বহুকাল আগে গ্রিস দেশে বাস করত নার্সিসাস নামের এক শিকারি। অমন শিকারি অবশ্য আরও অনেক ছিল সেকালে। তবে এই নার্সিসাসের বহু কিছুই ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে কোনো সাধারণ মানুষ ছিল না। কারণ নদী দেবতা সিফিসাস ছিলেন তার বাবা। আর মা লিরিউপি ছিলেন জলপরি। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় তাঁকে অপ্সরীও বলা হয়েছে। তিনিও কিন্তু মানবসন্তান ছিলেন না। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন নদী দেবতা। তবে মানবসন্তান না হওয়াটাই শুধু নয়, নার্সিসাসের ছিল আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য। সেটা হলো তার সৌন্দর্য। অমন সুন্দর চেহারা আর কারোরই ছিল না। তবে নার্সিসাস নিজে কখনো দেখেনি তার চেহারা। শুধু লোকমুখেই শুনেছিল তার সৌন্দর্যের কথা। আর তাতেই গর্বে মাটিতে পা পড়ত না তার।
একেবারে ছোটবেলায় নার্সিসাসকে নিয়ে তার মা গেলেন অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তা টারিয়েসিউসের কাছে। অন্ধ জ্ঞানীর কাছে তাঁর ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলেন লিরিউপি। ছেলের আয়ু কেমন হবে, তা–ও জানতে চাইলেন। জ্ঞানী ব্যক্তিটি বললেন, এই ছেলে বহুকাল বাঁচবে, যদি সে নিজের চেহারা না দেখে।
সেকালে তো আর নামীদামি কারখানায় তৈরি আয়না বাজারে পাওয়া যেত না। তাই চেহারা দেখাও এত সহজ ছিল না। তবু মায়ের মন বলে কথা। নার্সিসাস যেন নিজের চেহারা না দেখে সে বিষয়ে সতর্কই রইলেন তিনি। এভাবেই কেটে গেল অনেক দিন।
একসময় নার্সিসাস হয়ে গেল পরিপূর্ণ এক যুবক। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে শিকার করে সে। বাস করে থেসপি শহরে। তার সৌন্দর্য দেখে তো সবাই মুগ্ধ। লোকে তার সামনেই বলতে লাগল যে, অমন সৌন্দর্য ভূব্রহ্মাণ্ডের আর কারোরই নেই। এসব কথা শুনে তো গর্বে মাটিতে পা পড়ে না নার্সিসাসের। গর্ব-দম্ভে অস্থির হয়ে মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে লাগল সে। একদিন এমিনিউস নামের এক যুবক এল তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। কিন্তু তাকে কোনো পাত্তাই দিল না নার্সিসাস। এমন অবজ্ঞায় মনে মনে খুব দুঃখ পেল বেচারা। তবু হাল না ছেড়ে আবারও এল। এভাবে বারবার আসার পর নার্সিসাসের মন তো নরম হলোই না, বরং এমিনিউসের হাতে একটা ছুরি ধরিয়ে দিল সে। মনের দুঃখে ওই ছুরি দিয়েই আত্মহত্যা করল এমিনিউস। তবে এত কিছুর পরও নার্সিসাসের মন গলল না একটুও। হলো না কোনো অনুশোচনাও।
শুধু মানুষ নয়, পরিদের সঙ্গেও একই রকম খারাপ ব্যবহার করতে লাগল নার্সিসাস। তাদের মধ্যে বনপরি ইকোর ঘটনাটা সবচেয়ে মর্মান্তিক। ইকো ছিল একজন দুঃখী পরি। তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখের কারণ ঘটিয়েছিলেন দেবী হেরা। অভিশাপ দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন ইকোর কণ্ঠস্বর। অভিশাপের আগে খুবই মিষ্টি গলা ছিল ইকোর। কিন্তু তার ওপর রুষ্ট হয়ে দেবী অভিশাপ দিলেন যে, ইকো আর নিজে থেকে কোনো কথা বলতে পারবে না, শুধু অন্যের কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারবে, প্রতিধ্বনি তুলতে পারবে। তো, একদিন বনের মধ্যে ঘোরার সময় নার্সিসাসকে দেখতে পেল ইকো। দেখে সে তার পেছন পেছন আসতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল নার্সিসাস। সে হাঁক দিল, ‘কেউ কি আছে?’
