ক্রিকেট
ডাবল সেঞ্চুরি: মারডক থেকে রুট
টেস্টে দ্বিশতক খুবই অদ্ভুত একটা গণ্ডি। ক্রিজে নেমে শতক হাঁকানো যতটা সোজা, শতক থেকে দ্বিশতকে যাওয়া তার চেয়ে হাজার গুণে কঠিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিচ, বল হয়তো বন্ধু হয়ে যায়, কিন্তু ধৈর্য আর বাঁধ মানে না। দিন শেষে যাঁরা টিকে থাকতে পারেন, তাঁরাই পার হতে পারেন এই বৈতরণি। দ্বিশতকের তরণিতে এসে দেখা যায়, পাকা ব্যাটসম্যানদেরও ছাড়িয়ে গেছেন বোলাররা। ওয়াসিম আকরামরা ছাড়িয়ে বসে আছেন শচীনের মতো তারকাকে। আজ দ্বিশতকের গল্পই করা যাক।
দ্বিশতকের সূচনা
বাংলা রচনার মতো করেই শুরু করা যাক, প্রথমেই সূচনা। সূচনা বলে অন্য সব কথায় মুখর করব না; বরং সরাসরি প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির কথায় আসা যাক। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা মেলে ষোড়শ টেস্ট ম্যাচে। তখন অবশ্য টেস্ট খেলতই মাত্র দুটো দল—অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। সেটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার চতুর্থ ইংল্যান্ড সফর। এক বছর পরপর অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড বিশাল বহর নিয়ে সমুদ্রভ্রমণে বের হতো। মাস পেরিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে সফরটাও হতো তেমন লম্বা। মাঝেমধ্যে পুরো গ্রীষ্ম কিংবা শীত কাটিয়ে নিজ দেশে ফিরত অন্য দল। সে হিসেবে ১৮৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়া দল রওনা হলো ইংল্যান্ডের উদ্দেশে। সেটা ছিল সিরিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ। প্রথম দিনে ব্যাটিংয়ে নামেন অস্ট্রেলিয়ান উইকেটরক্ষক-অধিনায়ক বিলি মারডক। প্রথম দিন শেষে বিলি অপরাজিত ছিলেন ১৪৫ রানে। তখন পর্যন্ত কেউই ছুঁতে পারেননি চার্লস ব্যানারম্যানের ১৬৫ রানের অপরাজিত ইনিংসের রেকর্ড। প্রথম সেশনেই সেই রেকর্ড ভেঙে ফেললেন বিলি। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়লেন বিলি মারডক। কেনিংটন ওভাল ছিল দ্বিতীয় মাঠ, যে মাঠে আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলা শুরু হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের বিপরীতে ছিল ইংল্যান্ডের ওভাল। মেলবোর্ন যদি সাক্ষী হয় প্রথম টেস্টের, তবে ওভাল সাক্ষী হয়েছিল প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরির।
কথায় আছে, একবার যখন একটা রেকর্ড ভাঙা হয়, তারপর শুরু হয় জনস্রোত। একজনের পর একজন সেই স্রোতে গা ভাসাতেই থাকে, নিজের নাম টুকতেই থাকে রেকর্ডবুকে। যদিও এরপরের টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি এসেছিল ঠিক ছয় বছর পর, আরেক অস্ট্রেলিয়ান সিড গ্রেগরির হাত ধরে। আর এর ৯ বছর পর এসেছিলে তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। এবার আর অস্ট্রেলিয়ান নয়, ইংলিশ ব্যাটসম্যান টিপ ফস্টারের ব্যাটে। একে একে ডাবল সেঞ্চুরির গণ্ডি পার হয়েছেন মোট ১৯১ জন, সর্বশেষ জো রুটের দ্বিশতক নিয়ে দ্বিশতকের সংখ্যা এখন মোট ৩৯৫।
ধৈর্যশীল বনাম ধৈর্যহীন
