ছোট্ট ছেলেটা একদিন আয়নায় তাকিয়ে আবিষ্কার করল, সে আর সবার মতো নয়। মা, বাবা, আত্মীয়, প্রতিবেশী...সবার হাত আছে, পা আছে; তার নেই। কিন্তু সে যে বড় হয়ে পুলিশ হতে চেয়েছিল। মোটরসাইকেলে চড়ে গুন্ডা–বদমাশদের তাড়া করবে ভেবেছিল। সেই স্বপ্নটার তাহলে কী হবে? ছেলেটা ভীষণ মুষড়ে পড়ল। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আত্মীয়স্বজনের বাসা, কোথাও সে যেতে চাইত না। তাকে দেখলেই সবাই তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা সে মানতে পারত না। সিঁড়ি ভাঙার ভয় কিংবা হুইলচেয়ারে চড়ার লজ্জায় নিজেকে সে আরও গুটিয়ে ফেলল।
এই ছেলেটির নাম ইয়ানিস ম্যাকডেভিড। বাড়ি জার্মানিতে। ইয়ানিসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দুই বছর আগে। ইউনিসেফের (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ‘তিনি’ বলছি, কারণ ইয়ানিস এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। চেহারায় সেই হতাশা, দ্বিধা, বিষণ্নতাও নেই।
ইয়ানিস এখন টগবগে যুবক। তাঁর বিশেষত্বটা প্রথম দেখাতেই চোখে পড়বে, সেটা ঠিক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে এই তরুণ তাঁর কথার জাদুতে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবেন। লোকটির হাত নেই, পা নেই, সেটা আর তোমার দৃষ্টি কেড়ে নেবে না। বরং তুমি দেখবে, তাঁর চোখ দুটা কী উজ্জ্বল! আর হাসিটা কী প্রাণবন্ত! রসবোধ রীতিমতো তুখোড়। আমাদের সঙ্গে কথায় কথায় যেমন বলছিলেন, ‘ওই লম্বা লম্বা পা দুটা দিয়ে কীভাবে যে তোমরা হাঁটো, আমার মাথায় আসে না!’
যেই ইয়ানিস ম্যাকডেভিড একসময় বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এখন তিনিই সারা পৃথিবী চষে বেড়ান, মানুষকে অনুপ্রেরণা দেন। হাত-পা ছাড়া জন্মেছেন, এটাকে তিনি কোনো প্রতিবন্ধকতা মনে করেন না। বরং বলেন, ‘আমার সমস্যা হলো, আমি চার সপ্তাহের বেশি কোনো জায়গায় থাকতে পারি না। এটাই সম্ভবত আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।’ বলেই হো হো করে হাসেন! পুলিশের মতো মোটরসাইকেলে তাঁর আর চড়া হয়নি। কিন্তু ইয়ানিসের একটা নিজস্ব অত্যাধুনিক হুইল চেয়ার আছে। জয়স্টিকের সাহায্যে তিনি সেটা চালাতে পারেন। কোথাও গেলে সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাতে এখন আর এই তরুণ অস্বস্তি বোধ করেন না। বলেন, ‘নিজেকে আমার সুপারস্টার মনে হয়!’
ইয়ানিস ম্যাকডেভিডের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে বড় অবদান তাঁর মায়ের। ছেলে অন্যদের চেয়ে আলাদা, সেটা মা কখনো বুঝতে দেননি। স্কুলে নাচের ক্লাস হতো। নাচের টিচার বলতেন, ‘ইয়ে মানে...নাচের ক্লাসটা ইয়ানিসের না করলে হয় না?’ মা বলতেন, ‘কেন? ও অবশ্যই নাচবে।’
পৃথিবীতে যত মানুষ সফল হয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখো, জীবনের কোনো না কোনো সময় তাঁদের কোনো না কোনো বড় বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বারবার আছাড় খেয়েই তো মানুষ হাঁটতে শেখে।
ছেলেবেলায় মায়ের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এখন সারা পৃথিবী ঘুরে অনুপ্রেরণা নেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশে তিনি ৪-৫ দিন ছিলেন, একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে গিয়েছিলেন। ইয়ানিস মুখ দিয়ে কলম ধরে লেখেন দেখে বাংলাদেশের একটা বাচ্চা মেয়ে নাকি ভীষণ অবাক হয়েছে। চোখ বড় বড় করে বলেছে, ‘তুমি মুখ দিয়ে লিখতে পারো! আমি তো এখনো হাত দিয়েও লেখা শিখিনি।’
সফল যাঁরা
পৃথিবীতে যত মানুষ সফল হয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখো, জীবনের কোনো না কোনো সময় তাঁদের কোনো না কোনো বড় বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বারবার আছাড় খেয়েই তো মানুষ হাঁটতে শেখে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। ২০১৫ সালে লাইগো নামের সুবিশাল এক যন্ত্রের সাহায্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। সারা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সেই বিজ্ঞানী দলের একজন ছিলেন দীপঙ্কর। অথচ একসময় তাঁর পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নারকেল, কাঁঠাল বিক্রি করে তিনি বরগুনার স্কুল-কলেজে পড়েছেন। গণিতে ভালো ছিলেন। বুয়েটে পড়বেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই। ভাগ্যিস, মন খারাপ করে হলেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। নইলে হয়তো আমাদের একজন পদার্থবিজ্ঞানী পাওয়া হতো না!
