একটা দোকান যে এত বড় সমস্যা তৈরি করবে, মনিমুল হক আগে বুঝতে পারেননি। একটা দোকান শুধু। মহল্লার মামুলি দোকান। কিন্তু সেটাই যে এমন জটিল প্যাঁচ কষবে, এমন মগজ ঘুরিয়ে দেবে, কে সেটা অনুমান করেছিল!
এমন না যে, এর দোকানদার ঘোড়েল ধরনের লোক, একটা রহস্যময় ফিচেল হাসি ঠোঁটে মেখে যিনি বসে থাকেন শিকারের অপেক্ষায় থাকা শ্বাপদের মতো বা এমনও নয় যে, সেই দোকানে অতিগোপনীয় কোনো পণ্য বিক্রি হয়, ক্রেতারা এসে প্রথমে ডানে-বাঁয়ে সন্তর্পণে তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে সেই পণ্য চায়, তারপর খবরের কাগজে মোড়ানো পণ্যটি চাদরের তলায় লুকিয়ে দ্রুতপায়ে চলে যায়। সেসব কিছুই না।
ফুটপাত ঘেঁষে আর দশটা দোকানের মাঝখানে খুব সাদামাটা একটা দোকান। চিপা আর লম্বাটে: ৭ ফুট বাই ১২ ফুট। একটা কাঠের বক্স টেবিল সামনেটা জুড়ে, সেটাই কাউন্টার। তার পেছনে চেয়ার নিয়ে দোকানদার গম্ভীর মুখে বসে থাকেন। গরমের সময় ঘামেন, শীতকালে চাদর মুড়ি দিয়ে জবুথবু। পণ্যসম্ভার যা আছে, তা পেছনে নানান তাকের মধ্যে সাজানো। মেঝেতেও কিছু পণ্য রাখা। দুটি এনার্জি বাল্ব আর একটা টিউবলাইট দিনের বেলায়ও জ্বালানো থাকে। একটা ছোট্ট ফ্যান ঘোরে মাথার ওপর। দোকানের সামনে একটা বুড়ো কুকুর শুয়ে থাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে।
এ রকম দোকান যেকোনো মহল্লার, যেকোনো রাস্তার ধারে চোখে পড়বে। কিন্তু এই দোকানটাকে ঘিরে একটা সংকট দেখা দিয়েছে। এটা যে ঠিক কিসের দোকান, বুঝে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না মনিমুল হকের পক্ষে। দোকানটা তাকে ধন্দে ফেলে দিয়েছে।
রোজ সেটার সামনে দিয়ে যান বটে, কিন্তু এত দিন দোকানটা আলাদা করে চোখেই পড়েনি মনিমুল হকের। শুধু যেদিন তাঁর ছোট মেয়ে লিসা স্কুলে যাওয়ার পথে হাতের কবজি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা, এটা কিসের দোকান?’ সেদিনই চোখ গিয়েছিল। সেবারই তিনি তাকিয়েছিলেন দোকানটার দিকে। এ পাড়ায় আসার পর গত সাত বছরে এই প্রথম। আর তাকিয়ে তিনি সাদামাটা মামুলি একটা দোকানই দেখতে পেয়েছিলেন। একটা ছোট্ট ওষুধের দোকান আর একটা চুল কাটার সেলুনের মাঝখানে দোকানটা।
একনজর তাকিয়ে মনিমুল হক লিসাকে বলেছিলেন, ‘এটা ডেকোরেশনের দোকান।’
‘ডেকোরেশনের দোকান মানে?’