টেস্ট হলো ধৈর্যের খেলা। কেউ কেউ আবার ধৈর্যের পরীক্ষাকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। টেস্ট ম্যাচে পিচকে বানিয়ে ফেলেন নিজের ঘরবাড়ি। তবে ধৈর্যের পরীক্ষায় বাঁধ ভাঙার রেকর্ড গড়েছেন ব্রেন্ডন কুরুপ্পু। লঙ্কান ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারটা তেমন বড় নয়। খেলেছেন মাত্র ৪টি টেস্ট, ৭ ইনিংসে রান মাত্র ৩২০। তবে এর মধ্যেই যে রেকর্ড গড়ার, তা গড়ে ফেলেছেন। ১৯৮৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে ওপেনিং করতে যে নেমেছিলেন, ব্যাটিং ছেড়েছিলেন টেস্টের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনে। এর মধ্যে খেলেছেন ৫৪৮ বল, ঘণ্টার কাঁটায় পার হয়েছে ১৩ ঘণ্টা। এরপর নিজের ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে মাঠ ছাড়লেন ডন সরধা ব্রেন্ডন প্রিয়ান্থা কুরুপ্পু। তত দিনে ধরাছোঁয়ারই বাইরে চলে গেছেন ব্যাট হাতে। মোট ১৩ ঘণ্টা ক্রিজে থেকে সবচেয়ে বেশি সময় ও বেশি বল খেলে টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। ৩৩ বছর ধরে সে রেকর্ড অটুট। যদিও সময়ের হিসেবে তাঁর থেকে বেশিক্ষণ ক্রিজে টিকে দ্বিশতকের কোটা শেষ করার রেকর্ড করেছেন আরও দুজনের—গ্যারি কারস্টেন ও অ্যালিস্টার কুক। কিন্তু দুজনই ২০০ রান ছুঁয়েছেন কুরুপ্পুর চেয়ে কম সময়ে, এমনকি কম বলেও। বাকি ইনিংস খেলতে খেলতে পার হয়ে গেছেন কুরুপ্পুর মোট ইনিংসের সময়। ২০০ ছোঁয়ার বেলায় তাঁরা কেউই ভাঙতে পারেননি কুরুপ্পুর রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি বল খেলে ২০০ রান ছোঁয়ার রেকর্ড তাই ৩৩ বছর পরও লঙ্কান ওপেনারের হাতে।
তবে সবাই কুরুপ্পু, কুক, কারস্টেনের মতো ধৈর্যশীল নন। টেস্ট ক্রিকেটে সামান্য উঠিয়ে মারলেই যেখানে অহরহ রান পাওয়া যায়, সেখানে বসে থাকার প্রয়োজনীয়তা কী? চাইলেই যেখানে অফুরন্ত রানের সুযোগ, বালাই নেই ফিল্ডিং পজিশনের, সেখানে রান তোলা তো সহজ কাজ। টেস্ট বলেই যে দেখে-শুনে-বুঝে খেলতে হবে, উইকেটে পড়ে থাকতে হবে, এমনটা কিন্তু সবার মনোভাব নয়। উইকেটের ধৈর্যশীল মানুষের কথা যেহেতু এসেছে, তখন ধৈর্যহীন মানুষদের কথাও শোনা যায়। সাদা জার্সিতে সবচেয়ে কম বলে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড কিউই ব্যাটসম্যান নাথান অ্যাস্টলের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চে মাত্র ১৫৩ বলে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান অ্যাস্টল। কেউ ১০০–র ওপর স্ট্রাইকরেট নিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারেন, অ্যাস্টলের ইনিংসের আগে এই ভাবনাই ছিল না কারও। যদিও ২০১৬ সালে বেন স্টোকস পৌঁছেছিলেন খুব কাছাকাছি, ১৬৩ বলে করা ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে দ্বিতীয়তে। তৃতীয় আর চতুর্থ স্থান দখল করে আছেন ভারতের বীরেন্দর শেবাগ।
যদিও মিনিটের হিসাবে সবচেয়ে কম সময়ে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটা অল্পের জন্য মিস করে গেছেন অ্যাস্টল। এ রেকর্ড গত ৯১ বছর টিকিয়ে রেখেছেন ডন ব্র্যাডম্যান। ২১৪ মিনিট বা ৩ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটে করা ডাবল সেঞ্চুরি এখনো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কম সময়ে হাঁকানো দ্বিশতক। অ্যাস্টলের লেগেছিল এর চেয়ে ৩ মিনিট বেশি।
কনিষ্ঠ বনাম বয়োজ্যেষ্ঠ
ক্রিজের সময়ের হিসাব-নিকাশ যখন এসেছে, তখন বয়সের হিসাব-নিকাশেও ঢুঁ দিতে দোষ কী? টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড পাকিস্তানের জাভেদ মিঁয়াদাদের। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ ছিল সেটা। করাচিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জাভেদ মিঁয়াদাদ ইনিংস শেষ করেছিলেন ৪১০ বলে ২০৬ রান করে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর ১৪০ দিন। আর তা দিয়েই তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন ৪৬ বছরের পুরোনো রেকর্ড। ১৯৩০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান জর্জ হ্যাডলির ২০ বছর ২০৮ দিনে করা ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড এখনো রেকর্ডবুকে দ্বিতীয় হয়েই আছে। ১৯৭৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মিঁয়াদাদের রেকর্ডে কেউ টেক্কা দিতে পারেননি।
কনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের রেকর্ডের বয়স শুনে যদি অবাক হও, তবে বয়োজ্যেষ্ঠর রেকর্ড পড়ার আগে আশপাশের কিছু একটা ধরে নাও। এ রেকর্ড টিকে আছে ৭১ বছর ধরে। সেই ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন এক দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান। নাম তাঁর এরিক রোয়ান। ২৩৬ রানের ইনিংস খেলার দিন তাঁর বয়স ছিল ঠিক ৪২ বছর ৬ দিন। এখনকার যুগে ৩০-৩৫ পার হলেই যেখানে কথা ওঠে অবসরের, সেখানে ৪২ বছর বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন এরিক। এরপরের স্থানটা স্যার জ্যাক হবসের। ১৯২৪ সালে লর্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই ৪১ বছর ১৯৫ দিন বয়সে ডবল হাঁকিয়েছিলেন এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান।
রেকর্ডবুকের টুকিটাকি
টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের রেকর্ডবুক লেখা হবে আর স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নাম আসবে না, তা কি হয়? টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে তিনি সবার ওপরে। ১১টি দ্বিশতক নিয়ে এরপরই আছেন শ্রীলঙ্কার উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা। ২০১৫ সালে তড়িঘড়ি বিদায় না জানালে হয়তো ব্র্যাডম্যানকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতেন ‘সাঙ্গা’। এ ছাড়া ব্রায়ান লারা আছেন ৯টি দ্বিশতক নিয়ে তৃতীয়তে। বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে বিরাট কোহলি সাতটি ডবল সেঞ্চুরি নিয়ে যৌথভাবে চতুর্থ।
টেস্টে অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি আছে মোট পাঁচজনের।
নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে নেমে ডবল সেঞ্চুরি আছে জেসন গিলেস্পির।
২৯৯ রানে আউট হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার মার্টিন ক্রো। বেচারার ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ রান এটাই, ত্রিশতক ছুঁতে পারেননি আর কোনো দিন। আর ২৯৯ রানে অপরাজিত থাকার একমাত্র রেকর্ড স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের।
সবচেয়ে বেশি ৬ মেরে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরামের। অপরাজিত ২৫৭ রানের ইনিংসে ছিল ১২টি ছক্কা।
সবচেয়ে বেশি ৪ মেরে ডবল হাঁকানোর রেকর্ড বীরেন্দর শেবাগের, ২৫৪ রানের এক ইনিংসে মেরেছিলেন ৪৭টি চার।
ডে-নাইট টেস্টে একমাত্র ডবল সেঞ্চুরিয়ান ইংলিশ ওপেনার অ্যালিস্টার কুক। ২০১৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেছিলেন ২৪৩ রান।
১ থেকে ৮, প্রতিটি পজিশনে নেমেই ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড আছে টেস্ট ব্যাটসম্যানদের।
এক টেস্টে দুই ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড নেই কারও। তবে ব্যাক টু ব্যাক দুই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড আছে মোট ছয়জনের। এর মধ্যে ইংলিশ ব্যাটসম্যান ওয়ালি হ্যামন্ড এ রেকর্ড গড়েছেন দুবার। এ তালিকায় আরও রয়েছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, বিনোদ কাম্বলি, কুমার সাঙ্গাকারা, মাইকেল ক্লার্ক আর বিরাট কোহলি।
টেস্টে শচীন টেন্ডুলকারের সর্বোচ্চ রান ২৪৮। ক্যারিয়ারে কখনো ৩০০–র দেখা পাননি ‘লিটল মাস্টার’।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি মুশফিকুর রহিমের।