কেমন আছ তোমরা? পড়াশোনার খুব চাপে আছ তাই না? পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য তোমাদের সারা বছরই স্কুলের পড়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। এত ব্যস্ততার পরও তোমাদের সৃজনশীল কাজ কিন্তু থেমে নেই। কেউ গান গাও, আবৃত্তি করো, অভিনয় করো, নাচো, কেউ-বা ছবি আঁকো—অনেক শিল্পমাধ্যমেই তোমরা পারদর্শী। আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শিল্প নিয়ে তোমাদের সঙ্গে গল্প করব। এই শিল্পের নাম বিতর্ক। তর্ক তো আমরা সবাই করি। বিতর্ক তবে কী?
আমরা তর্ক করি কেন? নিজের মত বা ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অর্থাৎ আমি যা পছন্দ করি, আমি যা চাই, তা পাওয়ার জন্য যে শব্দ, বাক্য আমরা উচ্চারণ করি সেটাই তর্ক। তর্ক তো তোমরা সবাই করো। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-আত্মীয়—সবার সঙ্গে তর্ক করো। সমবয়সীদের সঙ্গে তর্ক করতে করতে মাঝেমধ্যে মারামারিতে তোমরা জড়িয়ে পড়ো। সেই মারামারিতে কখনো কখনো রক্তপাত ঘটে। তর্ক থেকে রক্তপাত ঘটার এমন দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ কিন্তু সব বয়সী মানুষের মধ্যেই রয়েছে। শুধু ছোটদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তর্কের এমন দুঃখজনক পরিণতি কেন হয় জানো? এসব তর্কে জেদ, রাগ আর একগুঁয়েমি থাকে। রাগ কিন্তু আমাদের পরাজিত করে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাই বলেন, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
শিল্প মানে তো সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কাজেই বুঝতে পারছ, তর্কে কোনো সৌন্দর্য নেই। তাই এটি শিল্প নয়। বিতর্ক একটি শিল্প। সৌন্দর্যমণ্ডিত, পরিশীলিত, যুক্তিপূর্ণ তর্কই হচ্ছে বিতর্ক। সুন্দর করে গুছিয়ে, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে যখন কেউ কথা বলে, দেখতে নিশ্চয়ই তোমাদের ভালো লাগে। সেই ব্যক্তির কথা নিশ্চয়ই মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছা করে। একটি উদাহরণ দিই। তোমাদের স্কুলে বিভিন্ন শিক্ষক বিভিন্ন বিষয় পড়ান। নিশ্চয়ই সবার পড়ানোর স্টাইল তোমাদের কাছে ভালো লাগে না। চোখ বন্ধ করে ভাবো তো, কোন শিক্ষককে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে? যিনি খুব সুন্দর, সাবলীলভাবে তোমাদের সামনে কথা বলেন। অর্থাৎ যিনি সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, তিনিই তোমাদের মন জয় করে নিতে পারেন। সুন্দরভাবে, গুছিয়ে কথা বলা একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। এই যোগ্যতা অর্জনে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম বিতর্কচর্চা। বিতর্ক তাই খুব উঁচুমাপের শিল্প।
একজন আদর্শ বিতার্কিকের অপরিহার্য সঙ্গী যথার্থ স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্ট মানে লিখিত বক্তব্য। এটি ব্যবহারের কৌশল রয়েছে। কেউ কেউ বড় বড় কাগজ ও পুরো খাতা নিয়ে স্টেজে উঠে বিতর্ক করেন, যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।
