খেলা
জুটি নিয়ে দুটি কথা
‘একজন ভালো সতীর্থ হলো মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো, যাকে সঙ্গ দিয়ে মনে শান্তি পাওয়া যায়’, ম্যাথু হেইডেনকে নিয়ে নিজের আত্মজীবনীতে কথাগুলো লিখেছিলেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ক্রিকেটে একটা ভালো জুটিই পারে দলকে জেতাতে। চলো শুনি টেস্ট ক্রিকেটের সেরা কিছু জুটির কথা।
রাহুল দ্রাবিড়-শচীন টেন্ডুলকার
একজনের নাম ‘দ্য ওয়াল’, অন্যজনের ‘লিটল মাস্টার’। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন টেন্ডুলকারের নাম ওপরের দিকেই থাকবে। তেমনই থাকবে দুজনের জুটির গল্পও। ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দ্রাবিড়-টেন্ডুলকার জুটি।
প্রায় দেড় যুগ একসঙ্গে খেলেছেন দুজন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ, উত্থান–পতন, গ্ল্যামার—সবকিছুই একসঙ্গে দেখা, যে কারণে দুজনের অন আর অব দ্য পিচ বন্ধুত্বও অটুট। মোট ১৪৩ ইনিংসে জুটি গড়েছেন দুজন। এর মধ্যে ৪৯–বার ছাড়িয়েছেন ৫০ আর ২০–বার ১০০। ২০০ রানের বেশি পার্টনারশিপ আছে তিনবার। দুজন মিলে করেছেন ৬ হাজার ৯২০ রান, যে রানের পাহাড় এখনো ছোঁয়ার সাধ্য হয়নি কারও।
সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিম
ব্যাটিং নিয়ে কথা বললে বাংলাদেশ থেকে যে এই দুজনের নাম আসবে, তা নিশ্চয় অজানা নয়। বিকেএসপির দিন থেকে দুই বন্ধুর একসঙ্গে পথচলা। এমনকি দুজনের ক্রিকেটে আগমনও ঘটেছে একই সময়ে, কোচ ডেভ হোয়াটমোরের হাত ধরে। তাঁর মতে এই দুজন ছিলেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আজ প্রায় ১৩ বছর আগে করা ভবিষ্যদ্বাণী পুরোটাই সত্যি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রানের পার্টনারশিপের রেকর্ড এখনো এই দুজনের। ১৩ বছরে ১৬৯ ম্যাচে জুটি বেঁধে করেছেন ৬ হাজার ১১২ রান। এর মধ্যে আছে ১১টি সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ। টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ৩৫৯ রানের জুটির মহারথী এই দুজনই। এমনকি টি-টোয়েন্টিতেও আছে ১১২ রানের জুটি।
তাঁদের গল্প শুধু ব্যাটিংয়েই শেষ নয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সাকিবের বোলিংয়ে উইকেটের পেছনে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে থাকতেন মুশফিক। যে কারণে সাকিবের সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের সঙ্গীও তিনি। ২৯৮ ম্যাচে সাকিবের সঙ্গী হয়ে ৭৫ ডিসমিসাল করেছেন মুশফিক।
কুমার সাঙ্গাকারা-মাহেলা জয়াবর্ধনে
এতক্ষণ যেসব জুটির গুণগান করলাম, তাদের থেকে এই জুটি একটু আলাদা। অন্য সব জুটি ছিল ওয়ান হ্যান্ডেড। অর্থাৎ দুজনই একহাতি ব্যাটসম্যান। কিন্তু সাঙ্গাকারা আর জয়াবর্ধনের ক্ষেত্রে একটু উল্টো। এই ডাবল হ্যান্ডেড জুটি যেমন অন্য সবার থেকে আলাদা, তেমনি দুজনের একজনও ওপেনার নন। দুই মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যানের উঠে আসার গল্পটাও বড্ড আলাদা।
