২১ জুলাই ২০০৭
গভীর রাত। ঘুমাতে যাওয়ার আয়োজন করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলের এসএমএস টোন বেজে ওঠে। এত রাতে বিরক্ত করে কেবল ফোন কোম্পানিই। বিরক্তিভরে ফোনটা তুলে নিলাম। ফোন কোম্পানির নয়, এগারো ডিজিটের আননোন সংখ্যা। ক্যাপিটাল লেটারে লেখা: THANKS FOR BIRTHDAY WISHES.—Quazi Anwar Hossain
ঠিক দেখলাম তো? স্বয়ং কাজীদা আমাকে মেসেজ করেছেন! নম্বরটা নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত। তা না হলেও ক্ষতি নেই। কাজীদা স্বয়ং এসএমএস করেছেন দূর মফস্বলে ঘুপচি গলির এক মেসবাসী ‘লেখক হতে চাওয়া’ তরুণকে, যার কাছে কাজী আনোয়ার হোসেন স্বপ্নলোকের মানুষ, তাঁকে পড়া যায়, ভালোবাসা যায়, আপন ভাবা যায়, কিন্তু তাঁর কাছে যাওয়া যায় না, ছোঁয়া যায় না। আমজনতার কাছে ছবির মানুষেরা তো এমনই হন। আমার রক্তে তখন রোমাঞ্চের স্পন্দন, সেবা প্রকাশনীর কোনো দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি পড়ার সময় যেমনটা হয়। মাঝরাতে গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, তোমরা শোনো, স্বয়ং কাজীদা আমাকে এসএমএস করেছেন। চিৎকার দিলেই–বা লাভ কী, আমার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? দরকারই–বা কী! ভালো লাগা, শিহরণ, রোমাঞ্চ, স্বপ্নপূরণ, সব এক বিন্দুতে মিলে যায় যখন, সে রাতে আর ঘুম হওয়ার কথা নয়, পুরো জার্নিটা আগাগোড়া ভাবতে বসি। আন্দাজে ছোড়া একটা ঢিল এভাবে লেগে যাবে, দূর–কল্পনাতেও ভাবিনি।
পরদিন ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম সেই নম্বরে। ভারী, গম্ভীর কণ্ঠ! পরিচয় জানতে চাইলেন কাজীদা। কিন্তু ভয়ে-শিহরণে আমার ভেতরের কথাগুলো কণ্ঠনালিতে আটকে গেছে। শেষে কাঁপা গলায় বললাম, কাজীদা বলছেন?
‘জি, বলছি, আপনি?’
‘আমি রনি, আমি আপনাকে জন্মদিনে উইশ করেছিলাম, আপনি তার জবাব দিয়েছেন কাল রাতে।’
‘ওহ্, আপনি রনি। আবারও ধন্যবাদ।’
আমি আর কী বলব? একে তো রোমাঞ্চে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর তিনি অতি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর মূল্যবান সময় নষ্টা করাটাও শোভন হবে না। একটি-দুটি শব্দ উচ্চারণ করে সেদিন ফোন রেখে দিয়েছিলাম। জীবনের সফলতম দিন ছিল সেটা। কিন্তু কী উপায়ে তাঁকে উইশ করেছিলাম, তাঁর নম্বর তো আমার জানা ছিল না; সে আরেক ইতিহাস!
এপ্রিল ২০০১
ভ্যাপসা সকালে ঘাম ঝরে। আগুনঝরা দুপুরে গরমের ডঙ্কা বাজে। উষ্ণ বাতাসের হলকা চাবুক মারে শরীরে। দুই দণ্ড শান্তির জন্য ঘর ছাড়ি, মাঠপানে যাই। গাঁয়ের ঘাটে-মাঠে-পথে মন ভালো করার উপাদানের অভাব নেই। বনের পাপিয়ার ‘চোখ গেল’ চিৎকার, ঘুঘুর মন কেমন করা ডাক, নীলকণ্ঠ পাখির মস্তানি—গ্রীষ্মের ক্লান্তি ও অস্বস্তি সব দূর করে দেয় এক লহমায়। সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ, প্লেব্যাকের ঝংকার, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ভাঁট আর মটমটি ফুলের বুনো ঝাঁজালো গন্ধের সঙ্গে অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া জাগায় মনে, মগজে।
বিকেলে আমতলায় ক্রিকেট কিংবা দাঁড়িয়াবান্ধার জমাটি আসর। সন্ধ্যায় স্কুল মাঠে আড্ডা। দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রিকেটের মাঠ থেকে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, বলিউড-ঢালিউড, হলিউড—আমাদের আসরে এসবের তুবড়ি ছোটে। সাঁঝ-রাতে বিটিভি-ইটিভি। ক্লিশে নাটক। ফালতু বাংলা সিনেমা। মাঝেমধ্যে বিদেশি সিরিয়ালের ডাবিং কিছুটা স্বস্তি দেয়। কিন্তু মনের খোরাক ষোলো আনা মেটে না। তবু ২০০১ সালের সেই গ্রীষ্ম জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হয়ে এখনো মানসপটে ঘাই মারে।