শুধু শিল্প নয়, জ্ঞানচর্চারও একটি অসাধারণ মাধ্যম বিতর্ক। তোমরা নিশ্চয়ই বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের নাম শুনেছ। তাঁদের জন্ম প্রাচীন গ্রিসে। গ্রিসের রাজধানী এথেন্সকে কেন্দ্র করে যে নিত্যনতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, এর মূলে ছিল বিতর্কচর্চা। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বলে স্বীকৃত, সেই গণতন্ত্রেরও জন্মস্থান গ্রিস। তোমরা জেনে অবাক হবে যে গণতন্ত্রের সঙ্গে বিতর্কের সম্পর্ক খুব নিবিড়। বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের কথা, যুক্তি শোনার মানসিকতা তৈরি হয়; পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার মানসিকতা গড়ে ওঠে। আধুনিক সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। আমাদের সংবিধানেও বাক্স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে চিন্তা করে দেখো, বিতর্ক কত বড় একটি শিল্প। এই শিল্পে যদি তোমরা নিজেদের দীক্ষিত করতে পারো, তাহলে একই সঙ্গে তোমাদের ভেতরে জন্ম নেবে জ্ঞানতৃষ্ণা, যুক্তিবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চেতনা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে মানুষ নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে, সে মানুষই আলোকিত মানুষ। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সেই আলোকিত মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
টেলিভিশনের পর্দায়, নিজের স্কুলে তোমরা অনেকেই বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখেছ। তর্কযুদ্ধে কীভাবে বিতার্কিকেরা অংশগ্রহণ করে, তা তোমাদের অনেকেরই জানা। ক্লাসে নিশ্চয়ই তোমরা ব্যাকরণ পড়েছ। যেকোনো ভাষার ব্যাকরণ জানা থাকলে সেই ভাষা দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করা যায়। ব্যাকরণ মানে নিয়ম বা রীতি। বিতর্কেরও ব্যাকরণ রয়েছে। এই ব্যাকরণ কিন্তু নিরস কোনো বিষয় নয়। আগ্রহ নিয়ে শুনলে তোমরা উপভোগ করবে বিতর্কের নিয়মকানুন।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দুটি পক্ষ থাকে। প্রতি দলে সাধারণত তিনজন সদস্য থাকেন। বিতর্ক পরিচালনার জন্য একজন সভাপতি বা মডারেটর থাকেন। মূল্যায়ন করার জন্য তিন বা ততোধিক সদস্যের বিচারকমণ্ডলী থাকেন। প্রস্তাব বা বিষয়ের পক্ষে বিতর্ক করে একটি দল। বিপক্ষে বিতর্ক করে অন্য দলটি। প্রত্যেক বক্তা পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় পান। দুই দলনেতা যুক্তিখণ্ডনের জন্য অতিরিক্ত দুই মিনিট সময় পান। অর্থাৎ বিতর্ক একটি দলীয় প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার জন্য এখন আমরা বিতর্কের ব্যাকরণ নিয়ে কথা বলব। সেই ব্যাকরণের প্রথম বিষয় স্ক্রিপ্ট।
স্ক্রিপ্ট নির্মাণ
একজন আদর্শ বিতার্কিকের অপরিহার্য সঙ্গী যথার্থ স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্ট মানে লিখিত বক্তব্য। এটি ব্যবহারের কৌশল রয়েছে। কেউ কেউ বড় বড় কাগজ ও পুরো খাতা নিয়ে স্টেজে উঠে বিতর্ক করেন, যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। ছোট ছোট কাগজে বক্তব্যের মূল পয়েন্ট এবং যুক্তি প্রদান ও খণ্ডনের বিষয়গুলো টুকে নিলে একটি স্ক্রিপ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।
কোনো কোনো বিতার্কিক পুরো স্ক্রিপ্ট রিডিং পড়ে যান। এটি কোনোভাবেই বিতার্কিকসুলভ আচরণ নয়। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি এ কাজ করতে পারেন। তাঁর সঙ্গে একজন বিতার্কিকের পার্থক্য কোথায়? আবার স্ক্রিপ্টের দিকে একবারও না তাকিয়ে পুরো স্ক্রিপ্ট মুখস্থ বলে যাওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। রচনা (Essay) লেখার ক্ষেত্রে সাবহেডিং বা উপশিরোনাম ব্যবহার করো তোমরা। স্ক্রিপ্ট নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই কৌশল ব্যবহার করতে হবে। পাঁচ মিনিটের বক্তব্যকে কয়েকটি উপশিরোনামে বিভক্ত করতে