দিনটা অন্য রকম

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

স্কুল থেকে ফিরেই খুব খুশি হলো স্বাগতা। কারণ, আজ তাদের বাসায় তার আড়াই বছরের বড় ফুফাতো বোন প্রমা বেড়াতে এসেছে। বয়সে বড় হলেও প্রমা স্বাগতার অন্যতম প্রিয় বন্ধু। গল্প করে তারা কখনো ক্লান্ত হয়নি। তাই স্বাগতা স্কুল শেষ করে ফেরার পর থেকে প্রায় সারা রাত তাদের গল্প চলতে থাকে। নানা বিষয়ে গল্প। পৃথিবীতে বিভিন্ন জীবের বৈচিত্র্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেট—কোনো কিছুই বাদ যায় না তাদের আলোচনা থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে এমনই সব গল্প করতে করতে প্রমা স্বাগতাকে জিজ্ঞাসা করল, আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে তার পরিকল্পনা কী। স্বাগতা জানাল, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একটি মহৎ কাজ করার পরিকল্পনা করেছে। আর মহৎ কাজটা হলো কাল সারা দিন কোনো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করবে না সে। প্রমা মুচকি হেসে বলল, ‘তা তোমার মতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কত?’ ‘উমমম…অ্যাট লিস্ট এইটি পারসেন্ট।’ স্বাগতার উত্তর। প্রমা আরও একটু হেসে বলল, ‘আমার মতে, এই সম্ভাবনা ১০ শতাংশ। কারণ, প্রতিদিন আমরা অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তাই তুমি না চাইলেও প্রতিদিনের অভ্যাসমতো অনেক ইংরেজি শব্দ তোমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবেই।’ স্বাগতা খানিকটা রাগ করে বলল, ‘দেখা যাবে।’ প্রমা ওর রাগটা বুঝতে পেরে বলল, ‘আচ্ছা তুমি একটু মনে করে দেখো শেষ ১০টা বাক্যে তুমি কয়টা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছো।’ বলা বাহুল্য, হিসাব করে সংখ্যাটি যা দাঁড়াল, তা যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিল স্বাগতাকে। তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে মনে মনে ঠিক করে নিল, কাল সারা দিন কম কথা বলবে (যদিও তা প্রায় অসম্ভব)। আর কিছু বলার আগে ব্যবহার করতে যাওয়া বাক্যগুলো একবার ভালো করে যাচাই করে নেবে, যেন সেগুলোতে কোনো ইংরেজি শব্দ না থাকে।

স্বাগতা রেগে গিয়ে প্রমাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে আমি স্কুল বাসটা মিস করলাম।’ প্রমা হাসতে হাসতে বলল, ‘দিন শুরুই হতে পারল না, এরই মধ্যে তুমি একটা বাক্যে পরপর তিনটি ইংরেজি শব্দ, পণ রক্ষা করা হলো না!’

পরদিন সকালবেলা যখন ওর মা ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গেলেন ও অভ্যাসবশত ‘আর জাস্ট পাঁচ মিনিট’ বলতে গিয়েও থেমে গেল। পাশে প্রমা গোয়েন্দার মতো বসে রয়েছে তার ভুল ধরার জন্য। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়তে হলো স্বাগতাকে। বলা যায় না, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ঘুমের ঘোরে ভুল হয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রওনা দেওয়ার আগ পর্যন্ত বাসার সবাই ওকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল প্রমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে কি না। কারণ, নিজের পণ রক্ষা করতে গিয়ে একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে ও। বের হওয়ার সময় প্রমা বলল, স্বাগতাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে সে। এরপর যা হওয়ার তা–ই হলো। নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে ওর রাস্তায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। স্বাগতা রেগে গিয়ে প্রমাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে আমি স্কুল বাসটা মিস করলাম।’ প্রমা হাসতে হাসতে বলল, ‘দিন শুরুই হতে পারল না, এরই মধ্যে তুমি একটা বাক্যে পরপর তিনটি ইংরেজি শব্দ, পণ রক্ষা করা হলো না!’ স্বাগতা বেশ লজ্জা পেল। তারপর সারা দিন চেষ্টা করে পুরোপুরি না পারলেও সে ইংরেজি শব্দ অনেকটাই বর্জন করতে পারল। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বেশ গর্ববোধ হলো তার। সে মনে মনে ভাবছিল, নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা কত সহজ। প্রতিদিন অকারণে বিদেশি ভাষা ব্যবহার করে আমরা যেন আমাদের মাতৃভাষাটাকে পরাধীন করে ফেলেছি। ভাষাতে নতুন শব্দ আসবে। তবুও সবাই যদি নিজের ভাষাটাকে সম্মান করার চেষ্টা করে, তবে অন্য রকম গর্বের একটা ব্যাপার হবে, ভাবতেই ভালো লাগে ওর।

আরও পড়ুন