সেই গ্রীষ্মেই এসএসসি শেষ হয়েছিল। কিশোরজীবনের সবচেয়ে মুক্ত সময়। পড়াশোনা নেই, মায়ের বকুনি নেই, চাচার চোখ রাঙানি নেই কিংবা বাবার ভীতি–জাগানিয়া অস্তিত্বও তখন বশ মানাতে পারে না। তবু সন্তুষ্ট নই। ভেতরের পাঠকসত্তাটা পুরো মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। বই পড়ার সুযোগ নেই। কারণ, গাঁয়ের গৃহস্থবাড়িতে বই রাখার রেওয়াজ এখনো যেমন নেই, দুই দশক আগেও ছিল না। তবে আর সব বাবার চেয়ে আমার বাবা-চাচা কিছুটা ব্যতিক্রম। সামান্য কিছু লেখাপড়ার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই তাঁরা পত্রিকা পড়েন, দেশ-রাজনীতির উত্তপ্ত খবর রাখেন আর চায়ের দোকানে সমাজের পিন্ডি চটকান, দেশোদ্ধার করেন। বড়দের সেই পত্রিকা আমি ছোটবেলা থেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়ি। দৈনিক ও সাপ্তাহিক। খুন-রাজনীতি, ঢালিউড-হলিউড-বলিউডে ঠাসা পত্রিকাগুলোতে আর যা–ই থাকুক, শিশু বা কিশোর সাহিত্যের আল মাড়াত না কখনো। তাই ক্লাসের বাংলা বইয়ের বাইরেও যে শিশু-কিশোর সাহিত্যের বিশাল জগৎ বিছিয়ে আছে, সেটা পাঠ্যবইয়ে পড়লেও চোখের দেখা সম্ভব হয়নি। তাই কিশোর সাহিত্য, কিশোরদের জন্য অ্যাডভেঞ্চারের জগৎ—আমার পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। সেই গ্রীষ্মে পত্রিকাগুলো গোগ্রাসে গিলেছিলাম। সপ্তাহ না ঘুরতেই আমার পড়ার জন্য কিছুই বাকি রইল না।
হঠাৎ এক গুপ্তধনের কথা মনে পড়ল। পুরোনো কালের দালানে ছাদে ওঠা সিঁড়ির জন্য ছোট্ট একটা কামরা তৈরি করা হতো। শিশুরা যাতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দুর্ঘটনায় না পড়ে, সে জন্য। ছোট্ট বদ্ধ কামরা। সিঁড়ির নিচে একটা গুপ্তকক্ষের মতো জায়গা। রাজ্যের চামচিকা আর ইঁদুরের বাস। বোঁটকা গন্ধ। মাঝে মাঝে পোষা মুরগিতে ডিম পেড়ে তা দেয় সেখানে। ডিম আর ইঁদুরের লোভে মাঝে মাঝে জাত গোখরাও হানা দেয়। তাই বাড়ির সবচেয়ে রিস্কি জায়গা ওটা। ওর ভেতরে আবার রাজ্যের জঞ্জাল। পাথর, বাটখারা, হাতুড়ি, পুরোনো ঘটি-বাটি, তৈজস আর কয়েকটা বস্তা। বস্তাগুলোর কথা মনে হতেই শরীরে সুখের একটা শিহরণ বয়ে যায়। আরিব্বাহ, এটাই এখন দরকার! বাড়িতে যেসব ম্যাগাজিন জমা হয়, বাতিল কাগজ হিসেবে সেগুলো জমিয়ে রাখা হয় ওই বস্তার ভেতর। মুখ বন্ধ করে সেগুলো পড়ে আছে বছরের পর বছর। কে জানে আমি পড়িনি এমন পত্রিকাও হয়তো রয়ে গেছে তার ভেতর! পড়া হলেই–বা ক্ষতি কী, বছর কয়েক আগে পড়া কাহিনিগুলো নিশ্চয়ই এখন মনে নেই।
কাহিনি মানে খুনখারাবির গল্প বলছি না। হলিউড-ঢালিউড-বলিউডের মুখরোচক গল্প, ক্রিকেটের সাত-পাঁচ, একের পর এক শচীনের সেঞ্চুরি, কিংবা রফিকের ছক্কা অথবা বাংলাদেশের উপর্যুপরি ব্যর্থতার গল্প কিংবা নিঃসঙ্গ শেরপা সুমনের ফিফটি।
দুটি বস্তার মুখ খুলে বিছিয়ে ফেললাম। বেরিয়ে এল সাবেক সোভিয়েত এম্বাসির ফ্রি মাসিক ম্যাগাজিন উদয়ন। বড় আকর্ষণের নাম এটা। সে যুগে বিদেশি ছবি, বিদেশি ক্যালেন্ডার, উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া কিংবা বল্গা হরিণের স্লেজ—এসব দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হতো কেবল উদয়ন–এর মাধ্যমে। টিভি পেয়েছি একেবারে নব্বই দশকের শেষ ভাগে গিয়ে।
উদয়ন, চিত্রবাংলা, রোববার, সাপ্তাহিক ২০০০, ক্রীড়ালোক-এর ভিড়ে সম্পূর্ণ আনকোরা একটা জিনিস পেলাম। ছোট সাইজের একটা ম্যাগাজিন। রহস্য পত্রিকা—সেপ্টেম্বর ১৯৯৫। তখন কে জানত, জঞ্জাল ঘেঁটে পাওয়া ওই ম্যাগাজিনই ঠিক করে দেবে আমার জীবনের গতিপথ। আর এর সম্পাদক অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা একটা ভোলাভালা কিশোরের মনে বুনে দেবেন লেখক হওয়ার দুঃসাহসিক স্বপ্নের বীজটা।
২০০৭-৮ সাল
কাজীদার ফোন নম্বর পাওয়ার পর মাঝে মাঝে ফোন করি। বেশি কথা নয়, তাঁর সময়ের দাম আমি জানি। নিতান্তই ভালোমন্দ জানা। দুই মিনিটের বেশি নয়। মাসে গুনে একবার–দুবার ফোন করি তাঁকে। প্রথম দিকে আমার নম্বর চিনতে পারতেন না। কয়েক মাস পর দেখলাম, সত্যি তিনি আমার নম্বর দেখে চিনতে পারেন। পরিচয় জানতে চান না। নিশ্চিত হলাম, তিনি আমার নম্বর সেভ করে রেখেছেন। আরেকটু ভালো লাগা কাজ করল, কিছুটা হলেও তাঁর কাছে যেতে পেরেছি। এই কাছে যাওয়ার দরকার ছিল কি? ছিল, আমি যে লেখক হতে চাই!
