একজন মানুষের কিন্তু একবারই চিকেনপক্স হয়। ঠিক যেমন হামও একবারের বেশি হয় না। কিন্তু কোথা থেকে আসে বা তৈরি হয় এই প্রতিরোধক্ষমতা? আমরা যখন একবার এই রোগগুলোর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হই, আমাদের শরীর সেই জীবাণুকে শনাক্ত এবং প্রতিরোধ করার জন্য একটি বাহিনী গঠন করে, যার একটি অংশ অ্যান্টিবডি। পরের বার যখন এই একই জীবাণু আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করে, আমাদের শরীর সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দ্বিতীয়বার অসুস্থ হবার আগেই জীবাণুটিকে নির্মূল করে ফেলে। এটাকেই বলে প্রতিরোধক্ষমতা বা ইমিউনিটি। টিকা বা ভ্যাকসিনও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে আমাদের শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
টিকা মূলত ওই জীবাণুরই নকল একটা রূপ। টিকা নেওয়ার পর আমাদের শরীর মনে করে, সত্যিকারে একটি জীবাণু আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে একটি বাহিনী গঠন করে, সেই বাহিনী ধ্বংস করে দিতে পারবে সত্যিকারের জীবাণুকে। বলা যায়, টিকা আমাদের শরীরকে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেয়।
ইতিহাসাশ্রয়ী সাহিত্যে সম্ভাব্য টিকা ব্যবহারের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে টিকার কার্যকারিতা প্রথম দেখানো হয় ১৭৯৬ সালে। ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার। ৮ বছরের ছেলের শরীরে প্রথমে গো–বসন্তের জীবাণু প্রয়োগ করেন। জেনার লক্ষ্য করেছিলেন গো–বসন্তের জীবাণু গরুকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করতে পারলেও মানবদেহে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। জেনার জানতেন, গো–বসন্তের ভাইরাসের সঙ্গে গুটিবসন্তের ভাইরাসের মিল আছে অনেকটা। তাই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, গো–বসন্তের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির শরীর গুটিবসন্তের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পারে কি না?
গো–বসন্তের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার কয়েক দিন পর ছেলেটির শরীরে গুটিবসন্ত জীবাণু প্রয়োগ করলেন জেনার। দেখলেন, তাঁর ধারণাই ঠিক। গুটিবসন্ত ছেলেটিকে আক্রান্ত করতে পারল না। সেই শুরু ভ্যাকসিনের ইতিহাসের যাত্রা, বিজ্ঞানের ইতিহাসের এটা এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ভ্যাকসিনেশন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে মানুষের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্যের ওপর।
ধারণা করা হয়, জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কারের আগে প্রতিবছর এক কোটির বেশি মানুষ সংক্রমিত হত, মারা যেত ১৫ লাখ মানুষ। কিন্তু এ কালের তরুণ প্রজন্মের বেশির ভাগই হয়তো গুটিবসন্তের নামটিও শোনেনি। কারণ, জেনারের টিকা আবিষ্কার এবং পরের প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা গুটিবসন্তের টিকাকে আরও উন্নত করেছে; সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সেটা ছড়িয়ে দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা, সব মিলিয়ে গুটিবসন্ত আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত রোগে পরিণত করেছে। এখানে একটা বড় ভূমিকা আছে আমাদেরও। বাংলাদেশে তৈরি সুলভ টিকা গুটিবসন্ত নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রোগ নির্মূলে ভ্যাকসিনের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো পোলিও ভাইরাসের টিকা। ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে পোলিও রোগ। ১২৫টি দেশের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। মাত্র তিনটি দেশ ছাড়া পৃথিবী প্রায় পোলিওমুক্ত। ২০১8 সালে মাত্র ৩৩টি সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় গোটা বিশ্বে। আর বাংলাদেশে ২০০৬ সালের পরে কোনো শিশু পোলিওতে আক্রান্ত হয়নি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুকে পোলিওসহ কয়েকটি রোগের রোগের টিকা দেওয়া হয় বিনা পয়সায়। টিকা কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী বড় একটা উদাহরণ তৈরি করেছে। বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের অনুসরণ করে।
ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নভেল করোনাভাইরাস। আর পরম প্রার্থিত বস্তুটির নাম করোনার ভ্যাকসিন। কার্যকরী ও সফল টিকা আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত করোনা সংকট থেকে উত্তরণের কার্যকরী কোনো সমাধান নেই। কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও বিতরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না, মাস্ক খুলতে পারছি না, স্কুলে যেতে পারছি না।
বিশ্বজুড়ে গবেষকেরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ১৬৫-এর বেশি টিকা তৈরি করার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে ২৮টি সম্ভাব্য টিকার ট্রায়াল চলছে। কিন্তু আমরা জানি না, আর কত ট্রায়াল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা লাগবে টিকা অনুমোদিত হয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে আসতে।
কোনো একটি টিকা জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের আগে সাধারণত প্রয়োজন হয় কয়েক বছরের গবেষণা এবং পরীক্ষার। তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা আগামী বছরের মধ্যেই একটি নিরাপদ ও কার্যকর কোভিড-১৯ টিকা তৈরির জন্য একযোগে কাজ করছেন।
যেকোনো টিকা তৈরির সময় যেমন বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়, তেমনি তৈরির পরেও দিতে হয় কয়েক ধাপে ট্রায়াল। প্রতিটি ধাপেই সফল হওয়াটা জরুরি। একটা ধাপে সফল না হলে আবার শুরু করতে হয় নতুনভাবে। একটি টিকা অনুমোদিত হওয়ার জন্য ৪টি ধাপ অতিক্রম করা আবশ্যক।
