উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের নিউ টেনের ক্লাসে কিছু ছেলেমেয়েকে গ্রুপ বেঁধে গল্প করতে দেখা যায়। দেয়ালে ঝুলতে থাকা নতুন ক্যালেন্ডার থেকে আসা প্রেসের টাটকা ঘ্রাণ এখনো ক্লাসের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাইন থেকে টেনে ওঠা এই ছেলেমেয়েগুলোও যেন আগের থেকে একটু পরিপক্ব, কেউ কেউ তো ছেলে/মেয়ে বললেই নাক সিঁটকাবে। এদের বলতে হবে কিশোর-কিশোরী। এই বয়সের একটা ভার আছে না!
টুপুর ওর মাথাটা দুপাশে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘এই বছরের পড়া কিন্তু আরও কঠিন। আর একটা মাত্র বছর আমাদের হাতে। রুটিন ঠিক করে না পড়লে এসএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হবে, আর এসএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হলে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারব না, আর ভালো কলেজে না টিকলে…’
রাইসা টুপুরকে নকল করে বলতে থাকে, ‘ভালো কলেজে না টিকলে এইচএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হবে, আর তখন ভালো ভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ হবে না, আর …’
অর্ক ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। ‘আহ! ইফতিটা কই? এইবার কই গেছে ও ছুটি কাটাতে, জানিস তোরা?’
টুপুর ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকায়। ‘দ্যাখ! এই তার আসার সময় হলো। তা ইফতি বাবাজি, সোজা কি এয়ারপোর্ট থেকে এলি যে এত দেরি হলো?’
ইফতি কাঁধের ভারী ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখেই হাঁপাতে লাগল। তিন তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে, হয়রান লাগছে খুব। পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে আধা লিটার পানি খেয়ে তাকাতেই দেখল, তিন জোড়া জিজ্ঞাসু চোখ ওর দিকে ফেরানো।
‘আরে, কেমন আছিস তোরা? কেমন গেল তোদের ছুটি? আমি তো আগ্নেয়গিরি দেখে এলাম…’
টুপুর, রাইসা আর অর্ক কিছুটা সময় নিল ইফতির কথার মাজেজা বুঝতে।
‘আগ্নেয়গিরি!’ তিনজন সমস্বরে প্রশ্ন করে।
‘হ্যাঁ, তোরা তো জানিসই আব্বা-আম্মা প্রতিবছর ফাইনাল শেষে আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হন। এই বছর আম্মাই বললেন যে সাগর-পাহাড় তো অনেক হলো, এবার আগ্নেয়গিরি দেখতে গেলে কেমন হয়?’
‘কিন্তু আগ্নেয়গিরি তো এক রকমের পাহাড়ই, নামের শেষেই তো আছে “গিরি”!’ টুপুরের জিজ্ঞাসু চোখ এখনো ইফতির দিকে।
‘আর বলিস না, পাহাড়ে ওঠা লাগবে জানলে আমি কখনোই রাজি হতাম না! গিয়ে তো শুনি আমাদের এক লোকাল গাইডের সাহায্য নিয়ে উঠতে হবে চূড়ায়, আসা-যাওয়া মোটমাট ১৪ কিলোমিটার হাইকিং।’
আমাদের গাইড জানিয়েছিল যে ওখানে যে সালফার পাওয়া যায় সেটা কেজি কেজি ঝুড়িতে ভরে জ্বালামুখ থেকে সমতলে নিয়ে যান ওই এলাকার লোকেরা, বিনিময়ে কিছু মজুরি পান কিন্তু সেটা এই ঝুঁকির তুলনায় খুবই সামান্য।
অর্ক ইফতির ভুঁড়িতে একটা গুঁতো দিয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোকে আজকে অনেক ঝরঝরা লাগছে।’
ইফতি অর্কের কথাটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বলে, ‘কিন্তু ওঠার পর যা দেখলাম, আমার তো চক্ষু ছানাবড়া।’
রাইসা চশমাটাকে ঠিক করতে করতে বলে, ‘তুই কিন্তু এখনো আমাদের জায়গার নামই বলিসনি।’
‘ওহ, তাইতো… আমরা গিয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়াতে। সেখানে জাভা দ্বীপে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরি আছে, বুঝলি? আমরা উঠেছি ইজেন আগ্নেয়গিরিতে।’
‘মৃত না সুপ্ত?’ টুপুর থামিয়ে দেয় ইফতিকে।
‘কার কথা বলছিস?’
‘আরে, আগ্নেয়গিরিটা কোন ধরনের ছিল? জানিস তো, আগ্নেয়গিরি তিন রকমের হতে পারে।’
ইফতির চোখ চমক দিয়ে ওঠে, ‘আমি জানতাম টুপুর এই প্রশ্নটাই করবে। আমিও গাইডের কাছ থেকে শুনে নিয়েছি আগেভাগেই। ইজেন শতকরা ১০০ ভাগ খাঁটি জীবন্ত। আমরা তো জ্বালামুখ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। দপদপ করে নীল শিখা জ্বলছিল আমাদের এই এত্ত সামনে…’
‘নীল শিখা! তাপমাত্রা কত ছিল সেখানে?’
ইফতি মাথা চুলকাতে থাকে, ‘উম… সেটা কী করে বলি… আমি তো সঙ্গে থার্মোমিটার নিয়ে যাইনি।’
টুপুর এবার বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়, ‘তাপমাত্রা কম করে হলেও ২৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কাছাকাছি তো হবেই।’
অর্ক ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘তা তুইও কি গিয়েছিলি ইফতির পিছে পিছে?’