‘মানে বিয়েবাড়ি বা কোনো দাওয়াতবাড়ি বা কোনো অনুষ্ঠান হলে এরা সেটা সাজিয়ে দেয়। কাপড় দিয়ে ঘিরে প্যান্ডেল বানিয়ে দেয়। শামিয়ানা টাঙিয়ে দেয়। চেয়ার–টেবিল পেতে দেয়। দাওয়াত খাওয়ার জিনিসপত্র—যেমন বড় বড় হাঁড়ি, ডেকচি, থালাবাসন, গ্লাস, বাটি—এগুলো সাপ্লাই দেয়।’
এটুকু শুনে লিসা বলেছিল, ‘গতকাল কিন্তু এখানে ডেকোরেশনের দোকানটা ছিল না, বাবা। গতকাল এখানে একটা মুদিদোকান ছিল।’
মনিমুল হক ‘ধ্যাৎ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন লিসার কথা। তা ছাড়া সেটা গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনো বিষয়ও ছিল না। মুদির দোকান বা ডেকোরেশনের দোকান—যা ইচ্ছা হোক না কেন।
কিন্তু পরদিন যখন সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার পথে লিসা আবার বলল, ‘বাবা, এটা কিসের দোকান?’ তখন সেদিকে তাকিয়ে মনিমুল হকের খটকা লেগেছিল। মৃদু একটা খটকা। সামান্য, খুবই সামান্য ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল তাঁর। এই প্রথম তিনি ভালো করে একবার তাকিয়েছিলেন দোকানটার দিকে। কেননা তিনি দেখছিলেন, সেটা একটা ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রির দোকান—নানান ধরনের বৈদ্যুতিক বাল্ব, সুইচ, বিদ্যুতের তার, টেবিল ল্যাম্প, মরিচবাতি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে সেখানে। এক পাশে ওষুধের দোকান, আর আরেক পাশে সেলুনটা একই রকম আছে। শুধু মাঝখানের দোকানটা বদলে গেছে। মনিমুল হকের স্পষ্ট মনে আছে, আগের দিন এখানে একটা ডেকোরেশনের দোকান ছিল।
এমন তো হতেই পারে। একটা ডেকোরেশনের দোকান ভালো চলছিল না বলে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়ে সেখানে একটা ইলেকট্রনিকের দোকান চালু হতে পারে। এমনকি এক রাতের মধ্যেও ঘটতে পারে এই বদল। কিন্তু সমস্যা হলো, দেখে মনে করার কোনো কারণ নেই, দোকানটা আজ চালু হয়েছে। ঝকঝকে পরিপাটি কোনো ব্যাপার নেই এটার মধ্যে। মনে হয়, বহুকাল ধরে দোকানটা চালু আছে। দোকানের শেলফ পরিপাটি নয়। অগোছালো। কাঠের কাউন্টার-কাম-টেবিলটাও বহু ব্যবহারের সাক্ষ্য বহন করছে। দোকানদার ভদ্রলোক যেভাবে বসে আছেন উদাস ভঙ্গিতে, বোঝা যায়, এই দোকানে এভাবে বহুদিন ধরে বসে থাকা তাঁর অভ্যাস।
স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সেদিন ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা ছিল না মনিমুল হকের। তিনি লিসাকে নিয়ে যানজট ঠেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন। বইয়ের ব্যাকপ্যাক কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে লিসা দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল বটে দোকানটার দিকে, মনিমুল হক তাকাননি। তিনি ততক্ষণে ভুলে গেছেন দোকানটার কথা।
তৃতীয় দিন ভুরু আরেকটু কুঁচকে গিয়েছিল মনিমুল হকের। এবার আর লিসাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। তিনি নিজেই তাকিয়েছিলেন দোকানটার দিকে। আশ্চর্য হয়ে তিনি দেখেছিলেন, আজ সেখানে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা: ‘মামুনস ইটারি’। একই রকম চালু দোকান। ঘোলা কাচের ভেতর দিয়ে র্যাকে সাজানো বার্গার, রেডিমেড পিৎজা, হটডগ ইত্যাদি দেখা যায়। একনজর দেখেই বোঝা যায়, খুব জমজমাট চালু একটা দোকান এবং নিশ্চিতভাবে সেটা বহুদিন ধরে চলছে।
আজ স্কুলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় লিসার পাশাপাশি মনিমুল হকও তিনবার ফিরে তাকালেন দোকানটার দিকে। আর যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার: লিসাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে তিনি এসে দাঁড়ালেন দোকানটার সামনে, যেটা এখন, এ মুহূর্তে, একটা ফাস্ট ফুডের দোকান। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, চিবুকে আঙুল রেখে কিছুক্ষণ একটানা সেটার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকলেন না তিনি, কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে দোকানটার স্লাইড ডোর সরিয়ে ভেতরে পা রাখলেন।