এপ্রিল ২০০১
ছয় বছর আগের পত্রিকা। কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল কে জানে—বাবা অথবা ছোট চাচা। অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। একটা হাঙরের ছবি আর বড় করে লেখা সাগরের আতঙ্ক। সূচি দেখে চোখ চড়কগাছ। পত্রিকাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুমোট কক্ষ থেকে আলোতে—আক্ষরিক অর্থেই।
পরের দুটি দিন ডুবে রইলাম পত্রিকার নিউজপ্রিন্টের ভেতরে। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ নতুন করে আবিষ্কৃত হলো। এক দিনে এক লাফে পৃথিবীর আয়তনটা যেন লক্ষ–কোটি গুণ বড় হয়ে গেল। পাতায় পাতায় রুদ্ধশ্বাস, বিস্ময়কর সব গল্প! শিকারকাহিনি, ওয়েস্টার্ন কিংবা সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে সে–ই আমার প্রথম পরিচয়। সত্যি বলছি, সেই ১৬ বছর বয়সের আগে সাহিত্যের এই তিনটি শাখার নামও শুনিনি আমি। অজপাড়াগাঁয়ে বসে সেটা সম্ভব ছিল না। আবার মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এত বিচিত্র কাহিনি তৈরি হতে পারে, রহস্য পত্রিকা না পেলে হয়তো জানাই হতো না কোনো দিন।
আ ন হানিফের ‘মানুষখেকো এক চিতা’ নামের শিকারকাহিনির শিহরণ বহুদিন আমার ‘আমি’কে জাপটে ধরে ছিল, যত দিন না জিম করবেটের দেখা পাচ্ছি, কাজীদার সৌজন্যে। আরও কত কী! সব এখন মনে নেই। পত্রিকার শেষটাও উপাদেয়। পাঠকের বিচিত্র চিঠি, বিচিত্র প্রশ্ন, আবদার। আর সেগুলোর জবাব দিচ্ছেন স্বয়ং পত্রিকাটির সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেন।
কা আ হোসেন। কাজীদার সংক্ষিপ্ত নাম। মোটেও পরিচিত নাম নয়। বরং তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন, তাঁর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন কিংবা শ্যালিকা সাবিনা আর নিলুফার ইয়াসমিন অনেক বেশি পরিচিত। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কাজীদার সম্পর্কের কথা জানতে আমাকে আরও ছয়টা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
রহস্য পত্রিকার সেই সংখ্যা ছিল দুই রঙা, অর্থাৎ লেখার হেডলাইনগুলো লাল কিংবা অন্য কোনো রঙের, টেক্সট কালো। মাঝেমধে৵ বক্স আকারে এক কলামে বিজ্ঞাপন। বইয়ের। বিচিত্র সব বই। কুকুর খেকো ডাইনি, কঙ্কাল দ্বীপ, পাগল বৈজ্ঞানিক, তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানা। আহ্, ‘মাসুদ রানা’! নাম শুনেছি। বিখ্যাত স্পাই। কিন্তু কে তার কাহিনিকার, কেনই–বা বিখ্যাত, অতশত জানি না। আমার নানার মুখে গল্প শুনেছি মাসুদ রানার, যৌবনকালে পড়তেন। কিন্তু লেখক বা রানা—কারও সম্পর্কেই বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নি। এমনকি সেলিনা আজাদের ‘মনে রো রঙে রাঙাব/মনে রো ঘুম ভাঙাব’ গানটা গুনগুন করে গাই মাঝে মাঝে, সেটাই যে ‘মাসুদ রানা’র উদ্দেশে সোহানার লিপে গাওয়া, সে খবরই–বা জানার উপায় কী ছিল! ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্ল্যাসিক, গোয়েন্দা গল্প, শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টি কিংবা রেনে জুই অঁদের নাম সেই প্রথম জানলাম। অন্য রকম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে গেল কাজী আনোয়ার হোসেনের নামটা।
অ্যাডভেঞ্চার আর শিহরণের অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতির সঙ্গে বিশাল আফসোসও যোগ হলো, সেটা আগে পড়িনি কেন তার জন্য নয়, বরং ধরেই নিয়েছিলাম ছয় বছর আগের পত্রিকা, যা নাকি সেকালেই এগারো বছর পার করেছে, সেটা এখনো চালু আছে, এ কথা মানতে মনকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না। তাই আফসোসটা রয়েই গেল—আর কখনো পাব না এই পত্রিকার দেখা!