হবে। স্ক্রিপ্টে উপশিরোনামগুলো লিখিত থাকবে। উপশিরোনামের দিকে তাকানোমাত্রই যেন বিতার্কিকের সংশ্লিষ্ট বক্তব্যটুকু মনে পড়ে। এভাবে অনুশীলন করলে একজন বিতার্কিক তাঁর স্ক্রিপ্টের দিকে তাকাবেন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তাহলেই সাবলীলভাবে স্ক্রিপ্ট ব্যবহার তাঁর আয়ত্তে আসবে। ২য় বক্তা এবং ৩য় বক্তা অবশ্যই পাঁচ মিনিটের জন্য স্ক্রিপ্ট করবেন না। যেহেতু তাঁদের আগে প্রতিপক্ষের এক বা একাধিক বক্তা বক্তব্য রাখেন, তাই প্রতিপক্ষের বক্তা বা বক্তাদের যুক্তিখণ্ডনের পরিসর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে চার বা সাড়ে চার মিনিটের স্ক্রিপ্ট হওয়া যুক্তিযুক্ত। অবশিষ্ট সময়ে প্রতিপক্ষের বক্তা বা বক্তাদের যুক্তি খণ্ডন করলে তা সাফল্য অর্জনে সহায়ক হবে।
দলীয় সমন্বয়ের কথাটি মাথায় রাখতে হবে। দলের তিনজন বক্তাকেই পরস্পরের স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, যেন কোনো ক্ষেত্রেই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আবার এটিও খেয়াল রাখতে হবে, যেন স্ববিরোধী বা সাংঘর্ষিক কোনো উপকরণ না থাকে কারও স্ক্রিপ্টে। যদি কারও স্ক্রিপ্টে অতিরিক্ত বক্তব্য থাকে এবং কারও স্ক্রিপ্টে বক্তব্যের ঘাটতি থাকে, তবে সংযোজন–বিয়োজনের মাধ্যমে দলে তিনজন বিতার্কিকের স্ক্রিপ্টই সুগঠিত ও পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দলের তিনজন বিতার্কিকের মনোভাব হবে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক নয়।
শারীরিক ভাষা
যেকোনো বাচনিকশিল্পে শারীরিক ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংগীত, অভিনয়, আবৃত্তি প্রভৃতি মাধ্যমে উঁচুদরের সাফল্য পাওয়ার অন্যতম শর্ত নিখুঁত শারীরিক ভাষা। বিতর্কও এর ব্যতিক্রম নয়। শারীরিক ভাষা নান্দনিক বোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিতর্ক শুধু শোনার বিষয় নয়, দেখারও বিষয়। বিতার্কিকের বাহ্যিক সৌন্দর্য যা–ই হোক না কেন, নিজেকে রুচিশীল ও যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারাই বিতার্কিকের প্রকৃত সৌন্দর্য। আপাতদৃষ্টিতে শারীরিক ভাষাকে খুব নিরীহ মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে বিতার্কিকের পারফরম্যান্সের ওপর।
তোমরা জেনে অবাক হবে যে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের শতকরা ৯৩ ভাগ সম্পন্ন হয় শারীরিক ভাষার মাধ্যমে। অবশিষ্ট ভাগ সম্পন্ন হয় কথা বলার মাধ্যমে। মানুষের প্রতিটি প্রত্যঙ্গই সার্থক যোগাযোগে ভূমিকা পালন করে। বিতর্কের ক্ষেত্রে কিছু প্রত্যঙ্গের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্কে একটি বলিষ্ঠ শারীরিক ভাষা আয়ত্ত করার জন্য কয়েকটি পূর্বশর্ত রয়েছে:
মাইক্রোফোনের ব্যবহার
শারীরিক অবস্থান
চোখের ভাষা
হাতের ব্যবহার
উত্তেজনা পরিহার
স্বল্পতম স্ক্রিপ্ট নির্ভরতা
মাইক্রোফোনের ব্যবহার
মাইক্রোফোনের যথাযথ ব্যবহারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে শারীরিক ভাষা নির্মাণে। সংসদীয় বিতর্ক ছাড়া অন্য বিতর্কগুলোতে মাইক্রোফোন ডায়াসের সঙ্গে বিন্যস্ত থাকে। অনেকেই মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে শব্দযন্ত্র পরীক্ষকের মতো মাইক্রোফোনে ফুঁ দিয়ে আওয়াজ পরীক্ষা করেন। এটি অত্যন্ত রুচিহীন ও দৃষ্টিকটু কাজ। কোনো বিতার্কিকের যদি এ নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে তিনি আঙুল দিয়ে আলতো টোকা দিলেই বুঝতে পারবেন মাইক্রোফোনটি সচল না অচল। কেউ কেউ মুখের এত কাছে মাইক্রোফোন ব্যবহার করেন যে তাঁর কথা স্পষ্ট শোনা যায় না এবং দৃষ্টিকটু লাগে। আবার মাইক্রোফোন খুব দূরে রাখারও প্রয়োজন নেই। মুখ থেকে তিন–চার আঙুলের দূরত্বে থাকলে মাইক্রোফানের যথাযথ কার্যকারিতা পাওয়া যায়। এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিতার্কিককে লক্ষ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাঁর প্রতি বিচারক ও দর্শকদের ইমপ্রেশন নেতিবাচক করে দেয়।
