বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির নদী ধরা হয় কর্ণফুলী নদীকে। মূল কারণ হলো এর দুই পাশে সবুজ পাহাড়ের বিস্তার। আসামের লুসাই পাহাড় থেকে জন্ম নেওয়া কর্ণফুলী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে ঢুকে চট্টগ্রামের মাঝ দিয়ে এসে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এই নদীর পানির স্রোত এতই বেশি যে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুেকন্দ্র তৈরি হয়েছে এখানেই। কর্ণফুলীর মূল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় রাঙামাটি গেলে। প্রকৃতি যেন নিজের মতো করে সাজিয়েছে এই এলাকাকে, যত দূর চোখ যায়, পাহাড়ের সারি। তার মাঝ দিয়ে উপমহাদেশের বিস্ময় কাপ্তাই লেক, আর সেই লেকের শেষ মাথায় এক চিলতে ফিতের মতো কর্ণফুলী নদী। এই এক চিলতে নদীই জন্ম দিয়েছে বিস্ময়ের। সরু থেকে শুরু করে যতই নিচের দিকে গিয়েছে, ততই বিশাল রূপ ধারণ করেছে, নিজেকে তৈরি করেছে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর নদী হিসেবে।
সেই নদীতে নৌকা চালাতে কেমন লাগবে ভাবো তো! কেমন লাগবে প্রবল স্রোতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে স্রোতের বিপরীতে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছুটে যেতে? পায়ের নিচে স্বচ্ছ কর্ণফুলীর সবুজ মেঝে, আর মাথার ওপরে নীল-সাদা আকাশটাকে আড়াল করে দেওয়া সবুজ পাহাড়ের সারি এক ঝটকায় দূর করে দেবে মনের সব ক্লান্তি। তবে এই নৌকা কিন্তু প্রচলিত দেশি নৌকাগুলোর মতো নয়। দেখতে লম্বাটে, স্রোত কেটে দ্রুতগতিতে চলার মতো করে তৈরি করা এই নৌকাগুলোকে বলা হয় ‘কায়াক’। আর কায়াক চালানোকে বলা হয় কায়াকিং। দেশের বাইরে কায়াকিং খুব জনপ্রিয়। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে কোথাও কায়াকিং করা হতো না।
এ দেশের মানুষদের প্রথমবারের মতো কায়াকিং করার সুযোগ করে দিয়েছে ‘কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাব’। দুই বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার মো. আলামিন পাভেল ও ইউসুফ রানা মিলে তৈরি করেছেন এই ক্লাব। কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাবের মোট কায়াক সংখ্যা এখন আট। পাহাড়ি স্রোতের মাঝে কায়াকিং করা ব্যাপারটা শুনতে কঠিন মনে হলেও বিষয়টা আসলে অনেক সহজ। প্রতিটি কায়াকে সর্বোচ্চ দুজন করে বসতে পারেন। দুর্ঘটনা এড়াতে দুজনকেই পরিয়ে দেওয়া হয় লাইফ জ্যাকেট। যাঁরা কায়াকিং করবেন, তাঁদের দুজনকেই বইঠা দেওয়া হয়। বিশেষভাবে তৈরি এই বৈঠার দুই পাশ দিয়েই পানি কেটে কায়াক চালানো যায়। একসঙ্গে দুজনেই চালাতে পারেন কায়াক।
তোমরা যারা পড়াশোনা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছ, কিংবা বেড়ানোর কথা উঠলেই সব সময় কক্সবাজার, বান্দরবান, সেন্ট মার্টিন দৌড়ে বেড়াও, তারা একবারের জন্য এসব প্রচলিত জায়গা বাদ দিয়ে চলে যাও কাপ্তাইয়ে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোড দেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই পাশে পাহাড় আর তার মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা অসাধারণ রাস্তা টুপ করে হারিয়ে যাবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে, তখন এক পাশে কর্ণফুলী আর অন্য পাশে পাহাড়ের সারি, এ এক অন্য রকম আনন্দ। ওপর থেকে কর্ণফুলী দেখতে যত না সুন্দর, তার চেয়েও বেশি শিহরণ জাগানো এর পানি পায়ে লাগানো। কর্ণফুলীর মেঝে সবুজ ঘাসে মোড়ানো, ফলে পানি অসম্ভব রকমের স্বচ্ছ। যে জীবনে কোনো দিন নৌকা চালানো শেখেনি, সে অনায়াসেই ঘুরে বেড়াতে পারবে এই নদীতে।
