আর্জেন্টিনার দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছোটখাটো গড়নের সেই ছেলেটি যে একদিন ফুটবল বিশ্বকে পায়ের জাদুতে বুঁদ বানিয়ে রাখবে, তা কে ভেবেছিল! বলছিলাম ডিয়েগো ম্যারাডোনার কথা। ফুটবল মাঠে বল পায়ে দুরন্ত ছুটে চলা ছেলেটিকে নিয়ে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা, তাঁর ছেলে ব্রাজিলীয় তারকা পেলের চাইতেও বড় খেলোয়াড় হবে।
আর্জেন্টিনার ভিলা ফিওরিতো শহরের ছোট্ট ঘর, সেখানে আট ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন ডিয়েগো-দোনা তোতা দম্পতি।চার মেয়ের পর পঞ্চম সন্তান হিসেবে ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্ম হয় ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর। কখনো শ্রমিক, কখনো নৌকায় যাত্রী পারাপার—এভাবেই উপার্জন করতেন ডিয়েগো সিনিয়র। বড় ছেলে ম্যারাডোনার ফুটবলপ্রেম সেই তিন বছর বয়স থেকে। সেবারের জন্মদিনে কাজিনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ফুটবল পেয়েছিলেন তিনি।তারপর ফুটবলই তাঁর ধ্যান, ফুটবলই তাঁর জ্ঞান। প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত ওই ফুটবল তাঁর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। খাওয়ার সময় ফুটবল, খেলার সময় ফুটবল, এমনকি ঘুমানোর সময়ও ফুটবল সঙ্গে থাকত তাঁর। ফুটবলের প্রতি ছেলের এই অদম্য প্রেম দেখে মা-বাবা আর বাধা দেননি। বরং ছেলেকে ফুটবল খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন।
৯ বছরের ছোট্ট বালক ম্যারাডোনা, সুযোগ পেলেন গ্রামের দল লিটল অনিয়নের হয়ে খেলার। অভিষেকেই তিনি দুর্বার, তাঁর চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড় ছেলেদের অনায়াসে নাকানিচুবানি খাইয়ে ম্যাচ জেতালেন দলকে। যতবারই তাঁর পায়ে বল যায়, উপস্থিত দর্শকদের হর্ষধ্বনিতে শোরগোল পড়ে যায়। এত কম বয়সী কাউকে এমন খেলা খেলতে দেখেননি তাঁরা। শুধু সেই ম্যাচ নয়, ম্যারাডোনা দলকে জেতালেন টানা ১৪০ ম্যাচ। খবরের পাতায় তাঁকে নিয়ে ছাপা হলো শিরোনাম।
বাবা ডিয়েগো সিনিয়র তখন দারুণ গর্বিত।কাজের ফাঁকে সময় বের করে প্রতি ম্যাচেই মাঠে যান ছেলের খেলা দেখতে।বাড়তি কাজ করে, কিছু টাকা জমিয়ে ছেলের জন্য কেনেন দামি বুট আর জার্সি।ছেলের প্রতিভা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তাঁর মনে, কেবল পরিচর্যা আর যত্নের অভাবে যেন সেই প্রতিভায় মরচে না ধরে, সেটিই নিশ্চিত করছিলেন তিনি।
মা দোনা তোতাও কম ত্যাগ স্বীকার করেননি।অভাবের সংসারে সবার আহার জোগাড় হতো না। মাঝেমধ্যেই ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে নিজে না খেয়ে থাকতেন। তবে বুঝতে দিতেন না কাউকে। কখনো পেটব্যথা, কখনো খিদে নেই, এমন অজুহাতে খেতেন না তিনি।বালক ম্যারাডোনা তত দিনে মায়ের এসব ছেলেভোলানো ফাঁকি ধরতে শিখে গেছেন। তাই মনে মনে ঠিক করেন, ফুটবল খেলে একদিন সংসারের সব অভাব দূর করবেন।
পারলেনও তাই! মাত্র ১৫ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হলো ম্যারাডোনার। ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনো জুনিয়রসের হয়ে খেলতে নামেন তিনি। উল্লেখ্য, সে সময় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী আর্জেন্টাইন পেশাদার ফুটবলার।
ম্যারাডোনা ছিলেন মূলত বাম পায়ের খেলোয়াড়।খেলতেন মাঝমাঠে, প্লে-মেকার হিসেবে। গোল করার চাইতে দলের কাউকে দিয়ে গোল করাতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। যে কারণে গোলসংখ্যা দিয়ে ম্যারাডোনার মাহাত্ম্য ঠিকমতো বোঝানো যায় না।
তবুও ক্যারিয়ারের প্রথম পেশাদার ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়রসের হয়ে ১৬৭ ম্যাচে ১১৫ গোল করার পরিসংখ্যান বলে, স্ট্রাইকার হিসেবে খেললে সংখ্যার বিচারে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেন।
আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ১৯৭৯ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে জেতেন যুব বিশ্বকাপ। তত দিনে ম্যারাডোনার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। আর্জেন্টিনা থেকে তাঁকে ইউরোপে নিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। প্রথমবারের মতো সুযোগ হয় বিশ্বকাপ খেলার। আর্জেন্টিনার ফুটবলে তখন ম্যারাডোনাকে ঘিরে ভক্তদের উচ্চাশা। কিন্তু ১৯৮২-এর বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনা বিদায় নেয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে হেরে। এবং ঠিক সেই ম্যাচেই লাল কার্ড দেখেন ম্যারাডোনা। পুরো টুর্নামেন্টেও তিনি অনুজ্জ্বল ছিলেন।
ম্যারাডোনাকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। বাম পায়ের জাদুতে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো, সুনিপুণ ড্রিবলিং, প্রচণ্ড গতি, ক্ষুরধার পাস এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিপক্ষের দুর্বল স্থান বের করার অনন্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।কিন্তু এমন নৈপুণ্য তো দক্ষিণ আমেরিকার খেলোয়াড়দের জন্য ডালভাত।শুধু এই বিচারে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া যায়?