ব্যাপারটা আশ্চর্যের বলছি এ কারণে যে, মনিমুল হকের কৌতূহল বলে তেমন কিছু নেই আসলে। এত দিন ছিল না। জগতের কোনো ব্যাপারেই খটকা লাগে না তাঁর। ভুরু কুঁচকে যায় না। কদাচিৎ যদি যায়ও, তিনি আগ বাড়িয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করতে যাওয়ার লোক নন। কিন্তু পরপর তিন দিনের খটকার একটা বিহিত করতে তিনি পা বাড়ালেন। আর এটাই হলো মনিমুল হকের জীবনের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাঁর জীবনটা বদলে গেল।
ছোট সংকীর্ণ দোকান। স্লাইডিং ডোরের উল্টো দিকে একটা কাচের শোকেসে খাবার সাজানো। ওপরে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন, একটা ব্লেন্ডার মেশিন। র্যাকে কিছু ফলমূল। পেছনে একটা ছোট্ট ফ্রিজ। সামনে কোনোরকমে তিনটা চেয়ার আর একটা টেবিল পাতা। কাউন্টারে বসা এক মাঝবয়সী টেকো লোক। নাকের নিচে বাটারফ্লাই গোঁফ। আজকাল গোঁফওয়ালা লোক খুব বেশি চোখে পড়ে না। নীলরঙা পোলো শার্ট পরেছে লোকটা।
দেয়ালে নানা রকম পোস্টার। বেশির ভাগই ফলমূলের ছবি। টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ারে দুজন কাস্টমার বসা। মধ্যবয়স্ক এক মহিলা, আর ১২ বছরের এক বালক। সম্ভবত মা–ছেলে। বার্গার খাচ্ছে।
মনিমুল হক সোজা খাবারের শোকেসের সামনে দাঁড়ালেন। দোকানদার প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
একটা কিছু অর্ডার দিতে হয়। বেছে বেছে একটা সমুচা আর একটা আলুর চপ অর্ডার করলেন মনিমুল হক।
লোকটা দ্রুত অভ্যস্ত হাতে প্লেটে সাজিয়ে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দিল।
বসার চেয়ার একটা খালি আছে বটে, কিন্তু মা-ছেলের পাশে বসা চলে না। কাউন্টারে দাঁড়িয়েই খেতে শুরু করলেন মনিমুল হক। খেতে খেতে আলাপ জুড়ে দিলেন দোকানদারের সঙ্গে।
‘কেমন চলে দোকানটা?’
‘ভালোই। মহল্লার দোকান। খুব বেশি কাস্টমার পাই না। চলে যায়।’
‘কত দিন হলো?’
বাটারফ্লাই মোচ একনজর তাকাল মনিমুল হকের দিকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল।
‘কত দিন হলো দোকানটার?’
‘তিন বছর।’
‘এখানে?’
‘হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
‘না। কিছু না। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, আগে এখানে একটা ডেকোরেশনের দোকান ছিল। বা ইলেকট্রনিকসের দোকান।’
‘আপনার ডেকোরেশনের দোকান লাগবে? পাশের রোডে একটা আছে।’
‘না। না। এমনি বললাম।’
খেয়ে বিল দিয়ে বেরিয়ে এলেন মনিমুল হক।
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তাঁর। তিন বছর ধরে একটা খাবারের দোকান চলছে। জমজমাট। এখানে এক দিন আগে কী করে ইলেকট্রনিকসের দোকান, তার আগের দিন ডেকোরেশনের দোকান থাকে?
পরদিন সকালে একই রকম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল মনিমুল হকের জন্য। এবার তিনি ভিরমি খেলেন। খাবারের দোকানটা কোথায়? সেখানে এখন একটা লন্ড্রির দোকান। কোনো ভুল নেই। লন্ড্রির দোকান। কাপড় ধুয়ে আয়রন করে দেওয়ার দোকান। ‘মামুনস ইটারি’র কোনো চিহ্নও কোথাও নেই।
মনিমুল হক এমন ভড়কে গেলেন যে, তিনি স্কুলব্যাগ কাঁধে লিসাকে নিয়ে সোজা দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কালো মতন একটা লোক একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে প্যান্ট আয়রন করছে। টেবিলটার এক কোনায় ড্রাই করে রাখা কাপড়চোপড়। দুপাশে কাচের আলমারিতে ভাঁজ করা কাপড়চোপড় রাখা।
মনিমুল হক এসে দাঁড়ালেন। লন্ড্রির লোকটা একমনে আয়রন করতে থাকে।
মনিমুল হক বললেন, ‘এইখানে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল। সেটা গেল কোথায়?’
জিজ্ঞেস করার সময় মনিমুল হক লক্ষ করলেন, তাঁর গলা কাঁপছে।
লোকটা আয়রন থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল তাঁর দিকে।
‘মানে?’