সাঙ্গাকারা–জয়াবর্ধনে জুটির গল্প শুরু ক্রিকেট মাঠ থেকে নয়; পড়ার টেবিল থেকে। একই স্কুলে পড়াশোনা করতেন দুজন, সেখান থেকে স্কুল ক্রিকেট, এরপর আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পা রেখেছেন দুজন। প্রায় ১৪ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দুজন। এমন একটা সময় ছিল, যখন শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং তাণ্ডব শুরুই হতো দুই ওপেনার বিদায় বলার পর।
২০০৬ সালে সবকিছু ছাড়িয়ে টেস্টে গড়েছিলেন ৬২৪ রানের অনবদ্য এক জুটি, যা এখনো কারও পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি। ১২০ ইনিংসে ৬ হাজার ৫৫৪ রানের গল্পে তাঁদের পুরো কীর্তি বোঝানো সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কার সেই দলের দুই উইকেট পতনের পর প্রতিপক্ষ বোলার-অধিনায়কের চিন্তার বলিরেখাই বলতে পারে, কতটা ভয়ংকর ছিলেন তাঁরা।
ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিস
এককথায় বলতে গেলে উপমহাদেশের সর্বকালের সেরা বোলিং জুটি। বাংলাদেশ-ভারত যেমন স্পিনের স্বর্গরাজ্য, পাকিস্তান তেমনি পেসারের। পাকিস্তানের সেরা পেস জুটি ওয়াসিম-ওয়াকার। ওয়াসিমের বিখ্যাত ব্যানানা সুইং আর ওয়াকারের গতিই যথেষ্ট ছিল প্রতিপক্ষকে ছারখার করে দিতে। ওয়াসিম–ওয়াকার জুটির মতো ভয়ংকর কোনো জুটি আসবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে বইকি। জুটি বেঁধে ৬১ টেস্ট খেলে এই দুজন তুলে নিয়েছেন ৫৫৯ উইকেট, যা ম্যাচপ্রতি প্রায় ৯ উইকেট।
গ্লেন ম্যাকগ্রা-শেন ওয়ার্ন
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বোলিং জুটি বললেও মনে হয় ভুল হবে না। অস্ট্রেলিয়ান সর্বজয়ী দলের বোলিং কান্ডারি ছিলেন এই দুই তারকা। দুজনের বোঝাপড়া এতটাই ভালো ছিল যে একজনের পর অন্যজন বোলিংয়ে এলেই বুঝে নিতেন কী করতে হবে। ১০৪ টেস্টে জুটি করে উইকেট পাক্কা ১ হাজার ১টি। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে দুজনই ছিলেন, এমন ৭০ শতাংশ টেস্ট ম্যাচ জিতে বাড়ি ফিরেছে অজিরা। দুজনের বোলিং নিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। ম্যাকগ্রা ছিলেন ব্যাটসম্যানের চোখের বিষ, লাইন–লেংথ বজায় রেখে এক জায়গায় একের পর এক ওভার বল করা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর ওয়ার্ন? তাঁর ঘূর্ণিতে চোখে শর্ষে ফুল দেখেনি, এমন ব্যাটসম্যান তখনকার ক্রিকেটে খুব কমই আছে। একদিকে ম্যাকগ্রার সুইং, অন্যদিকে ওয়ার্নের টার্নে ভূপতিত হননি, এমন খেলোয়াড় হাতেগোনা।
অ্যালিস্টার কুক-অ্যান্ড্রু স্ট্রস
ইংলিশ ক্রিকেটে এ জুটির গল্পটা একটু আলাদা। ইংলিশ ক্রিকেটের নিয়ম ছিল ‘ম্যান টু ম্যান রিপ্লেস’। যদি কোনো ওপেনার দল থেকে ছিটকে পড়েন, তবে তাঁর জায়গায় ওপেনারই আসবেন, এক্সপেরিমেন্টাল কাউকে আনা হবে না। মার্কাস ট্রেসকোথিকের বদলে তখন দলে ঢুকলেন ২১ বছর বয়সী ওপেনার কুক। স্ট্রসের জায়গা তখন পাকা।