শারীরিক অবস্থান
বিতর্ক মঞ্চে বিতার্কিকের শারীরিক অবস্থান দুই ধরনের। প্রথমত, যখন তিনি বিতর্ক করছেন, সেই মুহূর্তের অবস্থান। দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট সময় যখন তিনি সতীর্থদের সঙ্গে বসে থাকেন। বিতর্ক করার সময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। আনুভূমিক ও লম্বালম্বি উভয়ভাবে মাথার অবস্থান থাকবে সোজাসুজি। বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো বা কোমরে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাঁর দাঁড়ানোর
ভঙ্গি অবশ্যই আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ হতে হবে। কেউ কেউ পা নড়াচড়া করেন। এতে বিতর্কের গতি ব্যাহত হয়। সতীর্থদের সঙ্গে আসন গ্রহণ করার সময় শান্ত ও মনোযোগী হতে হবে। মনোযোগ দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষের বক্তব্য শুনবেন। সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলতে হলে নিচুস্বরে সংক্ষেপে তা সারবেন। কেউ কেউ বসে থাকার সময় এদিক–সেদিক তাকান, চুল ঠিক করেন, নাক চুলকান। এগুলো অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং বিতার্কিক হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
চোখের ভাষা
একটি জনপ্রিয় গানে বলা হয়েছে, ‘চোখ যে মনের কথা বলে।’ কথাটি সর্বাংশে সত্য। শারীরিক ভাষা কতটা নিখুঁত, তা বোঝা যায় বিতার্কিকের Eye Contact দেখে। বিতার্কিকের কাছে যান্ত্রিক বক্তব্য প্রত্যাশিত নয়। বিতার্কিক যদিও মঞ্চে উপবিষ্ট ‘সভাপতি’, ‘বিচারকণ্ডলী’ ও ‘প্রতিপক্ষ’কে সম্বোধন করেন, এরপরও তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে সামনে উপবিষ্ট দর্শকমণ্ডলী থাকতে হবে। কারণ তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা। যখন যাঁকে সম্বোধন করা হবে, তখন তাঁর দিকে তাকাতে হবে। সভাপতিকে সম্বোধন করে প্রতিপক্ষের দিকে তাকানো অর্থহীন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দর্শকদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়। যখন বিতার্কিক দর্শকদের উদ্দেশে কথা বলছেন, অবশ্যই দর্শকদের দিকে তাকাতে হবে। এভাবে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ হয়। সচেতন দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে বিতর্ক মিলনায়তনটিকে নিজের আয়ত্তে আনা সম্ভব। চোখের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে বিতার্কিকের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এমনকি আত্মবিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাসের অভাব—প্রতিটি চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিখুঁত চোখের ভাষা ব্যবহার করে একজন বিতার্কিক তাঁর বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারেন।
কোনো কোনো বিতার্কিক পুরো স্ক্রিপ্ট রিডিং পড়ে যান। এটি কোনোভাবেই বিতার্কিকসুলভ আচরণ নয়। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি এ কাজ করতে পারেন। তাঁর সঙ্গে একজন বিতার্কিকের পার্থক্য কোথায়?
