ইন্টারনেটের এ যুগে খুব সহজেই তথ্য খোঁজা বা প্রাপ্তির বিষয়টি অনেক সহজ। আর তথ্য খোঁজার পর যে কাজটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে সে তথ্যটি পাওয়া। তথ্যপ্রাপ্তির এ সুবিধাটি সহজ করে দিয়েছে উন্মুক্ত বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া’। ২০০১ সালে জিমি ওয়েলস শুরু করেন উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া তৈরির কাজটি। এই বিশ্বকোষের লেখক হয়েছেন তাঁরা, যাঁরা তা হতে চান। মানে ইচ্ছে থাকলেই উইকিপিডিয়ায় কাজ করা যায়, আবার তথ্য যুক্ত করার মতো কাজটি করা যায়। শুধুই কি তথ্য? চাইলে ছবি, তথ্যসূত্রও যোগ করার সুযোগও রয়েছে।
উইকি নামের একটি সফটওয়্যার, যা দিয়ে ওয়েবসাইটে সম্পাদনা, মোছা কিংবা পরিবর্ধন করা যায়, সেটি ব্যবহার করে জিমি ওয়েলস শুরুটা করেছিলেন। ধীরে ধীরে যা বর্তমানে বিশাল এক জ্ঞানভান্ডার। বর্তমানে এই গ্রহের সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া, যা প্রতিমুহূর্তে বিকশিত হচ্ছে। উইকিপিডিয়া যেহেতু বিশ্বকোষ, তাই এখানে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। যেকোনো বিষয়ের ওপর তথ্য খুঁজে দেখো, নিঃসন্দেহে তা পেয়ে যাবে। হাওয়াই দ্বীপে বিমানবন্দর থেকে ‘উইকি উইকি’ নামের বাস সার্ভিস রয়েছে। হাওয়াইয়ান ভাষায় উইকি মানে হলো দ্রুত (কুইক)। আর এই উইকি উইকি থেকে নেওয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া নামটি। পুরো ব্যবস্থাটির পরিচালনা করে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক সংস্থা। বিশ্বের ২৯৯টি ভাষায় বর্তমানে উইকিপিডিয়া রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিবন্ধ রয়েছে ইংরেজি উইকিপিডিয়ায়। সংখ্যা ৫৯ লাখ। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধের তালিকায় কিউবুয়ানো ভাষায় ৫৩ লাখ ও সুইডিশ ভাষার উইকিপিডিয়ায় ৩৭ লাখের বেশি নিবন্ধ আছে! এই ২৯৯টি ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষাও আছে। উইকিপিডিয়ার লেখক-সম্পাদকেরা নিজেদের উইকিপিডিয়ান হিসেবে পরিচয় দেন।
যেভাবে লেখা হয় উইকিপিডিয়ায়
যেহেতু বিশ্বকোষ, তাই উইকিপিডিয়ায় নানাজনের সমন্বয়ে তৈরি হয় নিবন্ধ। এমন নয় যে প্রতিটি নিবন্ধই একজনই সমৃদ্ধ করেন। কেউ হয়তো শুরু করলেন, সেটিকেই আবার তথ্য যোগ করে বা ছবি যোগ করে সমৃদ্ধ করে তোলেন অন্য একজন। তবে যেহেতু যে কেউ সম্পাদনা করতে পারেন, তাই অনেকেই মনে করেন যে কেউ লেখেন বলে উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো কোনো কাজের হয় না! তা ছাড়া অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই এখানে ভুল ও বিকৃত তথ্যও যোগ করতে পারেন। এমন ধারণা শুরু থেকেই ছিল। তবে যেভাবে ঠিক ভাবা হয়েছিল, সেভাবে বিষয়টি গড়ে ওঠেনি। নিবন্ধ তৈরির পাশাপাশি ব্যবহারকারীরাই এটিকে রক্ষা করার কাজটিও করে থাকেন। অর্থাৎ, কেউ চাইলেই কোনো নিবন্ধ যেমন মুছে ফেলতে পারবেন না, তেমনি ক্রমাগত ভুল তথ্য যোগ করার কাজটিও করতে পারবেন না। এটিরও একটি নিয়ম রয়েছে। যদি কোনো নিবন্ধে কেউ বারবার ভুল তথ্য যোগ করার চেষ্টা করেন বা মুছে ফেলার চেষ্টা করেন, তখন সে নিবন্ধটি ‘নজরে’ রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে সে নিবন্ধটিতে কোনো পরিবর্তন হলে তিনি সেটা জানতে পারেন। এভাবে যাঁরা খুব চেষ্টা করেন, তাঁরাও তাঁদের ভুল তথ্য শেষ পর্যন্ত থাকে না নিবন্ধে। বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে ১ দশমিক ৭ মিনিটের মধ্যে উইকিপিডিয়ায় যোগ করা আপত্তিকর তথ্য মুছে যায়।
উইকিপিডিয়ায় সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি বা চেইন অব কমান্ডের পরিবর্তে গ্রহণ করা হয়েছে ‘উন্মুক্ত সোর্সকোড’ দর্শনকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জিনিস একবারেই তৈরি হয়ে সেটি নির্দিষ্ট হয়ে যাবে তেমনটি নয়। উইকিপিডিয়া পরিচালিত হয় উন্মুক্ত সফটওয়্যার ‘মিডিয়া উইকি’ দিয়ে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদনা, পরিবর্ধন, বর্জনের কারণে উইকিপিডিয়া সতত চলমান, সদা পরিবর্তনশীল এবং বিনা মূল্যের বিশ্বকোষ।
বাংলা উইকিপিডিয়া