২০০৮ সাল
কাজীদার সঙ্গে কথা তখনো হয়। তবে দুই মিনিটের গণ্ডি তখনো পেরোইনি। এর মধ্যে হঠাৎ অসময়ে একদিন ফোন করে ফেললাম। কাজীদাকে বিচলিত মনে হলো। জানালেন, তাঁর ছোট ছেলে হাসপাতালে। তাঁর দুই ছেলে জানি—কাজী শাহনূর হোসেন ও কাজী মায়মূর হোসেন। কোনজন বড়, কে ছোট, জানি না। আমি জানতে চাইলাম, কে শাহনূর, আঙ্কেল?
নাহ্ মায়মূর।
কী হয়েছে ওনার?
স্ট্রোক!
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এখন সময় নষ্ট কিংবা বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
অক্টোবর ২০০২
আইএসসিতে ভর্তি হলাম পাশের গ্রামের কলেজে, অর্থাৎ শহর থেকে যে দূরত্ব, সেটা রয়েই গেল। তবু মাঝেমধে৵ যাওয়া পড়ে জীবননগর নামের চুয়াডাঙ্গা জেলার ছোট্ট শহরটাতে। নানাবাড়ি যাওয়ার পথে, স্টেশনারি দ্রব্য কিংবা ফটোকপির প্রয়োজনে। গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপ সদ্য শেষ হয়েছে। নানাবাড়িতে বসে অলিভার কানকে কাঁদিয়ে ব্রাজিলের উল্লাস দেখে ফিরলাম। ফেরার পথে জীবননগরে গাড়ি পাল্টাতে হয়। যাত্রীছাউনিতে অপেক্ষা না করে পেছনের পত্রিকার দোকানটাতে গেলাম প্রথমবার। দোকানে থরে থরে পত্রিকা সাজানো, ছাউনি থেকে ক্লিপে আঁটা কিছু ম্যাগাজিন ঝুলছে। চোখ গেল সেদিকে। বিস্ময়, শিহরণ, ভালো লাগা! ঝাড়া দুই মিনিটের বিস্ময় কাটিয়ে হাতে উঠে এল ছোট্ট ছিমছাম পত্রিকাটি। রহস্য পত্রিকা—অক্টোবর ২০০২। একই বিস্ময়, একই আবেগে কাটল পরের দুটি দিন। কাজী আনোয়ার হোসেন, রহস্য পত্রিকা, মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, অনুবাদ—মিলেমিশে একাকার। যে রহস্য পত্রিকা আর কখনো পাব না ভেবেছিলাম, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে নিশ্চিত ছিলাম, এখনো সেটা বহাল তবিয়তে আছে আর কাজীদাও সমান দক্ষতায় সেটা সম্পাদনা করছেন, এর চেয়ে সুখের ভাবনা আর কী হতে পারে! ধরেই নিলাম কাজীদা এখনো যথেষ্ট তরুণ! শুরু হলো ২৪/৪ সেগুনবাগিচার পথে আমার স্বপ্নযাত্রা।
সাত বছর আগের পত্রিকার চেয়ে এটা কোনো অংশে কম ছিল না। তবে এটার শেষ পৃষ্ঠায় আমার জন্য ছিল বিশেষ কিছু। তখন কেবল বর্ষপূর্তি সংখ্যাতেই রহস্য পত্রিকায় লেখার নিয়ম থাকত। সেটাতেও ছিল, রহস্য পত্রিকাসহ সেবা প্রকাশনীর যেকোনো বই কীভাবে ডাকযোগে নেওয়া যাবে, সেটার নিয়মকানুন দেওয়া ছিল। জানানো হয়েছিল, সেবার বিশাল বইয়ের যে ভান্ডার, তার জন্য একটা মূল্যতালিকা আছে। সেই তালিকা চিঠি লিখে ঠিকানা দিলেই ফ্রিতে পাওয়া যায়। আমাকে আর তখন পায় কে?
২০০৮ সাল
কাজী মায়মূর হোসেন যে কদিন হাসপাতালে ছিলেন, প্রতিদিন একবার ফোন করতাম। ভয় হতো, কাজীদা বিরক্ত হন কি না, হতেন না।
কয়েক সপ্তাহ পর কাজীদা জানান, তাঁর ছেলে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। স্বস্তির খবর। কিন্তু এ অবস্থা থেকে তিনি আবার নিশ্চিত করে লেখালেখিতে ফিরতে পারবেন কি না, বলা যায় না। অথচ সেবার গুরুত্বপূর্ণ লেখক তিনি। ভালো অনুবাদ করেন আবার রক বেনন নামে একটা ওয়েস্টার্ন সিরিজ লিখতেন তিনি। এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে?