‘এখানে গতকাল একটা খাবারের দোকান ছিল। আমি নিজে সমুচা–চপ খেয়েছি।’
‘খাইতে চাইলে দোকান তো আছে। দেখেন না।’
‘সেই দোকানটা কোথায়? মামুনস ইটারি। এইখানে ছিল। আপনার এই লন্ড্রিটার জায়গায়।’
লোকটা এবার আয়রনের টেবিল ছেড়ে সামনে এগিয়ে এল।
‘আপনে কী বলতেছেন, বুঝতে পারতেছি না।’
‘আপনার এই লন্ড্রি কত দিনের?’
‘সাত বছর।’
‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।’
লোকটা বিরক্ত হলো। বলল, ‘আপনে কাপড় আয়রন করতে দিবেন?’
লিসা বাবার হাত ধরে টান দেয়।
‘বাবা, চলো, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ফেরার পথে আবার লন্ড্রির দোকানটার উল্টো দিকে এসে দাঁড়ান মনিমুল হক। চোখে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। দোকানদার আয়রন করতে করতে দুবার আড়চোখে তাকায় তাঁর দিকে। কিছু না বলে আয়রন করতে থাকে।
পরদিন সেখানে লন্ড্রির বদলে একটা স্টেশনারির দোকান দেখলে মনিমুল হক ঠিক করেন, তিনি আর উত্তেজিত হবেন না। ঠান্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন বলে ঠিক করেন তিনি। ভেবে দেখবেন এবং খোঁজখবর করবেন।
তিনি প্রথমে পাশের ওষুধের দোকানটার কাছে যান। মানুষজন ভিড় করে ওষুধ কিনছে। তিনিও এক পাতা প্যারাসিটামল কেনেন। তারপর মাঝবয়সী দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পাশের এই স্টেশনারির দোকানটা কত দিনের, ভাই?’
ওষুধের দোকানদার ব্যস্তভাবে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে, ‘জানি না। অনেক দিন ধইরাই তো চলতেছে।’
পরদিন সেলুনের দোকানে তিনি শেভ করতে ঢোকেন। খামোখাই। বিহারি নাপিত ছেলেটার কাছে জানতে চান, ‘পাশের এই ফটোকপি-ফ্লেক্সিলোডের দোকানটা কত দিন ধরে চলছে, রে?’
মনিমুল হক এখন নিশ্চিত, কোথাও একটা বড় ধরনের গড়বড় হচ্ছে। দোকানটা প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে শুধু তাঁর আর লিসার কাছে। আর কারও কাছে বদলাচ্ছে না।
না, পুরোপুরি ঠিক না। সবার কাছেই বদলাচ্ছে। কিন্তু বদলের ব্যাপারটা অন্যদের কাছে ধরা পড়ছে না। কেননা, প্রতিবার বদলে যাওয়ার পর আগের দোকানটার কথা কেউ মনে রাখছে না। পরেরটাই শুধু মনে থাকছে। কিন্তু তা কী করে হয়? হওয়া সম্ভব নয়।
মনিমুল হক একটা কাজ করবেন, ঠিক করলেন। দোকানটা কখন বদলায়, তিনি সেটা দেখবেন। একেবারে বদলের মুহূর্তে তিনি ব্যাপারটা ধরে ফেলবেন।
কী করে সেটা সম্ভব?
অফিস থেকে ফেরার পথে রাত ৮টায় তিনি একবার দাঁড়ালেন দোকানটার সামনে, এখন যেটা একটা মিষ্টির দোকান, নাম ‘আয়শা সুইটস’। সাইনবোর্ডে তা–ই লেখা। সেখান থেকে এক কেজি ছানার মিষ্টি কিনলেন তিনি। প্যাকেটের গায়েও লেখা ‘আয়শা সুইটস’। বাসায় লোকজন অবাক হলো হঠাৎ মিষ্টি কেনা দেখে। লিসা অবশ্য বুঝল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই দোকানটা থেকে, বাবা?’
তিনি মাথা নাড়লেন।
রাত ১২টার আগে আগে তিনি আবার এসে দাঁড়ালেন মিষ্টির দোকানটার সামনে। সেটা এখন বন্ধ। আশপাশের সব দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে।
মনিমুল হক দোকানগুলোর সামনে পায়চারি করতে থাকলেন। চোখ রাখলেন মিষ্টির দোকানটার দিকে। মাঝরাতে এই হাঁটাহাটিঁ খুবই অস্বাভাবিক, তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার কিছু করার নেই।
সামনে রাস্তায় এখন একটার বদলে দুটো কুকুর শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে রিকশা আর মোটরগাড়ি যাচ্ছে। পাশের বিল্ডিংয়ের আনোয়ার সাহেব রিকশায় যাওয়ার সময় প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
‘মনিমুল হক, কী করেন?’
