প্রিয় মনোবন্ধু,
আমার বয়স ১২। আমার ধারণা বাবা-মা আমাকে বুঝতে চান না। সারা দিনই বকাঝকা করেন। বিতর্কে নাম দিয়েছি। এ বিষয়ে মা খুব কম অনুপ্রেরণা দেন। আর বলেন, তোমার এটা ভালো না, ওটা ভালো না, ওরা কত ভালো...। কেউ আমার কথা মন দিয়ে শুনতে চান না। যেখানে থাকি, সেখানে আমার সমবয়সী এমন কেউ নেই যার সঙ্গে কথা বা খেলাধুলা করতে পারব। বাইরেও বেশি বের হই না। স্কুলেও আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই। সারা দিন খুব একা একা কাটে। মনটা খুব খারাপ লাগে। আমার চেয়ে আমার বড় ভাইকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসব কারণে আমার মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনায়ও পিছিয়ে পড়ছি। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে আর ২–১ বছরের মধ্যে ড্রাগ নেওয়া আরম্ভ করব। জানি এটা খুব খারাপ কাজ। কী করব? কিছু বুঝতে পারি না। আমি খুব নিঃসঙ্গ। একটা সমাধান দিন প্লিজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, সিলেট
উত্তর: তুমি এত সুন্দর করে তোমার মনের কথা খুলে বলেছ, তাই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি তুমি কখনোই ড্রাগ নেবে না। মা–বাবাকে আমাদের উপদেশ জানাবে যে সন্তানকে অপরের সঙ্গে তুলনা করলে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, আর আত্মবিশ্বাস কমে গেলে বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। তুমি যদি সমবয়সী কাউকে না–ও পাও তবে তোমার চেয়ে বয়সে বড় বা ছোট, কিন্তু যার সঙ্গে তোমার মনের মিল হয়, তার সঙ্গে মিশতে পারো, খেলতে পারো। তুমি সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করতে পারো, তা হচ্ছে কিআ পড়ার পাশাপাশি আরও অনেক বই পড়তে পারো। দেশি-বিদেশি বই তোমাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। তুমি ভালো সিনেমা দেখতে পারো, গান শুনতে পারো। নিজের মতো করে গল্প, কবিতা লিখতে পারো, পাঠিয়ে দাও কিআতে। নিজেকে কখনো নিঃসঙ্গ ভাববে না। তোমার পরিবার, সহপাঠীকে মনের কথা খুলে বলতে থাকো। আর হ্যাঁ, ভুলেও কখনো ড্রাগ নয়। ড্রাগ কোনো কিছুর সমাধান নয়। তুমি এক্ষুনি ৫০টি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ বা নাটকের বইয়ের তালিকা তৈরি করে পড়তে থাকো।
প্রিয় মনোবন্ধু,
অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম লিখব। কিন্তু এ বিভাগে কখনো আমার মতো সমস্যা নিয়ে লিখতে দেখিনি কাউকে। আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। গত মে মাসে পা দিয়েছি ১৫ বছরে। কিন্তু আমাকে সামনাসামনি দেখলে কেউ ভাবেই না যে যে এই ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। চিকন, ছোট, সাত-আট বছরের বাচ্চাদের মতো মুখ। আমার বয়সী অন্য ছেলেরা ইতিমধ্যে দাড়ি রাখা শুরু করেছে। গলা মোটা হয়েছে। আর আমার এসব কোনোটাই হয়নি। রাস্তায় বের হলেই মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। ছোট বাচ্চাদের ডাকার মতো ‘বাবু বাবু’ ডেকে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। সেদিন এক দোকানদার আঙ্কেল আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবু, তুমি ছেলে না মেয়ে?’ লজ্জায় আমার তখনই দৌড়ে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। কেন শুধু আমার সঙ্গেই এমনটা হলো? সবাই সুন্দর হতে চায়। কিন্তু সৌন্দর্যও এত বিষাক্ত হতে পারে? এই একটি কারণেই কোনো ছেলে আমার বন্ধু হতে চায় না। একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে কেন বন্ধু হতে চাইবে? আমি একাই আমার ঘরে বসে থাকি প্রায় দিন। কেউ কখনো খেলতে ডাকে না আমাকে। খুব দরকার না হলে ফোন করে না। স্কুলে পরীক্ষা ছাড়া আমি যাই-ই না বলতে গেলে। কারণ অনেকবার আমাকে বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। বাইরে থেকে নরম মনে হলেও আমি খুব শক্ত ছেলে। এসবের জন্য কারও কাছে নালিশ, কান্নাকাটি করিনি কখনো। মেরে নাক ভেঙে রক্ত বের করে দিলেও তার জন্য একটা শব্দও করিনি কারও কাছে। কিন্তু এভাবে আমি আর পারছি না। নিজেকে মনে হচ্ছে একজন দ্বীপবন্দী মানুষ। কোনো বন্ধু নেই। কারও সঙ্গে কথা বলা বারণ। একা মাথা নিচু করেই হাঁটতে হবে সব সময়। নাইনের শেষ দিকে আমি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠি। কিন্তু মৃত্যুও আমার সঙ্গী হতে রাজি নয়। মৃত্যুর ওপরও আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। মরে