কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রথম দেখি ১৯৯৭ সালে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে। চুটিয়ে লিখতাম তাঁর সম্পাদিত মাসিক কিশোর পত্রিকায়, যেটি এখন আর প্রকাশিত হয় না। লেখার সম্মানী আনতে এবং নতুন লেখা জমা দেওয়ার জন্য বাবার সঙ্গে মাঝে মধ্যে ঢুঁ মারতাম সেবা প্রকাশনীতে। ওখান থেকেই বেরোত পত্রিকাটি।
একদিন কিশোর পত্রিকা অফিসে কাজ সেরে নেমে আসছি আমরা দোতলা থেকে, এসময় দেখি, সৌম্যদর্শন এক দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় ভদ্রলোক উঠে আসছেন সিঁড়ি ভেঙে। পরনে জিনস, কেডস, প্রিন্টের শার্ট। হাতে ওয়াকিং স্টিক। খুব সম্ভব প্রাতভ্রমণ শেষে ফিরছিলেন।
তার আগপর্যন্ত কাজীদাকে দেখার অভিজ্ঞতা বলতে ডাকটিকিট সাইজের এক অস্পষ্ট, সাদাকালো ছবি। বন্ধ হয়ে যাওয়া আরেক জনপ্রিয় পত্রিকা কিশোর তারকালোক-এ ছাপা হয়েছিল সেটি। ওই ছবির সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারাটা মিলে যেতেই একঝলক রক্ত ছলাৎ করে উঠল আমার বুকের মধ্যে। যন্ত্রচালিতের মতো ডান হাতটা উঠে আসছিল সালাম দেওয়ার জন্য, এমন সময় চোখ তুলে আমাদের দেখতে পেলেন কাজীদা। ছড়ি ধরা হাতটা কপালের কাছে এনে স্মিত হেসে সালামের জবাব দিলেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার, পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন ওপরে। যতক্ষণ দেখা যায়, ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে ছিলাম আমি ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা, অগুনতি কিশোর-তরুণের স্বপ্নদ্রষ্টার দিকে।
সে বার কথা হয়নি। কথা হয়েছিল এর প্রায় ২৪ বছর পর! সেবা প্রকাশনীতে জমা দেওয়া বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলাপ করার জন্য ডেকেছিলেন তিনি আমাকে। মেজর জেনারেল রাহাত খানের কামরার সামনে এসে দাঁড়ালে মাসুদ রানার যে রকম অনুভূতি হয়, একই অবস্থা হয়েছিল আমারও। কাজীদার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আবারও বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠেছিল রক্ত।
আলাপের একপর্যায়ে বললেন তিনি, ‘আপনার বইটার শেষ অংশে আরেকটু নাটকীয়তা দরকার। ঠিকঠাক করে আনতে পারবেন ওটা?’
‘জি, স্যার, পারব’, জবাব দিতে দেরি হয়নি আমার।
‘ভেরি গুড।’
পরে যখন ছাপা হয়ে বেরোল বইটি, পৃষ্ঠা উল্টে দেখি, ঘষামাজা করা অংশটি নয়, আগেরটিই রেখে দিয়েছেন কাজীদা। বুঝেছিলাম তখন, তিনি আসলে পরীক্ষা করেছিলেন আমাকে।
কোনো বই সুখপাঠ্য করার জন্য সম্পাদনা, প্রুফরিডিং ও বানান সমন্বয়ের গুরুত্ব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের যে গুটিকয় প্রকাশনীতে বই সম্পাদনা ও প্রুফ চেকিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে, সেবা প্রকাশনী এর অন্যতম। এই প্রকাশনা সংস্থার একটি বইও সম্পাদনা ও প্রুফরিডিং ছাড়া বাজারে যায় না।
কোনো পাণ্ডুলিপি কাজীদার হাতে পড়লে পুরো লেখাটি পড়ে ভুলত্রুটিগুলো হাইলাইট করে দিতেন তিনি। এরপর লেখক বা অনুবাদককে ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে দিতেন, কেন সেগুলো ভুল, আর কীভাবে সেগুলো সংশোধন করতে হবে। লেখককে তখন কাজীদার নির্দেশনা অনুযায়ী পাণ্ডুলিপি ঠিকঠাক করে আনতে হতো। লেখা সংশোধনের কাজটি লেখককে দিয়েই করাতেন তিনি সচরাচর, যাতে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয় পরবর্তী বইয়ে। হাতেকলমে শেখানো যাকে বলে। এভাবে কত সুলেখক যে তৈরি করেছেন তিনি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
খুবই ডিসিপ্লিনড মানুষ ছিলেন কাজীদা। তাঁর সব কাজ ছিল ঘড়িধরা। কাজীদার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুরের সূত্রে জানতে পেরেছি, সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে মেডিটেশন ও হালকা ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন তিনি।
সংশোধিত পাণ্ডুলিপি দ্বিতীয়বার চেক করতেন কাজীদা। এরপর চলে যেত সেটি প্রুফ সেকশনে। তিন-তিনবার সম্পাদনা করা পাণ্ডুলিপিতে কোনো ভুল বের করতে পারলে পুরস্কার হিসেবে বোনাস দেওয়া হতো প্রুফরিডারকে। যত বেশি ভুল পাওয়া যেত, তত বেশি বোনাস। একইভাবে প্রুফ চেক করার পরও যদি কোনো বইয়ে ভুল ধরা পড়ত, সেটির জন্য ছিল জরিমানার ব্যবস্থা। এভাবেই মানের দিক থেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি সেবা প্রকাশনীকে।
বেশ কয়েক বছর কাজীদার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হলেও তাঁর সঙ্গে কোনো ছবি নেই আমার। তুলব তুলব করে তোলাই হয়ে ওঠেনি আর। সব সময়ই তাঁকে কিছু না কিছুতে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি, সে জন্য মনে হতো, ছবি তোলার কথা বললে যদি বিরক্ত হন!
