পুরো অঞ্চল বরফে মোড়া। চলছে তুষারপাত। বরফের মধ্যে উড়োজাহাজ ধরনের বিশালাকার যান খুঁজে পেয়েছেন একদল অভিযাত্রী। যানটির ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল আরও অদ্ভুত জিনিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক বিখ্যাত সেনার শিল্ড বা ঢাল রয়েছে ককপিটের পাশে। অভিযাত্রীরা বুঝে গেলেন কোনো সাধারণ উড়োজাহাজ নয় এটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা নিয়েই বরফের অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিলেন ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’!
২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজের চলচ্চিত্র ক্যাপ্টেন আমেরিকা: দ্য ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার চলচ্চিত্রের শুরুর দিকের ঘটনা এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া সেই উড়োজাহাজের সন্ধান পাওয়া যায় প্রায় ৭০ বছর পরে।
শুধু বরফ নয়, বাস্তবেও এমন অনেক নমুনা পাওয়া যাবে পানির নিচে। জানোই তো, কী বিশাল বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা রয়েছে এই পৃথিবীতে! পানির নিচের বিশাল এই অঞ্চল রহস্যে ঘেরা। লাখ লাখ প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ছবি তুলতে প্রতিনিয়ত রীতিমতো অভিযানে যান ফটোগ্রাফাররা। পানির নিচের অপরূপ এই জগতের ছবি তোলা অনেকেরই নেশা। দারুণ অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এই ফটোগ্রাফারদের অভিজ্ঞতা। বিস্ময়কর তাঁদের সব ছবি। প্রতিবছরই ‘আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় সেসব ছবি নিয়ে। ১১টি ক্যাটাগরিতে নির্বাচন করা হয় সেরা আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার।
১৯৬৫ সালে প্রথম এমন এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন বার্নার্ড ইটন। তখন প্রতিযোগিতার নাম ছিল ‘ব্রাইটন আন্ডারওয়াটার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ১৯৬৫’। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি অব দ্য ইয়ার’ ও ‘ব্রিটিশ ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডস’–এর আয়োজন করা হয়েছিল। সে অনুপ্রেরণায় ৫০ বছর পর আবার ‘আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’ প্রতিযোগিতাটি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয় ব্রিটেনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ছিল ১৯৩৯-৪৫ সাল। অবর্ণনীয় এর ভয়াবহতা। সে সময় অসংখ্য যুদ্ধজাহাজ ভেসে বেড়িয়েছে পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে। বহু জাহাজ ক্ষতবিক্ষত হয়ে হারিয়ে গেছে সাগরের অতল গহ্বরে। জাহাজের সঙ্গে সাগরেই সমাহিত হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনারা। তাঁদের পরিবার, সন্তানেরা তাঁদের লাশের সন্ধানও পাননি। কিন্তু পানির নিচে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এসব জাহাজের বিভিন্ন ছবি তুলে এনেছেন বেশ কয়েকজন আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার।
স্টিভ জোনস এমনই একজন। ব্রিটিশ আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক তিনি। তিন দশকের ক্যারিয়ারে তাঁর পুরস্কার পাওয়া বিভিন্ন কাজ ৩০টি দেশে প্রকাশিত হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার একটি দ্বীপের জলদেশ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউএস বম্বার বি-১৭জির ছবি সংগ্রহ করেন তিনি। ১৯৪৪ সালে শত্রুর বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পানিতে ডুবে যায় বিমানটি। মারা যান বিমানের পাইলট আর্নেস্ট ভিয়েনাউ। সমাহিত হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আর্নেস্ট পরিবারের। ছবিগুলো আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় প্রকাশিত হওয়ার পর স্টিভের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁরা।
স্টিভ আরও তুলেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস অডেশিয়াস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এসএস এম্পায়ার হেরিটেজসহ বিভিন্ন ধরনের ছবি। তাঁর মতে, এই ধ্বংসাবশেষগুলো বহু বছর ধরে পানির নিচে রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
পানির নিচের ফটোগ্রাফি অন্যান্য ফটোগ্রাফির চেয়ে আলাদা বটে। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ যন্ত্রপাতি ও কৌশল। এই ফটোগ্রাফিতে সাধারণত বিভিন্ন জলজ প্রাণী বা স্তন্যপায়ী প্রাণীর ছবি তোলা হয়। এ ছাড়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ, পানির তলদেশের গুহা, সি-উইডস, ভূ-তাত্ত্বিক গঠনসহ বিভিন্ন ছবি তোলেন ফটোগ্রাফাররা।
অ্যান্ডার্স নাইবার্গ, একজন সুইডিশ ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। তিনি আশেপাশের সাধারণ জিনিসগুলো সাগরের গভীরে অসাধারণভাবে দেখাতে পছন্দ করেন। নাইবার্গের ফটোগ্রাফির জন্য প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি এসএস থিসেলগর্ম ধ্বংসাবশেষ এলাকা। সেখানে তিনি অসাধারণ সব ছবি তুলতে পেরেছেন। কিন্তু নাইবার্গের জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি তিনি ক্যামেরাবন্দী করতে পারেননি।
১৯৪২ সাল। তিনি ও তাঁর স্ত্রী এস এস প্রেসিডেন্ট কুলিয়েজ এ ভানুয়াতুর এসপারো সান্টো দ্বীপে তখন। হঠাৎ করে কার্গো কক্ষগুলো নীল ঝলকানো আলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আলো তাঁকে এতটায় চিত্তাকর্ষকভাবে ঘিরে ধরে যে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে যান।
আলোগুলো আসলে সৃষ্টি হয়েছিল একঝাঁক মাছের চোখ থেকে। নাইবার্গের মতে, ওই সব জায়গায় ঘোরা তার কাছে একধরনের মেডিটেশনের মতো; যা প্রাত্যহিক জীবনের চিন্তা ও সমস্যা থেকে দূরে মনকে সরিয়ে রাখে। নাইবার্গের ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, লোহিত সাগর থেকে তোলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ব্রিটিশ বিএসএ এম২০ মোটরবাইক ও ১৯০৫ সালের বাল্টিক সাগরের ঘুরে বেড়ানো জার্মান কার্গো স্টিমার দ্য এসএস হর্নস্টেইন।
ফটোগ্রাফার, ডিজাইনার ও লেখক জেনিফার আইডল হলেন প্রথম মহিলা মার্কিন ডাইভার, যিনি ৫০টি রাজ্যেই কাজ করেছেন। আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন যে ব্যাপারটি, সেটি হলো পানির নিচে প্রবেশের পর তিনি এক নতুন জগতে চলে আসেন। তিনি উপভোগ করেন পুরোটা সময়। পুরোনো জাহাজ বা অন্যান্য জিনিসের ছবি তুলতে, ক্যামেরাবন্দী করতে তাঁর অসাধারণ লাগে।
এমন অনেক আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার পানির নিচে ছবি তুলে যাচ্ছেন। নানা অজানা-অদেখা বিষয় নিয়ে এসেছেন পৃথিবীর সামনে। যেমনটা পাইলট আর্নেস্ট ভিয়েনাউয়ের পরিবার খুঁজে পেয়েছে। আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি ভবিষ্যতে ফটোগ্রাফি জগতে এক অন্যতম অধ্যায় সৃষ্টি করবে—তা বলতে বাকি রাখে না।