ভালো।
আমি কখনো মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর, কিংবা দস্যু বাহরাম–জাতীয় বই পড়তাম না। আমার সব সময়ই প্রিয় ছিল সাহিত্য। ছোটগল্প পছন্দ করতাম। হাসান আজিজুল হকের সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য আমি পড়েছিলাম রংপুর জিলা স্কুলের লাইব্রেরি ক্লাস থেকে এনে। তেমনিভাবে ক্লাস সিক্সে আধুনিক আরবি গল্পের অনুবাদও পড়ে ফেলি।
প্রচুর কবিতা পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রিয় কবি। তাঁদের কবিতা মুখস্থ করে ফেলতাম।
আমরা থাকতাম রংপুরে। গ্রামে আমাদের একটা দাদার বাড়ি ছিল। সেখানে গেলে আলমারিতে অনেক ভালো ভালো বই পাওয়া যেত। কারণ, আমার এক জেঠাতো বোন বাংলায় এমএ পড়েছিলেন। তাঁর সংগ্রহ থেকেই আমি পড়ে ফেলি বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, কমলাকান্তের দপ্তর, আর হাতের কাছে পাই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংকলন গল্পগুচ্ছ। গল্পগুচ্ছ–এর গল্পগুলো আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে আর ঘর থেকে বের হতাম না। সারা দিন শুধু বই পড়তাম। আমাদের আধিয়াররা আম্মাকে অভিযোগ করতেন, আপনার এই ছেলেটাকে পাঠাবেন না, ও ঘর থেকে বের হয় না, জমিজমা দেখতে যায় না।
শিশু একাডেমির শিশু পত্রিকাটাও আমার প্রিয় ছিল। দাম ছিল সস্তা। মাত্র এক টাকা। ওই পত্রিকার একটা ছড়া আমার এখনো মুখস্থ আছে, মুখস্থই লিখছি:
দাদুর মাথায় টাক ছিল
সেই টাকের ওপর কাক ছিল
যেই দেখল খোকন ঢিল দিল
বোন দৌড়ে এসে কিল দিল
শোন দাদুর তখন অবস্থাটা
ঢিলের চোটে কপাল ফাটা
বাবা তখন ব্যস্ত ছিলেন
খবর পেয়ে ত্রস্ত হলেন
ফোনের পরে ফোন গেল যেই
বদ্যি এল একনিমেষেই
বদ্যি এল বদ্যিপাড়ায়
নাম ছিল তার সর্দি সারায়...
আর মনে নেই। এই পর্যন্ত মনে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে ছড়ার লেখকের নাম আমার মনে নেই। কেউ যদি জানেন এত সুন্দর ছড়া কে লিখেছেন, আমাকে দয়া করে জানাবেন কি?
আমাদের সময়ে রাশিয়ার কতগুলো বই পাওয়া যেত। তার মধ্যে একটা ছিল উভচর মানুষ, একটা ছিল ইস্পাত। আর কতগুলো বই যেমন: রুশদেশের উপকথা, যাতে পেনসিলে আঁকা ছবি থাকত, তাতে গল্পের সঙ্গে কবিতা থাকত:
ছোট্ট গোল রুটি
চলছে গুটি গুটি...
আমার ছোটবেলায় হঠাৎ করেই হাতে এল দুটো বাংলাদেশের বই। একটার নাম সমুদ্র অনেক বড়, এর লেখক আখতার হুসেন। আরেকটার নাম ছিল পাতাবাহার। লেখক সত্যেন সেন। এই দুইটা বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বই হয়ে ওঠে।
আমি যে আজ লেখক হওয়ার চেষ্টা করছি, তার পেছনে সমুদ্র অনেক বড় নামের বইটার অবদান আছে। একটা মজার কথা শোনো। আমার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় সেই লেখক এখন আমার সঙ্গে একই অফিসে কাজ করেন। তিনি আর আমি পাশাপাশি একই ফ্লোরে বসি।
আখতার হুসেনের সেই বইটা প্রথমা আবার বের করেছে। কিন্তু এত সুন্দর একটা বই নিয়ে কোথাও কোনো হইচই নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েদের হলোটা কী? তারা কি ভালো বই খুঁজে খুঁজে পড়ে না, আর মুগ্ধ হয়ে অন্যদের বলে না, এই বইটা পড়ো, এই বইটা পড়ো।
আখতার হুসেনের সমুদ্র অনেক বড় বইয়ে একটা গল্প ছিল। গল্পটা এই রকম:
এক কোকিল। তার শখ হয়েছে সে চাকরি করবে। সে শহরে এল। একটা অফিসে এসে বলল, আমাকে চাকরি দিন। বস বললেন, করো চাকরি। রোজ নয়টায় আসবে। পাঁচটায় যাবে। তোমার কাজ হলো, সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলায় উঠবে, আর নিচে নামবে। মাস শেষে বেতন পাবে। কোকিল খুব খুশি। সে চাকরি করে। বেতন পায়। অনেক দিন পর মনে হলো, আরে আমি তো গানের পাখি। আমার তো গান করা উচিত। সে ছাদে গেল। গান গাইতে শুরু করল। গলা দিয়ে গান বেরোল না। বেরোল রক্ত।
এটা আমার গল্প নয়। আখতার হুসেনের গল্প। বইয়ের নাম সমুদ্র অনেক বড়। বইমেলায় প্রথমার স্টল থেকে বইটা সংগ্রহ করে তোমরা পড়বে কি? আমাকে জানাবে কি তোমাদের কেমন লাগল?
আমাদের ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই ছিল না, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছিলেন না, ফেলুদাও ছিল না। কিন্তু ছিলেন সুকুমার রায়, পাগলা দাশু কিংবা অবাক জলপান। একটু জল পাই কোথা? জলপাই, এটা তো জলপাইয়ের সময় নয়...