খুবই ডিসিপ্লিনড মানুষ ছিলেন কাজীদা। তাঁর সব কাজ ছিল ঘড়িধরা। কাজীদার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুরের সূত্রে জানতে পেরেছি, সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে মেডিটেশন ও হালকা ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন তিনি। এরপর পান করতেন আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ত্রিফলার পানি। প্রাতরাশের তালিকায় ছিল এক পিস রুটি, ডিম পোচ, গোলমরিচের গুঁড়া দিয়ে দুই ফালি স্টিমড পেঁপে, আদাকুচি ও লবণ দিয়ে ভেজানো ছোলা, চারটে ভেজা কাঠবাদাম ও সব শেষে ব্ল্যাক কফি। লাঞ্চে বসতেন দুপুর ঠিক ২টায়। খাবারে ভাতের পরিমাণ এক কাপেরও কম। সঙ্গে এক কাপ সবজি, পনিরের টুকরো, ভাজা কালিজিরার গুঁড়া, গরম ঘি, মাছ ও ডাল এবং ডেজার্টে টক দই। বিকেলের নাশতায় থাকত ঘরে তৈরি আইটেম, ফল বা মিষ্টি ও বাদাম। রাতের খাবার খেতেন ৯টায়। মেনু দুপুরের মতোই। শুধু মাছের বদলে মাংস। এরপর নাতিদের সঙ্গে গল্প, আড্ডা শেষে ১১টায় যেতেন বিছানায়। এই রুটিনে ৮৫ বছর বয়সেও নিজেকে ফিট রেখেছিলেন তিনি। লেখালেখি, সম্পাদনা ও অফিশিয়াল কাজকর্মে পার হতো তাঁর রোজকার দিনরাত্রি। কর্মবীর বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই ছিলেন কাজীদা। এক ঘণ্টা পর পর ১০ মিনিট করে হাঁটাহাঁটি ছাড়াও বাসার ছাদে বা রমনা পার্কে আধা ঘণ্টা হাঁটতেন তিনি বিকালে।
সংগীতপ্রিয় কাজীদার বিশেষ পছন্দের ছিল শিবরঞ্জনী রাগ, বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সরোদ ও বাঁশি।
ইসকুল বাড়ি, ক্লাস এইট, ছোটকুমার, ইতিকথা, ফুলবাগান, ঘরের শত্রুর মতো আরও কিছু কিশোর উপযোগী উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা ছিল কাজীদার। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি অসুস্থতার আগে। বিষয়টি নিয়ে খুবই উত্তেজিত ছিলাম আমি। লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের অপূর্ব বইগুলোর মতো আরও কিছু বই অনুবাদেরও অনুরোধ রেখেছিলাম তাঁর কাছে। কিন্তু মরণব্যাধি কেড়ে নিল তাঁকে আমাদের কাছ থেকে!
স্মৃতিই এখন কাজীদার কাছে যাওয়ার টাইম মেশিন। সত্যিকারের টাইম মেশিন পেলে একবারের জন্য হলেও ফিরে যেতে চাইতাম আমি কিংবদন্তি মানুষটির কাছে। গিয়ে বলতাম, ‘বলব বলব করে যে কথাটি কক্ষনো কোনোদিন বলা হয়নি, সেই কথাটিই বলতে যাচ্ছি আজ আপনাকে। ইউ আর আ গ্রেট ম্যান, কাজীদা। উই লাভ ইউ, ম্যান! আপনজনের মতোই ভালোবাসি আমরা আপনাকে।’