এত কম বয়সে ইংলিশ দলে টিকতে পারবে কি না, এ প্রশ্ন তোলার আগেই নিন্দুকের মুখ সিন্দুকে ভরে দেন কুক। অভিষেকেই শতক হাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেন, রাজত্ব করতেই এসেছেন তিনি। এরপর প্রায় ছয় বছর একসঙ্গে তিন ফরম্যাটে ওপেন করেছেন অ্যালিস্টার কুক আর অ্যান্ড্রু স্ট্রস। সাদা জার্সিতে ১৩২ ইনিংসে জুটি করে রান করেছেন ৫ হাজার ২৫৩। এমনকি ২০০৯ সালে টেস্ট ব্যাটিং র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম দুটি পজিশন ছিল তাঁদের দখলে। তবে এত কিছুর পর ইংলিশদের মনে তাঁরা অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাশেজ জয় করা ইংলিশ জুটি হিসেবে।
ম্যালকম মার্শাল-মাইকেল হোল্ডিং
আশির দশকে ত্রাস ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দুই পেসার। হোল্ডিং ছিলেন ন্যাচারাল সুইঙ্গার আর মার্শাল ছিলেন বুদ্ধিমান, শক্তিশালী। বৈশিষ্ট্যে আলাদা হলেও তাঁদের জুটি হয়ে উঠেছিল সর্বসেরা। ৬০ টেস্টে দুজন মিলেই তুলে নিয়েছিলেন ৬২৫ উইকেট।
স্টুয়ার্ট ব্রড-জেমস অ্যান্ডারসন
সমসাময়িক বোলিং জুটির মধ্যে সবার আগে ব্রড-অ্যান্ডারসনের নাম আসবে। টেস্ট ক্রিকেটে জুটি হিসেবে ৫০০ উইকেট তো ছাড়িয়েছেন সেই কবেই। একমাত্র পেস বোলিং জুটি হিসেবে ছাড়িয়েছেন ১০০০ উইকেটের রেকর্ডও। সদ্য সমাপ্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে নিজের নামের পাশে ৫০০ উইকেটের রেকর্ড যোগ করে অনন্য উচ্চতায় ব্রড। আর এই জুটির মোট উইকেটসংখ্যা এখন ১০৯০। ব্রডের ৫০১ আর বাকি ৫৮৯ অ্যান্ডারসনের।
ম্যাথু হেইডেন-জাস্টিন ল্যাঙ্গার
‘দুজন ছিলেন পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া দলের ওপেনার’, এ কথার পর অন্য কিছু বলার সুযোগ থাকে না। ২০০১ থেকে ২০০৭, ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে বল করতে নামার আগেই বুক ধুকপুক শুরু হতো বোলারদের। কারণ, ওপেন করতে নামতেন হেইডেন-ল্যাঙ্গার জুটি। একে অপরের পরিপূরক ছিলেন এই দুই বাঁহাতি। ল্যাঙ্গার থাকতেন ধীরস্থির মনোভাবে ম্যাচ ধরে খেলার চিন্তায়, ওদিকে প্রথম বল থেকেই মেরে খেলার স্বভাব হেইডেনের। বোলারদের কথা ভাবো একবার! ১২২ ইনিংসে ল্যাঙ্গার-হেইডেন জুটির সংগ্রহ ৬ হাজার ৮১ রান। এর মধ্যে ৬ ইনিংসে পার করেছেন ২০০ রান, ১০০ রানের জুটি হয়েছে ১৪ বার।
অথচ এ জুটির গল্প লেখার আগেই শেষ হয়ে যেতে পারত। ২০০১ অ্যাশেজের পরপরই নিজের শেষ দেখে নিয়েছিলেন ল্যাঙ্গার। বাজে ফর্মের কারণে নিজের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। সেখানে সিরিজ জেতায় মাইকেল স্ল্যাটার ভাবলেন নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়ার কথা। স্ল্যাটারের বিদায়ের সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। শেষ টেস্টে ছিল ল্যাঙ্গারের জন্য শেষ সুযোগ। কিন্তু সেদিনই দেখা গেল ক্রিকেট ইতিহাসের অনন্য এক গল্পের সূচনা। ম্যাথু হেইডেনের সঙ্গে জুটি গড়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন ইংলিশ বোলারদের। সেই সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু, অবসরের আগপর্যন্ত সে জায়গায় ভাগ বসাতে পারেননি অন্য কেউ। সর্বকালের সেরা টেস্ট ওপেনিং জুটির গল্পেও হয়তো কেউ ভাগ বসাতে পারবেন না।