নভেম্বর ২০০৭
গ্রামের ডাকঘরে গেলাম সেদিন। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার ছিল না। লিখবই–বা কার কাছে? ডাক বিভাগের নিয়মকানুন কিছুই জানি না। পোস্টম্যানের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললাম। একটা পোস্টকার্ড পাঠালাম রহস্য পত্রিকার সেলস ম্যানেজার বরাবর। মূল্যতালিকা চেয়ে। জানি, চিঠি পৌঁছাতে সাত দিন সময় লাগে। তার মানে ফিরতি চিঠি আসতে আসতে পেরিয়ে যাবে দুই সপ্তাহ।
দুদিন পর আবার গেলাম ডাকঘরে। এবার নতুন এক উদ্দেশ্য নিয়ে। চিঠিপত্র বিভাগে চিঠি পাঠানোর জন্য। ইনিয়ে-বিনিয়ে একটা চিঠি লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। মানি অর্ডার করলাম, রহস্য পত্রিকার ছয় মাসের গ্রাহক হওয়ার জন্য। মূল্যতালিকা চেয়ে একটা চিঠিও পাঠালাম। জানি, চিঠি পৌঁছাতে সাত দিন সময় লাগে। তার মানে ফিরতি চিঠি আসতে আসতে পেরিয়ে যাবে দুই সপ্তাহ।
রহস্য পত্রিকার পরের সংখ্যা যথাসময়ে ডাকযোগে আমার হাতে এল। খুলে দেখি, ‘খোলা চিঠি’ বিভাগে আমার নাম জ্বলজ্বল করছে। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সেই অনুভূতি বছর বিশেক পর যখন প্রথম সন্তানের বাবা হচ্ছি, সেদিনের মতোই ছিল।
সেদিনের সেই কাঁচা হাতের চিঠিটা এখনো যখন পত্রিকা খুলে পড়ি, লজ্জায় নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে—শব্দ, বাক্য গঠন এত দুর্বল ছিল!
মানুষ বড় লোভী প্রাণী। চিঠি ছাপা হওয়ার পর মনে হলো, চাইলে কি আমি লেখার চেষ্টা করতে পারি না? চেষ্টা করতে দোষ কী! অভিজ্ঞতাভিত্তিক লেখাগুলো তো পাঠকেরাই পাঠান। সীমান্তে বাড়ি আমাদের, বর্ডারে তখন নিয়মিত মানুষ হত্যা করছে বিএসএফ।
এ রকম একটা ঘটনা নিয়ে লিখে ফেললাম ‘সীমান্তে হত্যা’ নামে একটি কাহিনি। জানুয়ারি ২০০৩। আমার জীবনের প্রথম মাইলফলক। রহস্য পত্রিকার সেই সংখ্যাতেই ছাপা হলো আমার প্রথম লেখা। স্বপ্ন দেখার সেই শুরু। বন্ধুবান্ধব ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, নিদেনপক্ষে স্কুলশিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অথচ আমি তখনো জানি না কী হতে চাই। গ্রামের মেঠোপথে, ইছামতীর বাঁকে বাঁকে গাছের সঙ্গে পাখির সঙ্গে খেলে যে ছেলেটা, সে কীভাবে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখবে! রহস্য পত্রিকার কাঁধে ভর করে তাই প্রথমবার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করলাম। সে লক্ষ্যের পথে হেঁটে চলা এখনো শেষ হয়নি।
২০০৮-১০ সাল
মায়মূর হোসেনের অসুস্থতার মধ্য দিয়ে কাজীদার সঙ্গে যোগাযোগটা বেড়েছিল। তাই পরে অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম। তবে কাজীদার মূল্যবান সময়ের দিকে সজাগ দৃষ্টি থাকত সব সময়। এর মধ্যে কয়েকটা লেখা ছাপা হলো আমার রহস্য পত্রিকায়। অভিজ্ঞতাভিত্তিক কিছু লেখা, গল্প, ফিচার। ‘কদমচারা’ নামে একটা গল্প ছাপা হলো, যার জন্য পরে আমি ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম। ২০১০ সালে প্রকাশিত হলো ‘পাগলাত্মার প্রলাপ’ নামে একটা বড় গল্প। গল্পটা কাজীদা এবং তাঁর দুই ছেলে ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। কয়েক বছর পর যখন তাঁদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল, তখন এই গল্পের কথা প্রায়ই বলতেন তাঁরা। এই ছোট ছোট প্রশংসা অনেকখানি ভালোবাসা আমার লেখক হওয়ার সাধকে বাড়িয়ে দেয়।
২০০২-২০০৩ সাল