২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা উইকিপিডিয়া যাত্রা শুরু করে। সেই সময়ে উইকিপিডিয়ার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আকর্ষণ তেমন ছিল না। অল্প কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন আগ্রহী ইংরেজি উইকিপিডিয়া ব্যবহার করতেন। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় অবদান রাখতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাও ছিল। বাংলা উইকিপিডিয়ার অন্যতম একজন অগ্রণী রাগিব হাসান। তাঁর আন্তরিক উদ্যোগের ফলেই শুরু হয় বাংলা উইকিপিডিয়া। তবে যাত্রা শুরুর পরে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি বাংলা উইকিপিডিয়া। এর একটি কারণ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে ইন্টারনেট ততটা সহজলভ্য ছিল না তখন। তবে এর সমাধানের নানা পথও ছিল। সহজ হলো, দেশে ওপেন সোর্স এবং স্বেচ্ছাশ্রমের দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যাঁর একটি ডিজিটাল ক্যামেরা রয়েছে, দেশের নানা পুরাকীর্তি, ব্যক্তিত্ব কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক কিছু ছবি তুলে তার স্বত্ব ত্যাগ করে ইন্টারনেটে উইকিমিডিয়া কমন্সে জমা দেওয়া। যাঁর একটি ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার বা মুঠোফোন আছে, তিনি চাইলেই একটি ভুক্তিকে সম্পূর্ণ করতে পারেন। আর নতুন ভুক্তি তৈরি করার কাজটিও বেশ সহজ। নিবন্ধের সম্পূর্ণটুকুই যে একজনকে লিখতে হবে এমন নয়, কাজ শুরু করার পর অন্য অনেকেই সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন।
২০০৬ সালে বাংলা ব্লগিং জগৎ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং অনেক মানুষ বাংলা কম্পিউটিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। সে সময়টিতে বাংলা উইকিপিডিয়ায় মাত্র ৫০০টি নিবন্ধ ছিল। সে বছরেই বাংলা উইকিপিডিয়াকে জনপ্রিয় করে তুলতে সারা দেশে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন)। শুধু বাংলা উইকিপিডিয়াকে জনপ্রিয় করে তুলতেই গড়ে তোলা হয় ‘বিডিওএসএন উইকি দল’। ছিল একটি বাংলা উইকি মেইলিং লিস্ট। শুরুর দিকের সে উদ্যোগগুলোর ফলে দেশ ও বিদেশের অনেক বাংলাভাষী এই গতিশীল প্রকল্পে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেন। এর ফলাফলও চলে আসে। খুব দ্রুততম সময়ে বাংলা উইকিপিডিয়া ১০ হাজার নিবন্ধের মাইলফলক স্পর্শ করে।
এখন বাংলা উইকিপিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৭৮ হাজারেরও বেশি নিবন্ধ রয়েছে। এখন সারা দেশ থেকে অনেকেই নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করে এবং সক্রিয় উইকিপিডিয়ানদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন।
২০০৯ ও ২০১০ সালের সময়কালে, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের বাংলাভাষীরা বাংলা উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখা শুরু করেন। একই সময় উইকিপিডিয়া পরিচালনাকারী সংস্থা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন তাদের অপারেশন শুরু করে এবং বাংলায় শিক্ষামূলক বিষয় প্রচার করতে ২০১১ সালের অক্টোবরে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে একটি স্থানীয় অধ্যায় অনুমোদন করে, যার নাম ‘উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ’।
এখন বাংলা উইকিপিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৭৮ হাজারেরও বেশি নিবন্ধ রয়েছে। এখন সারা দেশ থেকে অনেকেই নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করে এবং সক্রিয় উইকিপিডিয়ানদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উইকিপিডিয়ার সহপ্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস বাংলা উইকিপিডিয়ার দশম বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসেন। তিনি জানান, নিবন্ধের গভীরতা অনুসারে, বাংলা উইকিপিডিয়ার গভীরতা বেশ ভালো। উন্মুক্ত এ তথ্যভান্ডারে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের তথ্য যোগ করে যাচ্ছে উইকিপিডিয়া স্বেচ্ছাসেবকেরা। লক্ষ্য একটাই, বিনা মূল্যের এ উন্মুক্ত তথ্যভান্ডারকে সবার জন্য আরও সহজ করা এবং সব ধরনের তথ্য বাংলায় সবার কাছে তুলে ধরা। উইকিপিডিয়া একটি মুক্ত বিশ্বকোষ। এর মানে হলো, যে কেউ ইচ্ছে করলেই এই বিশ্বকোষে তথ্য যোগ করতে পারে। একটি কম্পিউটার বা মুঠোফোন, ইন্টারনেট সংযোগ আর সদিচ্ছা। ব্যস, তুমিও হয়ে যেতে পারো একজন বিশ্বকোষ সম্পাদক!