আরও কজনের কথা বলি।
আমাদের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তোজা। তাঁর গল্প তোমরা সবাই জানো। মাশরাফির যখন অভিষেক হয়, তিনি ছিলেন সবচেয়ে দ্রুত গতির বোলার। সদ্য কৈশোর পেরোনো মাশরাফির আগুন ঝড়ানো বোলিংয়ে হোঁচট খেত বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান। কিন্তু মাশরাফির ছন্দে পতন ঘটালো ইনজুরি।একবার নয়, বারবার তাঁকে যেতে হয়েছে ডাক্তারে ছুরির নিচে। পেস বোলারদের ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে হাঁটুর একটা ইনজুরিই যথেষ্ট। বিশ্বের অনেক বোলারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে এই হাঁটুর ইনজুরিতে। কিংবা অপারেশনের পর আর মাঠে ফিরতে পারেননি অনেক খেলোয়ার। সবাই ভেবেছিল মাশরাফিও পারবেন না। কিন্তু মাশরাফি অন্যন্য। সাতবার অপারেশন হয়েছে তাঁর দুই হাঁটুতে। প্রতিবারই তিনি ফিরেছেন নতুন উদ্যমে। বোলিংয়ে গতি কমেছে, কিন্তু কমেনি মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতা। কমেনি সাহস। একটা রান বাঁচাতে এখনও শূণ্যে ডাইভ দেন ক্যাপ্টেন। এই একটা রান বাঁচাতে গিয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে পুরো ক্যারিয়ার। কিন্তু মাশরাফি জানেন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হ্য়। হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই তিনি অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন, থাকবেন।
তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসির বয়স যখন ১১, দেখা গেল বন্ধুদের তুলনায় সে সবচেয়ে খাটো। মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেসিকে ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার বললেন, ‘ওর শরীরে একটা অবর্ধনশীল হরমোন আছে। ও বড় হচ্ছে, কিন্তু অন্যদের তুলনায় ধীরে।’ প্রায় ১ বছর ধরে চিকিৎসা চলল। সে সময় খেলতে নামলে প্রতিপক্ষের সবাই মেসির দিকে তাকিয়ে থাকত। ভাবখানা এমন, ‘এই পিচ্চিটা কোথা থেকে এল!’ মেসির খুব অস্বস্তি হতো। কিন্তু পরে মনে মনে ভাবলেন, ‘প্রসঙ্গ যখন ফুটবল, তখন কোনো বাধাই তো আমাকে দমাতে পারে না।’ ব্যাস, পুঁচকে ছেলেটাই ড্রিবলিংয়ের জাদুতে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের চোখ ধাঁধিয়ে দিত।
একই বয়সে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ঘটনাটা শোনো। সে বয়সে পর্তুগালের এই ফুটবলার বাড়ি ছেড়ে খেলতে চলে গিয়েছিলেন অনেক দূরে, স্পোর্টিং লিসবোন একাডেমিতে। যে ছেলেটা ছোটবেলা থেকে ভাই-বোন-কাজিনদের সঙ্গে হইচই করে বড় হয়েছে, একা একা থাকতে গিয়ে তার ভীষণ কান্না পেত। প্রায় প্রতি রাতেই সে কাঁদত। দুঃখ ভোলার জায়গা ছিল একটাই—মাঠ! কিন্তু মাঠও তো সহজ জায়গা নয়। নতুন পরিবেশ, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মানাতে কষ্ট হচ্ছিল। সেই রোনালদো অন্য এলাকার ছেলেদের ভাষা বুঝত না। তার ওপর সবাই তার থেকে লম্বা, স্বাস্থ্যবান। মেসির মতো ‘বাচ্চা ছেলে’ তকমা গায়ে লেগেছিল রোনালদোরও। কিন্তু এই বাচ্চা ছেলে যখন পায়ে বল পেত, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের দেখে মনে হতো, তারা পালানোর জায়গা খুঁজছে!
এখনো জ্যাক মার নামের সঙ্গে ১ সংখ্যাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কারণ চীনের সবচেয়ে ধনী মানুষদের তালিকায় তিনি ১ নম্বরে আছেন!