সেবা প্রকাশনীর মূল্যতালিকাটা যেন স্বর্ণখনি। কত বিচিত্র বই, বিচিত্র নামের সমাহার। ১৬ বছর বঞ্চিত এক কিশোরের কাছে বিশ্বসাহিত্যের দুয়ারটা যেন হাট করে খুলে গেল। অ্যাডভেঞ্চার, কিশোর ক্ল্যাসিক, তিন গোয়েন্দা, শিকারকাহিনি, ওয়েস্টার্ন, হরর, থ্রিলারের বিচিত্র পসরা সাজিয়ে বসে আছে সেবা প্রকাশনী! কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ি। তবে সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না বেশি। গৃহস্থ পরিবারে কিশোর সন্তানদের হাতে সাধারণত টাকা দেন না অভিভাবকেরা, যাতে উচ্ছন্নে চলে না যায়। তবু কিছু টাকা পাওয়া যায় নানা অজুহাতে—সেভ, বই, খাতা, কলম, টিফিন ইত্যাদির খরচের টাকা থেকে এক-দুই টাকা বাঁচিয়ে পঁচিশ–ত্রিশ টাকা হলেই মানি অর্ডার করি সেবা প্রকাশনীতে। হ্যাঁ, ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় তখন সেবার বই মিলত।
‘তিন গোয়েন্দা’ দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভলিউম ৩/১। হারানো তিমি, মুক্তো শিকারি, মৃত্যুখনি—কী সব নাম। পরপর অনেকগুলো বই নিলাম কয়েক মাসে—সিরগা, অরণ্যে অভিসার, নেকড়ে মানবী। তারপর কাজীদার অন্যতম সেরা অনুবাদ হাতে এল। জিম করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতা। শিকারকাহিনি কত রোমাঞ্চকর, শিকারি কত ধূর্ত হতে পারে, সেই প্রথম বুঝলাম। জিম করবেট আর কাজীদার অপূর্ব যুগলবন্দী। এর পরেই ‘মাসুদ রানা’র সঙ্গে পরিচয়। একেবারে প্রথম প্রথম ভলিউম—ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম, স্বর্ণমৃগ। স্পাই থ্রিলার পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। থ্রিলার বলতে কেবল ফেলুদার কয়েকটা বই আর সিরিজ। সেই সময় ‘মাসুদ রানা’র মতো অগ্রগামী স্পাই থ্রিলার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
২০০৪-৭ সাল
২০০৪ সালে গ্রাম ছেড়ে যশোরে চলে আসি। সুযোগ আসে অনেক অনেক পড়ার। যশোর ইনস্টিটিউট নামে একটা মস্ত পাবলিক লাইব্রেরি আছে যশোর টাউন হল ময়দানে। কয়েক লাখ বই। সেখানে যাই নিয়মিত। পত্রিকা পড়ি, বই পড়ি। কিন্তু সেবার বই সেখানে পাওয়া যায় না। পরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে সদস্য হয়ে বই নিতাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক কিংবা সত্যজিতের বই গিলছি গোগ্রাসে।
কিন্তু সেবার বই থাকে অন্য জায়গায়। রেলস্টেশনে, পত্রিকার দোকানগুলোতে। আরও মেলে হাসান বুক হাউসে। তবে সেবার বইয়ের গন্ধ সবচেয়ে বেশি মিশে আছে হাইকোর্ট মোড়ের সেই পত্রিকার দোকানটি—আনোয়ার আলম ব্রাদার্স। থরে থরে পত্রিকা ম্যাগাজিন সাজানো। আর পেছনের শেলফে সেবার বই। সারা দেশের, দুনিয়ার ম্যাগাজিন মেলে ওখানে। দেশ, আনন্দমেলা, কালি ও কলম আর রহস্য পত্রিকা কিনি ওখান থেকে। টিউশনি করি তখন। তাই বই কেনার টাকার অভাব হয় না। আনোয়ার আলম ব্রাদার্সে প্রতিদিন ঢুঁ মারি—সেবার নতুন কোনো বই এল কি না। বইয়ের খবর অবশ্য আগেই পেয়ে যাই। রহস্য পত্রিকার পাতায় পাতায় থাকে প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য বইয়ের বিজ্ঞাপন। পত্রিকার ফিচার বা গল্পের মতো সেসব বিজ্ঞাপনের প্রতিও বাড়তি আকর্ষণ ছিল।
আনোয়ার আলম ব্রাদার্সে নতুন বইয়ের হদিস জানতে চাই, কবে আসবে? দু–এক দিন দেরি হয়। তবু প্রতিদিন একবার খোঁজ নিই। দোকানের কর্ণধার খুরশীদ আনোয়ারের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়। আঙ্কেল সম্বোধন করি তাঁকে। তিনি সেবার বই বিক্রি করছেন ষাটের দশক থেকেই। সেবা সম্পর্কে, কাজীদা সম্পর্কে, সেবার লেখকদের সম্পর্কে অনেক গল্প করেন। আমার নিজের লেখা রহস্য পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা তাঁকে দেখাই। যশোরবাসের শেষ দিন পর্যন্ত আনোয়ার আলম ব্রাদার্সে আমার যাতায়াত ছিল। জানি না দোকানটা এখনো আছে কি না। খুরশীদ আনোয়ার আজও বেঁচে আছেন কি না?