‘এটা জানার জন্য ওখানে যেতে হবে কেন? ইফতি তো বললই ও নীল শিখা দেখেছে। আমরা সাধারণত যে লাল বা কমলা শিখা দেখি তার তাপমাত্রা বড়জোর ২২০০ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছায়, নীল শিখা তখনই তৈরি হয় যখন সেখানের তাপমাত্রা ২৩০০ বা তার ওপর যায়।’
‘তা হতেই পারে। জানিস, আমরা তো দেখতে গিয়েছিলাম এক দিনের জন্য যত রকমের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া যায়, সব নিয়ে। মুখে গ্যাস মাস্ক পরা ছিল। আমাদের গাইড জানিয়েছিল যে ওখানে যে সালফার পাওয়া যায় সেটা কেজি কেজি ঝুড়িতে ভরে জ্বালামুখ থেকে সমতলে নিয়ে যান ওই এলাকার লোকেরা, বিনিময়ে কিছু মজুরি পান কিন্তু সেটা এই ঝুঁকির তুলনায় খুবই সামান্য।’
ইফতির গলা ভারী হয়ে আসে। অর্ক ওকে পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়।
রাইসা অনেকক্ষণ চুপ ছিল। এবার ও জানতে চায়, ‘তার মানে তুই সালফারের খনি দেখে এসেছিস? এবার তো তোকে সত্যি হিংসা হচ্ছে।’
‘তোর তো এখন ইয়াকুব স্যারের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেই আর কষ্ট হবে না। আমাকে একটু রসায়ন বুঝাস তো ভাই… এই অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন ব্যাপারটা আমার একদমই মাথায় ঢোকে না!’ অর্ক মাথা নাড়ায় এপাশ–ওপাশ।
টুপুর আবারও জেরা শুরু করে, ‘সালফারের খনি? তার মানে আশেপাশে কোনো হ্রদও ছিল, তাই না?’
ইফতির চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে যায়। ‘তুই সত্যি করে বল তো, তুই গিয়েছিলি কখনো ইজেনে?’
টুপুর হাত নাড়িয়ে ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে, ‘সালফারের খনিতে তো সালফার থাকবে, ঠিক না? আর সালফার বাতাস পেলেই কী করবে? দহন বিক্রিয়া করবে, মানে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে যাবে। তো, সালফার আর অক্সিজেন মিলে কী তৈরী হয়?’ প্রশ্নটা ছুড়ে মারে বাকিদের উদ্দেশে।
‘সালফার ডাই–অক্সাইড।’ রাইসা কিছুটা শঙ্কা থেকে উত্তর দেয়।
‘কিন্তু সালফার ডাই–অক্সাইড তো গ্যাস। গ্যাস তো আর হ্রদ বানাবে না।’ অর্কের ভ্রু কুঁচকে যায়।
‘আরে, বিক্রিয়া তো এখনো শেষ হয়নি। সালফার ডাই–অক্সাইড জলীয় বাষ্পের সঙ্গে আবারও বিক্রিয়ায় যাবে। এবারের প্রোডাক্ট কী, বল দেখি?’
অর্ক হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘বিক্রিয়া তুই করালি, প্রোডাক্টটাও তুই-ই বল!’
‘অ্যাসিড! সালফিউরাস অ্যাসিড আর সালফিউরিক অ্যাসিড।’
‘আর অ্যাসিড তো তরল। তার মানে হ্রদটা অ্যাসিডের!’ রাইসা যেন কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছে।
‘কী সাংঘাতিক!’ অর্ক চিন্তা করেই কেঁপে ওঠে।
‘এ জন্যই আমাদের গাইড আমাদের বলেছিল, হ্রদের পিসি অনেক কম, একেরও নিচে…’ ইফতিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয় টুপুর, ‘পিসি নারে বোকা! পিএইচ (pH)। কোনো কিছু অ্যাসিড না ক্ষার, সেটা মাপার জন্যই এই নির্দেশক। এর মান ০ (শূন্য) থেকে ১৪ পর্যন্ত হয়। আমরা যে পানি পান করি তার pH ৭, মানে অ্যাসিডিকও না আবার ক্ষারীয়ও না। ৭ থেকে যত নিচে, তত বেশি অ্যাসিডিক, আর ৭ থেকে যত ওপরে …’
‘তত ক্ষারীয়।’ টুপুরের কথা শেষ করে রাইসা।
‘যা-ই বলিস না কেন, আমার কিন্তু এই ইজেন দেখতে যেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। এসব তো সব সময় বইয়ে পড়ে এসেছি, নিজের চোখে দেখতে পারাটা কি দারুণ হবে, না?’
অর্ক দুই আঙুলে তুড়ি বাজায়।
‘আমাদের এসএসসির পর কিন্তু একটা লম্বা ছুটি আছে। চল না, যার যার বাসায় রাজি করিয়ে ঘুরে আসি ইজেনে?’ রাইসা প্রস্তাব দেয়।
‘তোরা যা, আমি আর ১৪ কিলোমিটার ওঠা-নামা করতে পারব না…’
ইফতির ভুঁড়িতে আরেকটা টোকা দেয় অর্ক, ‘ চল চল, এবার যতটা ঝরঝরে হয়ে ফিরেছিস পরেরবার এর দ্বিগুণ হবি।’
টুপুর আর রাইসা হাসি চেপে রাখে। ইফতি বলে, ‘অবশ্য আমার কারণেই তো আজকে তোরা এত কিছু জানতে পারলি। তোদের সঙ্গে শেয়ার না করা পর্যন্ত আমার তো ভাতই হজম হচ্ছিল না। একসঙ্গে দেখতে গেলে নিশ্চয় মজাটাও বেড়ে দ্বিগুণ হবে…’
ইফতির কথাটার সঙ্গে কেউ আর দ্বিমত করল না। বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার না করা পর্যন্ত আর আসল মজা কই!