কায়াকিংয়ের শুরুটা একটু ঘাম ঝরানো, কারণ স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। তবে কায়াকিং ক্লাবের ভাইয়ারাই ঠিক করে দেয় কোন জায়গা দিয়ে চালাতে হবে। যে পাশে স্রোত বেশি সেদিকে যেতে নিষেধ করে দেয় তারাই। তোমার কাজ শুধু এক বন্ধুকে নিয়ে নদীতে নেমে পড়া।
পরের সময়টুকু একান্তই তোমাদের, চারপাশে কোনো শব্দ নেই, কোনো কোলাহল নেই। পানির একটানা কলকল শব্দ আর পাখির ডাকের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারবে ইচ্ছামতো। নিজের মতো করে পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার এমন মুহূর্ত তো আর রোজ রোজ আসে না। ডান পাশ দিয়ে মাঝেমধ্যেই কিছু ইঞ্জিনচালিত ট্রলার বা নানা রঙে সাজানো বোট চলে যায়, সেগুলোর ঢেউও এসে লাগে কায়াকের গায়ে, শুরু হয় রোমাঞ্চকর এক দুলুনি। একের পর এক শান্ত ঢেউ কেটে স্রোত ঠেলে দুই বন্ধু মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মজাই আলাদা। চাইলে মা-বাবাকে নিয়েও চড়তে পারো, যেহেতু লাইফ জ্যাকেট গায়ে থাকে, ফলে ডুবে যাওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। চলতে চলতে বাঁ পাশে অনেক ওপরে দেখতে পাবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে অনেক মানুষ, সবাই লোভাতুর চোখে দেখছে তোমার কায়াক চালানো, তার মাঝে বীরবিক্রমে তুমি এগিয়ে যাচ্ছ ঠান্ডা-শীতল-লাবণ্যময়ী কর্ণফুলীর বুক চিরে। চাইলে বাবা-মাকেও উপহার দিতে পারো এমন অসাধারণ এক রাইড। হয়তো তাঁরা কোনো দিন এমন করে নৌকা চালানইনি। তবে কায়াকিংয়ের জন্য অবশ্য জনপ্রতি ১৫০ টাকা দিতে হবে।
চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই খুব কাছে বলেই চট্টগ্রামের বন্ধুরা টুপ করে গিয়ে এক-দুই ঘণ্টা কায়াকিং করে ফিরে আসে শহরে, কিন্তু তোমরা যারা ঢাকা বা অন্যান্য জেলা থেকে যাবে, তাদের জন্য একটু দূরে হয়ে যাবে। তবু নিজের জন্য একটু সময় তো বের করাই যায়। একটু আগে থেকে কায়াকিং ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাখলে তারা তোমাদের জন্য কায়াক বুকিং দিয়ে রাখবে, বন্ধের দিনগুলোতে পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে বলে আগে থেকে না জানিয়ে রাখলে হঠাত্ করে কায়াক না-ও পাওয়া যেতে পারে।
ওহ্, আরেকটা মজার কথা। স্রোত ঠেলে তো চলে গেলে, ফিরে আসার সময় কী হবে! তখন আরও মজা। যেহেতু এখন স্রোতের অনুকূলেই ফিরতে হবে, কাজেই আর বাইতে হবে না বইঠা। স্রেফ আরাম করে রাজার হালে পায়ের ওপর পা তুলে পাহাড়ি নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আর আলতো ঢেউয়ে দোল খেতে খেতেই চলে আসবে ফিরতি পথে, স্রোত নিজেই তোমাকে কোলে করে এনে পৌঁছে দেবে রেখে যাওয়া ঘাটে।
তো হয়ে যাক এবার কর্ণফুলী ভ্রমণ, এত দিন তো চললে অন্যের চালানো নৌকায়, এবার নাহয় নিজেই হয়ে যাও এক দিনের মাঝি। কায়াক নিয়ে হয়ে যাও স্বাধীন, ঠিক যে কোনায় যেতে ইচ্ছে করে, বইঠা চালিয়ে নিজেকে নিয়ে যাও সেখানেই। মনে রাখবে, নৌকায় সবাই চড়তে পারে ঠিকই, কিন্তু নৌকা সবাই চালাতে পারে না।
>যেভাবে যাবে
ঢাকা থেকে কাপ্তাইয়ের বাস ছাড়ে। যেকোনো একটাতে উঠে বলবে জুম রেস্তোরাঁর পাশে কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাবে নামিয়ে দিতে। সেখান থেকে ডান পাশে অনেক লম্বা এক সিঁড়ি নেমে গেছে কর্ণফুলী নদীতে, সেখান থেকে কায়াকিং করা যাবে। এ জন্য একেকজনের ঘণ্টাপ্রতি লাগবে ১৫০ টাকা করে। যতক্ষণ ইচ্ছা কায়াকিং করে ফেরার আগে কাপ্তাই লেক ঘুরে আসতে পারো।
আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারো এই নম্বরে: ০১৭৫৩২২২২৮৬ (মি. ইউসুফ রানা)।