১৯ জুলাই ২০০৭
সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ চড়কগাছ। তিনজন লেখককে তখন দেখার বড্ড ইচ্ছা। মফস্বলে বসে সে ইচ্ছে পূরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কাজী আনোয়ার হোসেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর আনিসুল হক। শেষ দুজনের বইয়ের সময়োপযোগী কলামের কারণে। নিজের লেখক হওয়ার সাধ, তাই বড় লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগটা তখন স্বপ্নের ব্যাপার। সেই স্বপ্নটা শুধু দেখেই যাই। কোনো দিন দেখা হবে, সেটা কল্পনা করাও আমার জন্য কঠিন। কিন্তু সেদিন সেই সুযোগ এসে গেল।
কাজীদার ছবিও কখনো দেখিনি। তিনি সাক্ষাৎকার দেন না, টিভিতে আসেন না, পত্রিকায় ছবিও ছাপা হয় না। কিন্তু সে দিনটা অন্য রকম ছিল। সকাল সকাল প্রথম আলোটা হাতে নিয়েই দেখি কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে একটা লেখা—আসজাদুল কিবরিয়া লিখেছেন উপসম্পাদকীয় পাতায়। সঙ্গে একটা সাদাকালো ছবি। সেই প্রথম কাজীদার ছবি দেখলাম। বহুদিনের অপূর্ণ সাধ পূর্ণ হলো। শামসুদ্দিন নওয়াব ও বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে তিনিই লিখতেন বিভিন্ন বই, সে কথাও জানা গেল। সেদিন ছিল কাজীদার ৭১তম জন্মবার্ষিকী। আসজাদুল কিবরিয়া প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, কিন্তু আমি কীভাবে জানাব? তখনই মাথায় খেলে যায় বুদ্ধিটা। যদি কাজে লাগে! কে জানে, হয়তো কাজীদার সঙ্গে যোগাযোগের পথটাও তৈরি হয়ে যাবে!
২০০৯-১১ সাল
নভেম্বর ২০০৯। অনেক দিন থেকেই একটা লক্ষ্য পুষে রেখেছিলাম মনে। ২০১০ সালের মধ্যেই নিজের একটা বই দেখতে চাই দুই মলাটে। ২০০৯ সালে একটা কিশোর কল্পবিজ্ঞান লেখা শুরু করলাম। কাজীদার পাশাপাশি মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর বিভূতিভূষণেও আচ্ছন্ন তখন। তাঁদের দুজনের মিশ্র অনুকরণে লেখা সেই সায়েন্স ফিকশন লেখা শেষ হলো ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে। কাজীদাকে জানালাম। তিনি জানান, সেবা থেকে মৌলিক কল্পবিজ্ঞানের বই আসলে সেভাবে প্রকাশ করা হয় না। আসলে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। প্রথম উপন্যাস, কাঁচা হাতের লেখা, সেটা যে সেবার মানের হবে না, কাজীদা নিশ্চিত ছিলেন। তাই আগেভাগেই একটু ঘুরিয়ে জানিয়ে দিলেন। তবে পাণ্ডুলিপিটা পাঠিয়ে দিতে বললেন। পাঠালাম। তিনি পড়লেন এবং একটা ফর্মা এডিট করে পাঠিয়ে দিলেন। সঙ্গে একটা ছোট্ট নোট। উপন্যাসের ত্রুটি-বিচ্যুতি কোথায়, কীভাবে লেখা উচিত, সেগুলো গুছিয়ে তিনি লিখে দিলেন। এখনো আমি মনে করি, ৩৭ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল সেই ছোট্ট নোটটা। বহুদিন সেটা আমার সঙ্গে ছিল, ঢাকায় আসার পর বারবার মেস বদলের কোনো এক ফাঁকে সেই মূল্যবান নোটটা হারিয়ে ফেলেছি।
২০১০ সালের নভেম্বরে ঢাকায় চলে আসি। কাজ শুরু করি অঙ্কুর প্রকাশনীতে। অঙ্কুরের অফিস পল্টনে, সেবার সেগুন বাগিচায়। হাঁটা দূরত্বে, তাই প্রায়ই সেবার অফিসে যাই। শাহনূর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়, শেখ মহিউদ্দীনসহ অন্যদের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু কাজীদার নাগাল পাই না। কারণ, সেবার মূল অফিসে তিনি বসেন না। কাজ করেন নিজের রিডিং রুমে বসেই। তা ছাড়া সাধারণত তিনি নিভৃতে কাজ করতে ভালোবাসেন। একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে দেখা করেন না। সাংবাদিক আর টেলিভিশন ক্যামেরার প্রতি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেবার ক্ষেত্রে সব সময় ভাগ্য আমার সহায় ছিল। কাজীদার ক্ষেত্রেও সেটিই হলো। একদিন সেবার অফিসে গিয়েছি। শাহনূর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসছিলাম। নিচে নামার পর কীভাবে যেন শুনতে পেলাম কাজীদা নামবেন, বাইরে যাবেন। এ সুযোগ হাতছাড়া করব কেন? বসে রইলাম রিসেপশনে। মিনিট পাঁচেক পরে কাজীদা নামলেন। শার্ট-প্যান্ট পরা লম্বা সুদর্শন মানুষ। সেদিন সত্যিকার অর্থেই যেন বুঝতে পারলাম ‘মাসুদ রানা’ দেখতে কেমন। নিজের প্রতিরূপ কাজীদা এঁকেছেন বিখ্যাত স্পাইয়ের শরীরে! এগিয়ে গেলাম, ভয়ে ভয়ে বললাম, কাজীদা, আমি রনি। ভেবেছিলাম, তিনি রাগ করবেন। বিনা অনুমতিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটা দুঃসাহস হয়ে গেল কি! তিনি রাগলেন না, বরং পরিচয় পেয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। কয়েকটা কথা বললাম। কী কথা হয়েছিল সেদিন কাজীদার সঙ্গে, উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে তখনই ভুলে গিয়েছিলাম।