বাম পায়ের জাদুতে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো, সুনিপুণ ড্রিবলিং, প্রচণ্ড গতি, ক্ষুরধার পাস এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিপক্ষের দুর্বল স্থান বের করার অনন্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
ফুটবল দলগত খেলা।সেখানে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে একক নৈপুণ্যে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই।
১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মধ্যম সারির দল হিসেবে অংশ নেয়।তাদের থেকে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না কারোরই।কিন্তু আগের বিশ্বকাপে মাথা নত করে বিদায় নেওয়া ম্যারাডোনার মধ্যে যেন রোখ চেপেছিল। একের পর এক প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করলেন একক নৈপুণ্যে। কখনো ডিফেন্স চেরা পাস দিয়ে গোল করান সতীর্থকে, কখনো আবার নিজেই স্ট্রাইকারের মতো সুনিপুণ গোলে জেতান আর্জেন্টিনাকে।মেক্সিকোর মাটিতে হওয়া সেবারের টুর্নামেন্টের হট ফেবারিট ইতালিকে রুখে দিয়ে নকআউট রাউন্ডে উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারানোর মূল নায়ক ছিলেন ম্যারাডোনাই।কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচটি তো বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ম্যাচগুলোর একটি। হ্যান্ড অব গডের বিতর্কিত গোলটির পর ম্যারাডোনা মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে একে একে পুরো ইংল্যান্ড দলকে বোকা বানিয়ে করলেন শতাব্দীর সেরা গোলটি। তাঁকে নিয়ে ওঠা সব সন্দেহ তখন ধূলিসাৎ! অমিত প্রতিভাবলে বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ফুটবল দর্শকদের কাছে তিনি তখন অবিসংবাদিত সেরা। দলীয় খেলা ফুটবল যেন তখন এক জাদুকরের পায়ে বন্দী!
সেই পায়ে বন্দী হলো বেলজিয়ামও, সেমিফাইনালে তারা স্রেফ উড়ে গেল শুধু ম্যারাডোনার কাছে। ইংল্যান্ডের মতো পুরো বেলজিয়াম দলকে বোকা বানিয়ে ঠিক একই রকম আরেকটি গোল করলেন এই ম্যাচেও। ফুটবলের সব সৌন্দর্য তখন যেন কেবল তাঁর পায়েই লুটোপুটি খাচ্ছে। জাদুকরের সম্মোহনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে বিশ্বমঞ্চ! ২-০ গোলে ম্যাচ জিতে ফাইনালে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা।
ফাইনালের ম্যারাডোনাও একই রকম অদম্য।কেবল গোল পাননি।কিন্তু পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচটির নেপথ্যের নায়ক তিনিই।তারপর সেই বিখ্যাত পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চ, একক জাদুতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো ম্যারাডোনা চুমু আঁকলেন ট্রফিতে।
ফুটবলে তাঁর আগে এতটা একক প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি কেউ, ম্যারাডোনার শ্রেষ্ঠত্ব এখানে।
১৯৯০-এর বিশ্বকাপেও ঠিক একই রকম গল্প।ম্যারাডোনা ফাইনালে টেনে তুললেন আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু সেবার জার্মানির কাছে হারায় ট্রফি জেতা হয়নি।
জাতীয় দলের মতো ম্যারাডোনা একই রকম গল্পের নায়ক ক্লাবের হয়েও।বার্সেলোনা থেকে নাপোলিতে যখন নাম লিখিয়েছেন, তখন তারা ইতালির মধ্যম সারির দল।বড় দলগুলো হেয় করত তাদের।খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের দর্শকেরা টিটকারি দিত নেপলসের নিম্ন আয়ের মানুষদের। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া ম্যারাডোনা জানতেন কীভাবে ভাগ্যকে বদলাতে হয়। জানতেন কীভাবে ছাই থেকে জন্ম নিয়ে ফিনিক্সের মতো উড়তে হয়। নাপোলিকেও একক নৈপুণ্যে বদলালেন তিনি।
ক্লাবের ইতিহাসের প্রথম লীগ শিরোপা তারা জিতল ম্যারাডোনার হাত ধরে। তারপর দ্বিতীয়টাও। এর মাঝে জিতিয়েছেন ইতালির ক্লাব কাপ আর ইউরোপিয়ান ট্রফিও।মধ্যম সারির নাপোলি তখন মিলান, জুভেন্টাস, ইন্টারদের সঙ্গে টেক্কা দেয় লিগ টেবিলে। প্রতিপক্ষ দর্শকেরা আর টিটকারি দেয় না, বরং সমীহ করে। এর সবকিছুই হলো ম্যারাডোনার বদৌলতে। নেপলসবাসী তখন তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে দিল।সত্যিই তো! ঈশ্বর ছাড়া কে পারেন এমন রাতারাতি ভাগ্য বদল করতে?
ফুটবল, ফুটবল এবং ফুটবল—ম্যারাডোনা ছোট থেকে বড় হয়েছেন এই মন্ত্রে। তিনি যত দিন এই মন্ত্রে বিশ্বাস করে মাঠে নেমেছেন, সাফল্য পেয়েছেন অবিরাম। আর বিশ্বজুড়ে কয়েকটা প্রজন্মকে বানিয়েছেন তাঁর অন্ধভক্ত, তাদের কাছে ফুটবলের অপর নাম ম্যারাডোনা, সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি ম্যারাডোনা।
যাঁর বিদায়ে তাই অবিশ্বাস নিয়ে কাঁদে আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশের কোটি কোটি ভক্ত।