ইকো তো আর নিজ থেকে জবাব দিতে পারে না। শুধু জানে প্রতিধ্বনি তুলতে। প্রতিধ্বনিই তুলল সে। তবে শুধু শেষ কথাটার। ইকো বলল, ‘আছে।’
এবার নার্সিসাস বলল, ‘এদিকে এসো।’ প্রতিধ্বনি তুলে ইকোও বলল, ‘এসো।’ নার্সিসাসের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গেল ইকো। অমনি কর্কশ ভাষায় ধমক দিয়ে তাকে অপমানের চূড়ান্ত করল নার্সিসাস। বলা যায়, দূর দূর করে তাড়িয়েই দিল। লজ্জায়–অপমানে ইকোর মনে হলো সে বুঝি মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। অপমানিত হয়ে দূর পাহাড়ের গুহায় গিয়ে লুকাল ইকো।
ইকোর এই অপমান দেখে তার প্রতি খুব মায়া হলো প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে মনস্থ করলেন তিনি। দেবীর ইচ্ছেতেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল নার্সিসাসের।
একদিন বনের মধ্যে হরিণ শিকারে গিয়ে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল নার্সিসাস। ঘুরতে ঘুরতে খুবই স্বচ্ছ জলের এক হ্রদের ধারে গিয়ে বসল। এই হ্রদের জল এতই স্বচ্ছ ছিল যে আয়নার চেয়েও স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা যেত তাতে। পৃথিবীর কোনো প্রাণীই আগে কখনো ওই জলে মুখ দেয়নি। অবশ্য কেউ কেউ বলেছে, ওটা হ্রদ ছিল না। ওটা ছিল ডোনাকন নদী। তো যা–ই হোক, নার্সিসাস গিয়ে বসল ওই স্বচ্ছ জলের ধারে। আর জলের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল! এত সুন্দরও কারও চেহারা হতে পারে! জলে নিজের চেহারা দেখে নিজেই পাগল হয়ে উঠল নার্সিসাস। যতই দেখে, ততই অবাক হয়। ওই চেহারাকে যেই–না ছুঁতে যায়, অমনি হাতের স্পর্শে জল নড়ে ওঠার কারণে নষ্ট হয়ে যায় চেহারার প্রতিচ্ছবি। ফলে ওই সুন্দরকে স্পর্শও করতে পারে না সে। আবার স্পর্শ না করেও তৃপ্ত হয় না। মহা অস্থিরতার মধ্যে পার হয়ে যেতে লাগল দিন-রাত। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, ঘুম নেই, তৃষ্ণা নেই। জলের ধারে বসেই রইল নার্সিসাস। যে ইকোকে এত অপমান করেছিল, সেই ইকোর মনেও ভীষণ দয়া হলো তার জন্য। কিন্তু কিছুতেই টলল না তার মন। নার্সিসাস ঠায় বসেই রইল। এভাবে থাকতে থাকতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একসময় মরেই গেল সে। তার মৃতদেহের পাশে এল ইকো। নার্সিসাসের কষ্ট দেখে তার মনও ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু নার্সিসাসের দেহটাও সে পেল না। অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। সেখান থেকে জন্ম নিল একটা ফুল। সুন্দর সেই ফুলটাও কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। অল্পতেই ঝরে যায় সেই ফুল। এই ফুলের নামও হলো নার্সিসাস, বাংলায় যাকে বলে নার্গিস। এই ফুল যেন মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনেরই প্রতীক। আর ওই যে ইকো, তার দুঃখ ঘুচল না আর। নির্জন পাহাড়–বনে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে মনের দুঃখে গুমরে মরতে লাগল সে। আর শুধুই অন্যের কথার প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। আজও সে এভাবেই প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে। সেই থেকে ‘ইকো’ কথাটা দিয়ে প্রতিধ্বনিকে বোঝানো হয়। আর নার্সিসাস কথাটাকে দিয়ে বোঝানো হয় আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মসর্বস্বতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে।ইকো তো আর নিজ থেকে জবাব দিতে পারে না। শুধু জানে প্রতিধ্বনি তুলতে। প্রতিধ্বনিই তুলল সে। তবে শুধু শেষ কথাটার। ইকো বলল, ‘আছে।’
এবার নার্সিসাস বলল, ‘এদিকে এসো।’ প্রতিধ্বনি তুলে ইকোও বলল, ‘এসো।’ নার্সিসাসের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গেল ইকো। অমনি কর্কশ ভাষায় ধমক দিয়ে তাকে অপমানের চূড়ান্ত করল নার্সিসাস। বলা যায়, দূর দূর করে তাড়িয়েই দিল। লজ্জায়–অপমানে ইকোর মনে হলো সে বুঝি মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। অপমানিত হয়ে দূর পাহাড়ের গুহায় গিয়ে লুকাল ইকো।
ইকোর এই অপমান দেখে তার প্রতি খুব মায়া হলো প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে মনস্থ করলেন তিনি। দেবীর ইচ্ছেতেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল নার্সিসাসের।
এই পুরাণকাহিনির শিক্ষা: অহংকার পতনের মূল। আত্মকেন্দ্রিক মানুষের পরিণতি খুব খারাপ হয়।