১৯ জুলাই ২০০৭
প্রথম আলোয় আসজাদুল কিবরিয়ার লেখা পড়ার পর বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। রহস্য পত্রিকায় একটা মুঠোফোন নম্বর থাকে। একটা এসএমএস লিখে ফেললাম। দুই লাইনে নিজের অনুভূতি লিখে। এটা সেই আন্দাজে ঢিল। কাজীদা হয়তো এটা দেখবেন। হয়তো জবাবও দিতে পারেন। সেটা সেবার মোবাইল ফোন থেকে দেওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। আবার ভাবলাম, কতশত লোক আজ তাঁকে শুভেচ্ছা জানাবেন, জনে জনে জবাব দেওয়া কি তাঁর পক্ষে সম্ভব! ক্ষীণ একটা আশা নিয়েই এসএমএসটা করেছিলাম। আরেকটা দুরাশাও ছিল, সত্যি যদি কাজীদা নিজের নম্বর থেকে এসএমএসের জবাব দেন, তাহলে আমাকে আর পায় কে! জানি এটা দুরাশাই, সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সারা দিন চলে গেল। পরদিনও কাটল। কোনো জবাব নেই। তাই ভুলে গেলাম এসএমএসের আশা। কিন্তু ২০ তারিখ রাত পেরিয়ে ২১ তারিখ আসার ২ ঘণ্টা পর যখন কাজীদা পাল্টা এসএমএস পাঠান, তখন আমার চেয়ে সুখী আর সেই রাতে কেউ ছিল না।
২০১২–২২
কাজীদার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার বছর দুয়েক পর সেবা প্রকাশনী ও সম্পাদনা দলে জয়েন করি ছোট্ট একটা পদে। তবু সেটা আরাধ্য ছিল। এক বছর সেবায় কাজ করেছিলাম, কিন্তু একবারের জন্য কাজীদার সঙ্গে দেখা হয়নি। কারণটা আগেই বলেছি, কাজীদা কাজ করতেন নিজের রিডিং রুমে বসে। চারতলায়। আমাদের অফিস ছিল দোতলায়। তবু চাইলেই কাজীদার সঙ্গে দেখা করা যেত হয়তো। কিন্তু আমি যেতে চাইনি। কারণ, কাজীদার যে অবস্থান আমার মনে, সেটা যেন অক্ষুণ্ন থাকে। কর্মচারী হয়ে বস কাজীদার মুখোমুখি হতে চাইনি। কাজীদাও হয়তো কর্মচারী হিসেবে আমাকে দেখতে চাননি, তাই হয়তো কখনো ডেকে পাঠাননি—আসলেই জানি না ব্যাপারটা এমন কি না। যাঁদের আমি খুব বেশি শ্রদ্ধা করি, তাঁদের খুব কাছে যেতে চাইনি কখনো। সেটা জাফর ইকবাল স্যারের ক্ষেত্রেও হয়েছে। কয়েকবার শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু তাঁর খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। দোষে-গুণেই মানুষ। অনেক গুণের মাঝে দু–একটা দোষ যদি শ্রদ্ধার মানুষগুলো করেও ফেলেন, তা যেন আমার অগোচরেই ঘটে, এটা চেয়েছি সব সময়।
কাজীদা চলে গেলেন ১৯ জানুয়ারি। এর আগে বেশ কিছুদিন কাজীদার অসুস্থতার খবর পেয়েছি। তখন থেকেই মনটা ভার হয়েছিল। শেষ খবরটা পাওয়ার পর অবস্থাটা কী হয়েছিল, সে অনুভূতি ব্যক্ত করার নয়। কাজীদা ৬০ বছর ধরে বহু প্রজন্মকে বই পড়ানোর অভ্যাস করিয়েছেন, এ দেশে বইয়ের বাজার তৈরি করেছেন। তার চেয়ে বড় ব্যাপার, লেখক তৈরি। কতশত লেখক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি জন্ম দিয়েছেন, সে হিসাব কষা কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, এ যুগের ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠোপযোগী সহজ ও গতিশীল একটা ভাষা তৈরি করেছেন, যার জন্য বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছে ঋণী থাকবে আজীবন।
অজপাড়াগাঁয়ে জন্মানো, বুনো, বোকাসোকা একটা ছেলে হয়ে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখার যে স্পর্ধা আমি দেখাই এখন, আমার এই সত্তার জন্মদাতা কাজী আনোয়ার হোসেন। সময়ের নিয়মেই মানুষকে বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। কাজীদা পরিণত বয়সেই বিদায় নিলেন। তাই তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে আফসোস নেই, বরং ভালোবাসা আছে।
মহাকালের ওপার থেকে আপনার স্মৃতি, আপনার কীর্তি বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দেবে, সাহস জোগাবে চিরকাল। আই লাভ ইউ, কাজীদা।