‘আচ্ছা তুমি তো প্রচুর বই পড়ো’, মিলি খালাকে জিজ্ঞেস করে বিলু।
মিলি খালা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। অর্থনীতি বিভাগে। ঢাকায় এসেছেন দুই মাস হলো, হলে ওঠার আগে থাকবেন বিলুদের ধোলাইখালের বাড়িতেই, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এত্ত এত্ত বই। কখনো কখনো লাইব্রেরি আর বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেও বই আনেন মিলি খালা। দিনের একটা লম্বা সময় তাঁর কাটে ওই বই পড়েই।
হাতের বইটি বন্ধ করে বিলুর দিকে তাকান তিনি, মাথা চুলকে বলেন, ‘প্রচুর কি না জানি না। তবে পড়ার চেষ্টা করি টুকটাক।’
‘কিন্তু পৃথিবীতে এত মজার মজার কাজ রেখে বই পড়তে ভালো লাগে তোমার?’
এবার বইটি টেবিলে রেখে বিলুর দিকে ফেরেন মিলি খালা, ‘বই পড়া কিন্তু ভারি আনন্দের কাজ। আর এই আনন্দ যে একবার পেয়ে যায়, তাকে ফেরানো বড়ই মুশকিল।’
‘তাই?’, বিলু অবাক হয়।
‘হ্যাঁ। লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন কী বলেন জানিস? “একবার যার পড়ার নেশা লেগেছে, সে কি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তা ছাড়তে পারবে?” ভিনসেন্ট স্টারেটের ভাষায়, “আমরা যখন বই সংগ্রহ করি, তখন আমরা আনন্দকেই সংগ্রহ করি।” তবে বই পড়লে কিন্তু শুধু আনন্দই পাওয়া যায় না। আরও অনেক কারণেই বই পড়া উপকারী।’
‘যেমন?’
‘তবে শোন’, মিলি খালা বলতে শুরু করলেন। ‘বই পড়লে জানা যায় নানা কিছু। আমাদের দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বলেন, “পাঠাগার নিঃসন্দেহে লিখিত ভাষার সঞ্চয়। এখানে মানুষ বিপুল পৃথিবীর বিচিত্র সঞ্চয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়।” একটা নতুন বই জানায় নতুন সব তথ্য, যা তোর বেঁচে থাকাকে করে অসাধারণ! গবেষণায় দেখা গেছে, বই পড়া ইতিবাচক প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কে, তাকে রাখে সচল, প্রতিরোধ করে স্মৃতিভ্রষ্টতা বা আলঝেইমারের মতো অসুখও।
‘গান শোনা বা হাঁটাহাটি করার চেয়েও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে বেশি সহায়ক হলো বই পড়া। বই পড়তে গেলে তোকে চিন্তাভাবনা করতে হয়, মনে রাখতে হয় নানা কিছু। ঠিক সেই কারণে যখন তুই বই পড়িস, তোর স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি আর শব্দভান্ডার বাড়ে। তুই নিশ্চয়ই শুনেছিস আইনস্টাইনের এই বাণী—কল্পনা করাটা জ্ঞানার্জনের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’
বিলু মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ।’
‘কল্পনাশক্তির পাশাপাশি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসার দক্ষতাও বৃদ্ধি পায় বই পড়লে।’, মিলি খালা বলেন। ‘আমরা আজকে যে অবস্থানে আছি, সেটা খুঁজে পাই বই পড়ার মাধ্যমে। এটি ভবিষ্যতে আমাদের গন্তব্যও নির্দেশ করে। কবিগুরুর ভাষায়, “মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।” আচ্ছা, লেখালেখি করিস তুই?’
‘তেমন একটা না। তবে এবার স্কুল ম্যাগাজিনে একটা ছড়া লিখেছিলাম।’
‘হ্যাঁ। লেখালেখি শিখতে পড়তে হয় প্রচুর বই। বিশ্বের যত বড় লেখক ছিলেন, তাঁরা সবাই-ই ছিলেন বেশ ভালো পাঠকও। লেখালেখির কৌশল শিখতে পারবি তুই বই পড়লে। এ ছাড়া বই পড়ে তোর যে শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে, তা কাজে লাগবে লেখালেখিতেও। ...আচ্ছা, ঘুম কেমন হয় তোর?’
‘ঘুমাই এই তো আরকি।’, বিলু মাথা চুলকায়।
‘উঁহু, এই বয়সে ঘুমে সমস্যা হওয়া মোটেও কাজের কিছু না। রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়বি, বুঝলি? ঘুমানোর আগে স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকলে তো ঘুমের বারোটা বাজবেই। স্মার্টফোনের নীল আলো তোকে ঘুমাতে দেয় না রাতে।’, মিলি খালা চশমা খুললেন।
উঁহু, এই বয়সে ঘুমে সমস্যা হওয়া মোটেও কাজের কিছু না। রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়বি, বুঝলি? ঘুমানোর আগে স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকলে তো ঘুমের বারোটা বাজবেই। স্মার্টফোনের নীল আলো তোকে ঘুমাতে দেয় না রাতে।
‘বই পড়লে বাড়ে সহনশীলতা। জন্মায় অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাও। নিয়মিত পড়ার অভ্যাস থাকলে তুই যুক্তি দিয়ে কথা বলা শিখবি। বেরিয়ে আসতে পারবি অন্যের ওপর মতামত চাপিয়ে দেওয়ার স্বভাব থেকেও। সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম শুনেছিস?’
‘উঁহু।’, বিলু মাথা নাড়ে।
‘এই মানুষটি দেশে বিদেশে, জলে ডাঙায়সহ দারুণ সব ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। রম্যরচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। তো, এই মানুষটি বলেন, “পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের একচোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত ঘোঁত করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কী? প্রথমত, বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি।”
‘বই পড়তে কিন্তু খরচ হয় না খুব বেশি। অনেক সময়ই বই কিনে পড়াটা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে বই পড়তে পারিস লাইব্রেরি থেকে এনে। ...বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম তো আছেই। তোর পড়ুয়া বন্ধুটি থেকে ধার করতে পারিস বই। এখন তো বেশ কিছু চেইন বুকশপও গড়ে উঠেছে ঢাকায়। সেখানে বসেও পড়তে পারিস। নীলক্ষেতে পুরোনো বই কিনতে পাওয়া যায় বেশ অল্প দামে। চাইলে আমার কাছ থেকেও নিতে পারিস। আর হ্যাঁ, বই পড়ার সময় নোট করে রাখবি প্রিয় লাইন। “শিক্ষকদের শিক্ষক” প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতে, এটা অনেকটা খেত চাষ করার সময় আল বাঁধবার মতো।’
‘আচ্ছা খালামণি, তুমি বই ধার দাও?’, বিলু জিজ্ঞেস করে।
‘দিই।’, মিলি খালা বলেন। ‘তবে শর্ত একটাই: যত্ন নিয়ে পড়তে হবে...একটা মিনিট দাঁড়া।’
এই বলে মিলি খালা তাঁর ট্রাঙ্ক হাতড়ে একটা বই বের করে দিলেন বিলুকে, ‘নে। জ্যাক লন্ডনের সি উলফ। সেবার বই। আশা করি, পড়ে মজা পাবি। আর হ্যাঁ, পড়ে একটা রিভিউ লিখে দেখাবি কিন্তু!’
বিলু ‘থ্যাংকু’ বলে একটা ধ্যাবড়া চুমু খেল মিলি খালার গালে।