বিশ্বখ্যাত অনলাইন শপ আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা, চীনা ব্যাবসায়ী জ্যাক মার গল্প সম্ভবত অনেকেই জানো। তাঁর জীবনে ‘১’ সংখ্যাটা ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় গণিতে জ্যাক মা ১ পেয়েছিলেন। ১০০ তে ১! পরপর তিনবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন, পাস করতে পারেননি। কোনোমতে স্নাতক শেষ করে চাকরির খোঁজে নেমেছেন। কেএফসিতে চাকরির জন্য আবেদন করেছিল ২৪ জন। ২৩ জনের চাকরি হয়েছে। ১ জনের হয়নি। সেই একজন হলেন জ্যাক মা। জ্যাক মা যখন প্রথম ইন্টারনেটে ব্যবসা করার কথা ভাবলেন, ১৯৯৪ সাল, চীনে তখনো ইন্টারনেট পৌঁছায়নি। ব্যবসার নিবন্ধন করতে গিয়ে যখন বললেন, ‘আমি একটা ইন্টারনেট কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান করতে চাই;’ লোকে বলেছিল, ‘ইন্টারনেট? সেটা আবার কী জিনিস!’
ব্যবসার অংশীদার করার জন্য জ্যাক মা ২৪ জন বন্ধুকে বাসায় দাওয়াত করেছিলেন। পাক্কা ২ ঘণ্টা বন্ধুদের ব্যবসার আইডিয়াটা বোঝানোর পর আবিষ্কার করলেন, ওরা কিছুই বুঝতে পারেনি। বন্ধুদের মধ্যে তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করতে রাজি হয়েছিল কয়জন? ১ জন!
এখনো জ্যাক মার নামের সঙ্গে ১ সংখ্যাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কারণ চীনের সবচেয়ে ধনী মানুষদের তালিকায় তিনি ১ নম্বরে আছেন!
ধাক্কা!
লেখকদের বেলায় ‘ধাক্কা’ খেয়ে সফল হওয়ার ঘটনা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। জে কে রাওলিং তাঁর হ্যারি পটারের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কেউ ছাপতে রাজি হননি। ১২ জন প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর রাওলিং গিয়েছিলেন ব্লুমসবারি প্রকাশনের প্রকাশকের কাছে। সেই প্রকাশকও খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু প্রকাশকের ৮ বছরের মেয়ে গল্পটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপরের ঘটনা সবার জানা।
মার্ভেল কমিকসের জনক স্ট্যান লির গল্পটা কি জানো? টাইমলি পাবলিকেশনসের কমিক বুক বিভাগে সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে স্ট্যান লির বস ছিলেন মার্টিন গুডম্যান। মার্টিন খুবই অনুকরণপ্রিয় লোক ছিলেন। বাজারে যা চলছে, তাঁর তা-ই করা চাই। কিন্তু স্ট্যান লির তো মনের মতো কাজ করার ইচ্ছা ছিল। একদিন মন খারাপ করে স্ত্রীকে বললেন, ‘ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।’ স্ত্রী বললেন, ‘তুমি যখন চাকরিটা ছেড়ে দেবে, তখন ছেড়ে দেওয়ার আগে নিজের ইচ্ছেমতো কয়েকটা চরিত্র তৈরি করে যাও। মার্টিনের কথা শুনো না। সে বড়জোর কী করবে? তোমার চাকরিটা খেয়ে দেবে। চাকরি তো তুমি এমনিতেও ছাড়তে চাইছ।’ স্ট্যান লি তা-ই করলেন। এরপর জন্ম নিল ফ্যান্টাস্টিক ফোর, এক্সম্যান, দ্য হাল্কের মতো সিরিজগুলো।
ঘুরে দাঁড়ানোর সূত্র
তুমি ভাবতে পারো, কেবল সফল মানুষদের জীবনেই বোধ হয় এ ধরনের ঘটনা থাকে । তা কিন্তু নয়। তোমার মা-বাবা কিংবা দাদুকে জিজ্ঞেস করে দেখো, তাঁদের জীবনেও এমন ছোট-বড় বাধা এসেছে। একেকজনের গল্প একেক রকম। সফল হয়েছ কি হওনি, সেটা বড় নয়। আগে জানা দরকার, তুমি কঠিন সময়টাতে নিজেকে সামলাতে পেরেছো কি না।
কঠিন সময়ে মানুষ নিজেকে কীভাবে সামলে নিতে পারে, সে সম্পর্কে কিছুদিন আগে একটা চমৎকার বই পড়েছি। ডেমন ওয়েস্ট ও জন গর্ডনের লেখা বইটার নাম দ্য কফি বিন: আ সিম্পল লেসন টু ক্রিয়েট পজেটিভ চেঞ্জ। এই বইয়ের গল্পটা ছোট্ট করে বলে শেষ করব।