যেতে খুব মায়া হয়, কোনো এক অজানা কারণে। কে জানে, আমি হয়তো মরতে চাই না। আমার পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা অন্তরঙ্গ নয়। তাঁরা আমার কাছে শুধু একটা জিনিসই চান, গোল্ডেন এ–প্লাস। তাঁদের সন্তান যে প্রতিটা মুহূর্তে মরে যাচ্ছে, তা নিয়ে তাঁরা মোটেই চিন্তিত নন। আমার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক এমনই যে এসব নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চিন্তাও করি না। আমার একজন বড় ভাই রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক নেই। আমার ছোটবেলার অনেক ট্রমাটিক স্মৃতির কারণ সে। আমি তাকে পছন্দও করি না। জীবনের এত সব নেতিবাচকতার পরও আমি উঠে দাঁড়াতে চাই। এ পৃথিবীর জন্য আমি কিছু করতে চাই। আমি চাই না মানুষের সামনে আমাকে জড়সড় হয়ে থাকতে হবে। আমার প্রতিভা, আমার সামর্থ্যগুলোকে আমি প্রকাশ করতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি আমার বয়সী আর দশটা ছেলের মতো আমারও একদিন বন্ধু হবে। জীবনকে নিয়ে আমি ইতিবাচক হতে চাই। আর ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকতে চাই না। আমার জীবনে এই ইতিবাচকতাগুলো আনতে আমি কী করতে পারি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: তুমি যে সমস্যা নিয়ে বলছ তা তোমার বয়সে অনেকের মধ্যেই হতে পারে। নিজের দেহকাঠামো, চেহারা নিয়ে একটা খারাপ লাগা তৈরি হতে পারে। এবং এই খারাপ লাগা তার মধ্যে একধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে। যাকে বলা হয় বডি ডিসমরফিয়া, যেখানে শরীরের গঠন, চেহারা নিয়ে পুনঃ পুনঃ চিন্তা মনের মধ্যে আসতে থাকে, যা উদ্বিগ্নতা আর বিষণ্নতা তৈরি করে। তোমার যারা বন্ধুরা রয়েছে তাদের উচিত হবে তোমাকে এ বিষয় নিয়ে তোমাকে ব্যঙ্গ না করে তোমাকে সাহস দেওয়া। তোমার বন্ধুরা যদি কেউ কিআ পড়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই তারা তাদের করণীয় বুঝতে পারবে, আর তুমি নিজেও তোমার কোনো এক–দুজন বন্ধুকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারো, তারা নিশ্চয় বিষয়টি বুঝতে পারবে এবং তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে। তোমার বাবা-মায়ের জন্য উপদেশ (এটি তুমি তাঁদের অবশ্যই দেখাবে) হচ্ছে যে জীবনে জিপিএ–৫ পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুস্থ দেহে সুস্থ মন নিয়ে একজন সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠা। জিপিএ–৫–এর টার্গেট রাখতে গিয়ে শারীরিক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে একজন ব্যর্থ নাগরিক হয়ে ওঠার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। জিপিএ–৫–ধারী অথচ সুস্থ-সুনাগরিক নন এমন মানবজীবন কখনোই কাম্য নয়। জিপিএ–৫ পেলে ভালো আর না পেলে মোটেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আর হ্যাঁ, মা-বাবাকে আরেকটি বিষয় জানতে হবে যে গোল্ডেন এ–প্লাস বলে কিছু নেই! বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্য বিেশষ করে ভাইবোনের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে তারাই তোমার সঙ্গে সহজ হতে এগিয়ে আসবে। তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি তোমার স্বপ্ন। এই পৃথিবীর জন্য তোমার কিছু করতে চাওয়া। এই স্বপ্নটাকে সব সময় আঁকড়ে ধরে রেখো। মনে রেখো একমাত্র স্বপ্ন, স্বপ্নই পারে মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে। যতক্ষণ তোমার স্বপ্ন আছে ততক্ষণই তুমি মানুষ। তুমি যেহেতু স্বপ্ন দেখছ, তাই তুমি ইতিমধ্যে একজন ইতিবাচক মানুষ। নিজের মধ্যে আরও ইতিবাচকতার চর্চা করতে চাইলে অনেক বই পড়বে; পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই। কারণ, পৃথিবীর সেরা বইগুলো কখনোই স্কুল–কলেজে পড়ানো হয় না। সেই বইগুলোতে দেখবে একেকটি চরিত্র কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, তুমি জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী, খেলোয়াড়, সেনাপতি, নেতা, লেখক, কবিদের জীবনী পড়বে। সেখান থেকে তুমি বুঝতে পারবে কীভাবে জীবনের নৌকা চালাতে হয়। নিজের চেহারা আর শরীর নিয়ে চিন্তা দূর করতে না পারলে প্রয়োজনে মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারো, ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা তোমার বাসার কাছাকাছি সরকারি মেডিকেল কলেজে যোগাযোগ করতে পারো।