অনুপ্রেরণা
তাঁহাদের স্বপ্ন দেখা
কিছু মানুষের জীবনে ব্যর্থতার গল্প একদমই থাকে না। কারণটা কী, জানো?
তারা আসলে সফলতার জন্য চেষ্টাই করে না! আর যে মানুষগুলোর জীবনে সাফল্য আসে, তাদের কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লা একদম হালকা নয়। তবে ওই ব্যর্থতাগুলোর কারণে হতাশ না হয়ে তারা শিক্ষা নেয় সেখান থেকে; ভেবে বের করে, কেন তারা ব্যর্থ হলো, ভবিষ্যতে যেন সেই একই ভুল না করে তারা, সে বিষয়ে চেষ্টা করে আন্তরিকভাবে।
চলো, আজ শুনি তেমন তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তির হাল না ছাড়ার গল্প!
কোয়ান্টাম মেকানিকস কোর্স
গল্পের ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন আহমেদের কথাই ধরো! লেখালেখির পাশাপাশি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্র পড়াতেন তিনি। এ বিষয়ে পিএইচডি করতে তখন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন হুমায়ূন। কোয়ান্টাম মেকানিকস কোর্সের ক্লাস। একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে অবাক হলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী তিনি দেখেননি, তা নয়; কিন্তু সেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিষয় ছিল কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান, কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিকস টাইপের কিছু নয়।
লেখক হুমায়ূন ওই দিন ক্লাসে কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। ক্লাস শেষে ওই অন্ধ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে?’
‘কেন বুঝব না? এসব তো খুবই এলিমেন্টারি ব্যাপার!’ ছেলেটি বিস্মিত হলো।
পরবর্তী সময়ে তিনি খুব বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু লাভ হলো না। পরীক্ষার দিন সাদা খাতা জমা দিয়ে বের হলেন তিনি। পরদিন প্রকাশিত ফলাফলে জানা গেল তিনি পেয়েছেন শূন্য।
আর ওই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেটি পেয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর!
কোর্স শিক্ষক ডেকে পাঠালেন হুমায়ূন আহমেদকে। বললেন এই কোর্স ছেড়ে দিতে।
হুমায়ূন বলেন, তিনি এই কোর্স করবেন; একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে পারলে তিনি কেন পারবেন না এটি শিখতে?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। হুমায়ূন পরিশ্রম করলেন বেশ। আর তার ফলাফল?
পরবর্তী সময়ে এই কোর্স পরীক্ষায় ১০০–তে ১০০ পেলেন তিনি, শুধু তা-ই নয়, কোর্স শিক্ষক তাঁকে ফেলোশিপেরও ব্যবস্থা করে দিলেন!
অন্ধকার দারিদ্র্যের পাতাল থেকে
সফলতা কিন্তু এক রাতে আসে না। বারবার হোঁচট খাওয়া কিন্তু হার না মানার গল্প থাকে প্রত্যেক সফল মানুষের জীবনে। ভারতীয় বিজ্ঞানী মণিলাল ভৌমিকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের এক হতদরিদ্র পরিবারে। তাঁর স্কুলশিক্ষক বাবাকে প্রায়ই পালিয়ে থাকতে হতো, কেননা, তিনি তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। নীচু জাতের হওয়ায় বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয় মণি ভৌমিককে। দুর্ভিক্ষে মারা যান তাঁর ঠাকুমা। পড়াশোনা করাটাও সহজ ছিল না। বাড়ি থেকে চার মাইল দূরে পাঠশালা। হাঁটুডোবা কাদাপথ পেরিয়ে খালি পায়ে রোজ ক্লাসে যেতেন তিনি। আর তাঁর অন্তরে সব সময় ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরার উপদেশ, ‘কখনো হাল ছাড়বি না!’
পরবর্তী সময়ে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্য লাভ করেন মণি ভৌমিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেন লেজার রশ্মি নিয়ে। পান খ্যাতি ও অর্থনৈতিক সাফল্য। নিজের জীবন সম্বন্ধে তিনি লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিক বিত্তবান এবং খ্যাতিমানদের মধ্যে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল আমার যে সাফল্য, তা কিন্তু এসেছিল বছরের পর বছর কঠিন পরিশ্রমের পরে। অনেক সময় পায়ের তলায় মাটিই ছিল না। এই খাড়াই বেয়ে ওঠার পথ শুরু হয়েছে আমার শৈশবের অন্ধকার দারিদ্র্যের পাতাল থেকে।’
ডিজনির কল্পনাশক্তি
একটা ব্যাপার কিন্তু সত্যি, অনেক সময় আমাদের অনেকেরই মনে হয়, যা চাইছি, তা ঠিক পাচ্ছি না। চারপাশের মানুষগুলো মনে হয় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে! জীবনটা একদম অগোছালো লাগছে।
এমনই অনুভূতি হয়েছিল ওয়াল্ট ডিজনির। জীবনটা তাঁর সহজ ছিল না। কার্টুন সিনেমা নিয়ে যদি ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যাস থাকে তোমার, তাহলে এই জগতে সফলতম ব্যক্তিদের একজন ওয়াল্ট ডিজনিকে তুমি চেনো না, এ কথা নিশ্চয়ই কেউ সহজে মেনে নেবে না?
ডিজনির জীবনেও এমন অভিজ্ঞতা এসেছিল। এসেছিল ব্যর্থতা। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
তোমার কাছে হয়তো ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনাশক্তি চমৎকার মনে হয়।
কিন্তু মজার কথা জানো, যে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে চাকরি করতেন তিনি, সেখান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর বসের মতে, ডিজনির কল্পনাশক্তির অভাব ছিল এবং তাঁর আইডিয়াগুলো একটুও ভালো ছিল না। ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করেন ডিজনি। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতা। দেউলিয়া হন তিনি।
কাজেই বুঝতে পারছ, ঠিক কী অবস্থায় পড়েছিলেন এই উদ্যোক্তা!
তারপরও তিনি স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। ক্লান্ত হননি তিনি। একসময় সাফল্য লাভ করেন, আর তা ছিল বিশাল পরিসরের! ২২টি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৫ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ডিজনিল্যান্ড। এখনো সিনেমা তৈরি, থিম পার্ক ও পণ্য বিক্রির মাধ্যমে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি বিলিয়ন ডলার আয় করছে প্রতিবছর!
সূত্র: হোটেল গ্রেভার ইন—হুমায়ূন আহমেদ, বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত—মণি ভৌমিক, আনস্টপেবল প্রফিটস, সাকসেস ডটকম।