অ্যাব্রাহাম ছিল একটা মার্কিন হাইস্কুলের ছাত্র। খুব ভালো ফুটবল খেলত। ফুটবলের জন্যই স্কুলে সে রীতিমতো তারকা বনে গিয়েছিল। সবাই তাঁকে পছন্দ করে। পড়ালেখায়ও সে বেশ ভালো। স্কুলে অ্যাব্রাহামের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মিস্টার জ্যাকসন।
একদিন জ্যাকসন লক্ষ করলেন, ক্লাসে অ্যাব্রাহামের মন নেই। সে কেবল অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, কী যেন ভাবে। জ্যাকসন তাঁর প্রিয় ছাত্রকে ক্লাসের পর দেখা করতে বললেন। জানতে চাইলেন, ‘ কী হয়েছে তোমার?’ অ্যাব্রাহাম জানাল, তাঁর বাসায় খুব ঝামেলা চলছে। মা-বাবা প্রতিদিন ঝগড়া করেন। যেকোনো দিন তাঁরা আলাদা হয়ে যাবেন। সামনে পরীক্ষা। আবার খুব গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টও আসছে। সবাই তাকিয়ে আছে অ্যাব্রাহামের দিকে। এই চাপ সে আর নিতে পারছে না।
জ্যাকসন কিন্তু ছাত্রকে কোনো লম্বা বক্তৃতা শোনালেন না। উপদেশ দিলেন না। বরং একটা অদ্ভুত অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। বললেন, ‘তুমি কাল সকালে একটা পাতিলে পানি আর একটা গাজর নেবে। তারপর পাতিলটা চুলায় বসিয়ে দেবে। পানি গরম করবে। কী হয়, আমাকে জানাবে।’ অ্যাব্রাহাম বাধ্য ছেলের মতো তা-ই করল। পরদিন স্যারকে জানাল, পানি গরম হওয়ার পর গাজরটা সেদ্ধ হয়ে একদম নরম হয়ে গেছে।
জ্যাকসন এবার আরেকটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। বললেন, ‘এবার তুমি গাজরের বদলে পানিতে একটা ডিম রাখবে। কী হয়, আমাকে জানাবে।’
পরদিন অ্যাব্রাহাম জানাল, পানির গরমে ডিমটা সেদ্ধ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে।
স্যার বললেন, ‘তুমি এবার পানিতে এক চামচ কফির দানা দেবে। দেখবে কী হয়।’ অ্যাব্রাহাম তা-ই করল। পরদিন জানাল, যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কফি পানির সঙ্গে মিশে গেছে।
স্যার লম্বা দম নিয়ে বললেন, ‘শোনো, তুমি যখন চারপাশ থেকে চাপ অনুভব করবে, তখন চাইলে গাজরের মতো নরম হয়ে যেতে পারো। কিংবা ডিমের মতো শক্ত হতে পারো। মনে মনে বলতে পারো, “তোমরা আমার ওপর চাপ দিচ্ছ? ঠিক আছে, আমিও শক্ত হয়ে থাকব।” তাতে কিন্তু তোমার কষ্টই বাড়বে। তোমাকে যা করতে হবে, সেটা হলো কফির দানার মতো আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। খেয়াল করে দেখো, গাজর বা ডিমের ক্ষেত্রে কিন্তু পানির কোনো পরিবর্তন হয়নি। গাজর নরম হয়ে গেছে, ডিম শক্ত হয়েছে। কিন্তু কফির দানা তার চারপাশ বদলে ফেলেছে। কফির ক্ষেত্রে পানিটা আর শুধু পানি নেই।’
এবার তুমি ওপরের সবার গল্পটা পড়ে দেখো। ইয়ানিস ম্যাকডেভিড, দীপঙ্কর তালুকদার, মেসি, জ্যাক মা কিংবা স্ট্যান লি। চাপের কাছে তাঁরা কেউই কিন্তু নত হয়ে যাননি। বরং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চারপাশের ওপর প্রভাব ফেলেছেন।
অ্যাব্রাহামের কথায় আবার ফিরি। স্যারের গল্প শুনে অ্যাব্রাহাম যে রাতারাতি তার জীবন পাল্টে ফেলেছিল, তা কিন্তু নয়। বিপুল উদ্যমে খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচেই তার পা ভেঙে গিয়েছিল! তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। তবু, সে স্যারের কথা মনে রেখেছে। নিজের স্কুলে ‘কফি বিন ক্লাব’ খুলেছে। ঘুরে ঘুরে সবাইকে এই তত্ত্বটার কথা বলেছে।
অ্যাব্রাহাম এখন বড় হয়ে গেছেন। নানা দেশ ঘুরে তিনি মানুষকে কফির মতো হওয়ার আহ্বান জানান।