প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: এই ধাপে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রাণী, যেমন ইঁদুর, খরগোশ বা বানরের মতো প্রাণীর ওপর টিকাটি ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হচ্ছে কি না, সেটাই দেখা হয় এই ট্রায়ালে। এই ধাপ সফল হলে শুরু হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্ব-১: অল্প কিছু মানুষ, যেমন ২০ থেকে ৮০ জন সুস্থ মানুষের ওপর টিকাটি প্রয়োগ করা হয়। এই ধাপ সুরক্ষা এবং মাত্রা পরীক্ষা করার পাশাপাশি মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয় কি না, তা নিশ্চিত করা হয়।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্ব-২: এ পর্বে বিজ্ঞানীরা কয়েক শ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তির ওপর টিকাটি প্রয়োগ করে। এই ধাপে টিকাটির সুরক্ষা এবং প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য তৈরির ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্ব-৩: এই পর্বে কয়েক হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা চালনো হয়। তবে সবাইকে টিকা দেওয়া হয় না। অর্ধেক মানুষকে টিকা দেওয়া হয়, বাকি অর্ধেককে টিকার পরিবর্তে প্লাসিবো (হীতকল্পী) প্রদান করে। তারপর পর্যবেক্ষণ করা টিকা ও প্লাসিবোপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে সংক্রমণের হার। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায়, টিকাটি সত্যিকার অর্থেই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারবে কি না।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্ব-৪: প্রতিটি দেশে ওপরের চালানো ট্রায়ালের ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করে টিকা অনুমোদন করা হবে কি না, তা স্থির করা হয়। এই পর্যায়ে মহামারী চলাকালীন একটি ভ্যাকসিন আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের আগেই জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে।
এ বছর জানুয়ারিতে SARS-CoV-2-এর জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পরপরই টিকা তৈরির হিড়িক পড়ে যায় বিশ্বব্যাপী। মানবদেহে প্রথম ট্রায়াল কার্যক্রম মার্চ মাসেই শুরু হয়েছে। তবে পরবর্তী ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। আগের বিভিন্ন রোগের টিকা তৈরির অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কিছু ট্রায়াল ব্যর্থ হবে, বেশির ভাগ ট্রায়াল সুস্পষ্ট ফলাফল ছাড়াই হয়তো শেষ হবে। তবে আশা রাখাই যায়, বেশ কয়েকটি টিকা নিরাপদ এবং কার্যকরী হবে। এগুলোই হয়তো আমাদের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সফল হবে।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচটি টিকা তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গেছে। এই তৃতীয় ধাপটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হাজার হাজার মানুষের ওপর টিকাটি পরীক্ষিত হচ্ছে। এবং এটাই অনুমোদনের সবচেয়ে নিকটবর্তী ধাপ। তাই এই পাঁচ টিকা সম্পর্কে আমাদের জেনে রাখা উচিত।
মোডের্না টিকা: দ্বিতীয় ধাপের সফলতার পর জুলাই মাসে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এই চূড়ান্ত পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০ হাজার সুস্থ মানুষকে নথিভুক্ত করা হচ্ছে।
বায়োইনটেক টিকা: তৃতীয় ধাপের এই টিকার ট্রায়াল চলছে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানিসহ অন্য কয়েকটি দেশে। এই ট্রায়ালেও ৩০ হাজার সুস্থ মানুষকে নথিভুক্ত করা হচ্ছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা: ধারণা করা হচ্ছে, এই টিকাই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। টিকাটির যুক্তরাজ্য, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি বলেছে, যদি অনুমোদিত হয়, তবে আগামী বছরের মধ্যে তারা দুই বিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করতে পারবে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে এই টিকার ট্রায়ালের জন্য কয়েক লাখ ডোজ তৈরি করে ফেলেছে।
সিনোফার্ম টিকা: আরব আমিরাতে জুলাই মাসে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হয়েছে এই টিকার। আবুধাবির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর শরীরে প্রথম এই টিকা প্রয়োগ করা হয়। মোট ১৫ হাজার মানুষ অংশ নেবে এই পরীক্ষায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই টিকা বছরের শেষের দিকে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে।
সিনোভ্যাক টিকা: সিনোভ্যাক জুলাই মাসে ব্রাজিলে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করেছে এই টিকার। সংস্থাটি বার্ষিক ১০০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করার জন্য তৈরি হচ্ছে।
যেহেতু বেশ কিছু টিকা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং বিশ্বজুড়ে ৭০০ কোটি মানুষ যেন করোনাভাইরাসের টিকা পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই একাধিক টিকার প্রয়োজন।
খুব দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে টিকার গবেষণা। হয়তোবা আমরা এই মহামারি থেকে শিগগির বের হয়ে আসতে পারব। কিন্তু এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সেই প্রশ্নগুলো রেখেই এই লেখা শেষ করি।
আমাদের মতো নিম্ন বা মধ্য আয়ের দেশগুলোর টিকা পেতে সাধারণত অনেক দেরি হয়। বাংলাদেশে কবে আসবে টিকা? অনুমোদিত টিকাগুলো কি বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে? কিংবা যখন বাংলাদেশে সঠিক টিকাটি আসবে, তখন টিকা পাওয়ার প্রথম সারিতে কে বা কারা থাকবে?
লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