হাতের ব্যবহার
হাতের নান্দনিক ব্যবহার বিতার্কিকের শারীরিক ভাষাকে আকর্ষণীয় করে। অনেক বিতার্কিক হাত নিয়ে মহাবিপদে পড়ে যান। হাত নিয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। বিতার্কিক ডায়াসে গিয়ে কথা বলার সময় বক্তব্য রাখতে রাখতে হাতের পরিমিত ব্যবহার করতে পারেন। কেউ কেউ পকেটে হাত ঢোকান। এটি অনুচিত। কেউ কেউ ডায়াসে কনুই ভর দিয়ে রাখেন। এটি খুব দৃষ্টিকটু আচরণ। হাতের পরিমিত ব্যবহার করতে অপারগ হলে বিতার্কিক একটি নিরাপদ উপায় অবলম্বন করতে পারেন। ডায়াসের দুই প্রান্তে হাত দুটো আলতোভাবে রেখে বিতর্ক করা যায়। হাত যেন বুকের সঙ্গে আড়াআড়ি অবস্থানে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু হাতের ব্যবহার নয়, সমগ্র শারীরিক ভাষাকে আয়ত্তে আনার জন্য বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুশীলন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তখন বিতার্কিক নিজেই বুঝতে পারেন, তাঁকে কোন অবস্থানে কেমন দেখাচ্ছে।
উত্তেজনা পরিহার
উত্তেজনা শক্তি নয়। এটি বরং দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। অনেকে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বিতর্ক করতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মুখ ও হাতের বিকৃত ব্যবহার করেন। এটি কোনো বিতার্কিকের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না; বিশেষ করে সংসদীয় বিতর্কে উত্তেজনার কুরুচিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ মাঝেমধ্যে দেখা যায়। কোনো কোনো বিতার্কিক এত বেশি অঙ্গভঙ্গি করেন, যা তাঁকে হাস্যকররূপে উপস্থাপন করে। কেউ কেউ উত্তেজনাবশত নিজের জায়গা ছেড়ে কথা বলতে বলতে কয়েক গজ দূরে চলে যান। উত্তেজনার কারণে তাঁদের হাত–মুখের ব্যবহার বেশ অশোভন হয়ে পড়ে। আক্রমণাত্মক বিতর্ক অবশ্যই করা যাবে। কিন্তু আক্রমণেরও সৌন্দর্য রয়েছে। সেই সৌন্দর্য ব্যাহত করে, এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয়। এতে বিতার্কিকের নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
স্বল্পতম স্ক্রিপ্টনির্ভরতা
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, স্ক্রিপ্ট ব্যবহারের প্রভাব রয়েছে শারীরিক ভাষার ক্ষেত্রে। হাতে একদম কাগজ না রেখে বিতর্ক করা অবশ্যই কৃতিত্বের ব্যাপার। কিন্তু এতে একটি ঝুঁকি থেকে যায়। মনে হতে পারে, বিতার্কিক মুখস্থ বলছেন। কেউ কেউ পুরো স্ক্রিপ্ট লিখে নিয়ে যান এবং প্রায়ই স্ক্রিপ্টের দিকে তাকান। এতে একজন সংবাদপাঠকের সঙ্গে বিতার্কিকের কোনো পার্থক্য থাকে না। কেউ কেউ এত বড় কাগজে লিখে নিয়ে আসেন, যা বিচারকও দেখতে পান। যেকোনো বিতর্কে স্ক্রিপ্টের সর্বোত্তম ব্যবহার হচ্ছে স্বল্পতম স্ক্রিপ্টনির্ভরতা। একটি ছোট কাগজে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো থাকতে পারে। প্রয়োজনে সেটি দেখে নিজের বক্তব্য প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতে হবে। কেউ যদি একান্ত অপারগ হয়ে পুরো স্ক্রিপ্ট নিয়ে মঞ্চে যান, তবে তা অবশ্যই ছোট ছোট কাগজে লিখে একত্রে স্ট্যাপলার করে নিতে হবে। এমন দৃশ্য দুর্লভ নয় যে স্ক্রিপ্টের পাতা উড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে এবং বিতার্কিক তা ওঠানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি বিব্রতকর দৃশ্য। এককথায় স্ক্রিপ্ট ব্যবস্থাপনা খুব দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
শারীরিক ভাষা মূলত ইঙ্গিত। একজন বিতার্কিক সম্পর্কে প্রাথমিক অথচ স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় শারীরিক ভাষা থেকে। খুব কৌশলী বিতার্কিক যাঁরা, তাঁরা শারীরিক ভাষার মাধ্যমে সহজেই চমত্কারভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। এতক্ষণের আলোচনায় নিশ্চয়ই তোমরা বুঝে গেছ, চমত্কার শারীরিক ভাষা আয়ত্ত করে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়।