‘এই তো, হাঁটাহাঁটি করছি।’
রাত দুইটার পর রাস্তাঘাট সুনসান হয়ে গেল। কোনো জনমানুষ নেই। তরুণ বয়সী এক চৌকিদার এসে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, কোনো সমস্যা?’
মনিমুল হক কিছু বললেন না।
রাত তিনটার দিকেও আয়শা সুইটসের সাইনবোর্ডে কোনো বদল নেই। ভোর পাঁচটায়ও দোকানটা মিষ্টির দোকানই থাকল। মনিমুল হক বাসায় ফিরে এলেন।
পরদিন লিসাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে তিনি দেখেন, মিষ্টির দোকানটা নেই। সেখানে একটা ব্যাগের দোকান। নাম, ‘ব্যাকপ্যাকার্স প্যারাডাইস’।
ওই দিন ভোর সাড়ে চারটার সময় চৌকিদার এসে আবার বলল, ‘স্যার, রাইতের বেলা নানান কিসিমের লোকজন ঘোরে। আপনে বাসায় যান গা।’
পরদিন শুক্রবার। লিসার স্কুল নেই। মনিমুল হক তাই বাসায় গেলেন না।
সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সেটা একটা ব্যাগের দোকানই থাকল। বদলে গেল না। পাশের ওষুধের দোকান খুলল সকাল সাড়ে ১০টায়। তার পরপরই খুলল চুল কাটার সেলুন। ব্যাগের দোকানটা, ব্যাগের দোকান হিসেবেই খুলল বেলা ১১টায়।
মনিমুল হক লালচে চোখ নিয়ে বাসায় ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। মনে কেন যে এত আনন্দ লাগছে, তিনি বুঝতে পারছেন না। একটা কোনো গোপন, গভীর ষড়যন্ত্র যেন তিনি আটকে দিতে পেরেছেন।
বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠেই তিনি নিচে নেমে গেলেন।
‘ব্যাকপ্যাকার্স প্যারাডাইস’ নেই। সেখানে একটা ঘড়ির দোকান।
মনিমুল হক হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো মানে হয় না। কিসের পেছনে তিনি ছুটছেন আসলে? কেন?
জগতের কোথাও, কোনো গোপন কোণে, যদি কোনো উদ্ভট ঘটনা ঘটতে থাকে, যদি তার কোনো মানে পাওয়া না যায়, তাতে বিচলিত হয়ে হওয়ার কী আছে? দুনিয়ার সবকিছুর কেন ব্যাখ্যা থাকতেই হবে!
দোকান বদলে যাওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয়তো কোথাও আছে। সেটা হাতের নাগালে এখন পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো কোনো দিনই পাওয়া যাবে না। যদি পাওয়া না যায়, ক্ষতি কী। জগতের একটা গোপন ষড়যন্ত্র শুধু তাঁর আর লিসার চোখে ধরা দিচ্ছে। তিনি আর লিসাই শুধু বিস্মিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
মনিমুল হকের ছটফট, অস্বস্তি এখন কেটে গেছে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে এখন তিনি লিসাকে নিয়ে দোকানটার সামনে দাঁড়ান। তাঁদের দুজনার মুখে একটা মুচকি হাসি লেগে থাকে। আর প্রতিবারই সেখান থেকে কিছু না কিছু কেনেন তাঁরা। দরকার না হলেও কেনেন। কোনো দিন এনার্জি বাল্ব, কোনো দিন একটা নোটবই বা পেনসিল, কোনো দিন এক জোড়া লাল রঙের জুতা নিয়ে তাঁরা বাসায় ফেরেন। একদিন ফিরলেন একটা কোলবালিশ নিয়ে। লিসার মা অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
লিসাদের বাসা এখন নানান অদরকারি জিনিসপত্রে ভরে যাচ্ছে।
একটা দোকান মনিমুল হকের জীবনটা পাল্টে দিয়েছে।
নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় তাঁর। যুক্তির চাদর দিয়ে ঢাকা এই জগতের ভেতরে কী করে যেন একটা ছোট্ট ছিদ্রপথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। সেটার মধ্য দিয়ে তাঁর সামনে উঁকি দিচ্ছে যুক্তিহীন রহস্যময় এক জগৎ। নাকি অনেকগুলো জগৎ?
জীবনটা আর কোনো দিনই একঘেয়ে হবে না তাঁর কাছে।