ধাঁধার দাদা

উইল শর্টজ

২৯ জানুয়ারি ধাঁধাঁ দিবস। আমার মতো এমন অনেকেই আছে, যারা পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিন হাতে পেয়ে প্রথমে ধাঁধার পাতাটা খুলে বসে। কিশোর আলো হাতে পেলে আমিও তা-ই করি। জটিল কোনো ধাঁধা কিংবা শব্দজব্দ মেলাতে মেলাতে আটকে যাই কতবার! কঠিন শব্দের প্যাঁচে পড়ে যখন আর মেলাতে না পারি, তখন ভাবি, এসব শব্দজট মানুষ বানায় কেমন করে! প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় শব্দজব্দ মেলানোর শখ থেকেই আমার পরিচয় ‘এনিগমাটোলজি’ শব্দটির সঙ্গে। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পেলাম পৃথিবীর একমাত্র এনিগমাটোলজিস্টের পরিচয়। লোকটাকে দেখে বেশ পরিচিত মনে হলো।

এনিগমাটোলজি হলো ধাঁধাবিষয়ক পড়াশোনা। শুনেই কেমন অবাক লাগে না? ধাঁধার আবার পড়াশোনা আছে? এটা শুনলে যে কারোরই চোখ কপালে ওঠার কথা। এনিগমাটোলজি কোনো সহজলভ্য বিষয় নয়। এ বিষয়ের একমাত্র যিনি ডিগ্রিধারী, তিনিও ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে বিষয়টি খুঁজে পেয়েছেন বহু কষ্টে, সেটিকে আবার নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

উইল শর্টজ ছোটবেলা থেকেই ধাঁধা মেলানো এবং নতুন নতুন শব্দজব্দ বানাতে পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর প্রথম ধাঁধাটি বিক্রি করেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। সেই থেকে ধাঁধা নিয়েই পেশাগত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সেই স্বপ্ন সত্যি করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। তবে হাল না ছেড়ে বিকল্প একটা পদ্ধতি বেছে নেন তিনি। ওকালতি পড়ে পেশাদার উকিল হয়ে প্রচুর টাকাপয়সা জমিয়ে তারপর ধাঁধা তৈরিতে মনোনিবেশ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু ওকালতি পড়া শেষ করে বার পরীক্ষা দেওয়ার আগেই খোঁজ পান ধাঁধাবিষয়ক পড়াশোনার। অমনি সব ছেড়েছুড়ে পড়তে শুরু করেন এনিগমাটোলজি। তারপর? নিজের শখ পূরণের সুযোগ তো পাওয়া গেল। কিন্তু ধাঁধা মিলিয়ে, ধাঁধা বানিয়ে কি জীবন চলবে! তাই এই পড়াশোনায় অনেকেই বাধা দেন তাঁকে। কিন্তু সব চড়াই–উতরাই পার করে বেশ ভালোভাবেই শেষ করেন এই পড়াশোনা। বনে যান পৃথিবীর একমাত্র ডিগ্রিধারী এনিগমাটোলজিস্ট। এরপর উইলকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এমন অন্য রকম ডিগ্রি নিয়েই ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি পাজল মাস্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে। ১৯৯৩ সালে যুক্ত হন বহুল আলোচিত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদক হিসেবে। সেখানেও তিনি করছেন তাঁর সবচেয়ে পছন্দের কাজ। শব্দজব্দ বানানো ও সম্পাদনা। এ ছাড়া ১৫ বছর ধরে গেমস ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার আমেরিকান ক্রসওয়ার্ড পাজল টুর্নামেন্ট, ওয়ার্ল্ড পাজল চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিষ্ঠাতাও। এর মধ্যে বাজারে আছে তাঁর লেখা পাজলবিষয়ক পাঁচ শতাধিক বই।

উইল শর্টজ ছোটবেলা থেকেই ধাঁধা মেলানো এবং নতুন নতুন শব্দজব্দ বানাতে পছন্দ করতেন
এনিগমাটোলজি হলো ধাঁধাবিষয়ক পড়াশোনা। শুনেই কেমন অবাক লাগে না? ধাঁধার আবার পড়াশোনা আছে? এটা শুনলে যে কারোরই চোখ কপালে ওঠার কথা।

নিউইয়র্ক টাইমস–এ কাজ শুরু করার পর তিনি শব্দজব্দের জগতে আমূল পরিবর্তন আনেন। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ধরন যুক্ত করা শুরু করেন। তাঁর বানানো সবচেয়ে আলোচিত শব্দজব্দটি ছিল ১৯৯৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনের দিনের। বিল ক্লিনটন ও বব ডোলের মধ্যে কে রাষ্ট্রপতি হবেন, তা নিয়ে সবার মধ্যে উত্তেজনা। উইলের শব্দজব্দে ১৪ ঘরের শব্দে ক্লু দিয়ে বসলেন, ‘আগামীকালের পত্রিকার প্রধান সংবাদ’। যাঁরা এটি মেলাতে পারেননি, তাঁরা মুখিয়ে ছিলেন পরের দিনের পত্রিকার জন্য। পরদিন পত্রিকা হাতে নিয়েই পেয়ে গেলেন ধাঁধার উত্তর ‘CLINTON ELECTED’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেদিন ক্লিনটন না জিতে বব ডোল জিতে গেলেও ধাঁধা ঠিকই মিলে যেত।

উইল শর্টজের জীবনকাহিনি থেকে এমন অনেকেই অনুপ্রেরণা পান, যাঁরা নিজের শখকেই পেশায় পরিণত করতে চান। উইল একজন সুবক্তাও বটে। তিনি বিভিন্ন সময় থিয়েটার, লাইব্রেরি, কলেজে বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকেন। তিনি ধাঁধা, শব্দজব্দ, এসবের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বেশ পছন্দ করেন। ধাঁধা নিয়ে আগ্রহ যাঁদের, তিনি তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশ পছন্দ করেন।

পৃথিবীজোড়া খ্যাতিমান পাজল মাস্টার উইল শর্টজকে নিয়ে আরও জানতে গিয়ে দেখি, তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যাটম্যান ফরএভার-এর জন্য ধাঁধা লিখেছেন এবং তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি প্রামাণ্যচিত্রও রয়েছে। কিন্তু এত সব তথ্য জানলাম, সবই আমার কাছে নতুন। তাহলে কেন এত পরিচিত লাগছিল তাঁকে! এসব ভেবেই রাতে ঘুমোতে গেলাম। চোখ বন্ধ করে শুতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিখ্যাত আমেরিকান টিভি সিরিজ ‘ব্রুকলিন নাইন-নাইন’-এর দ্য পাজল মাস্টার পর্বের কথা। সেখানে যে পাজল মাস্টারকে মূল চরিত্র জ্যাক সন্দেহ করেন, তিনিই কি উইল শর্টজ? তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে ঢুঁ মারলাম ইন্টারনেটে। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই পর্বে রাস্তার পাশে বসে নুডলস খাওয়া লোকটাই তো তিনি। উইল শর্টজ, বিখ্যাত পাজল মাস্টার।