বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য নানা পরিকল্পনা। অনেক ভেবে ঠিক করলাম, এবার বইপড়া আর খেলাধুলা ছাড়া এমন কিছু করব, যাতে আমি আনন্দে সময় কাটাতে পারি। পাশাপাশি কাউকে সাহায্যও করা যাবে।
ভাবনাটা মাকে জানালাম। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম এক প্রকল্পের কথা। প্রকল্পটি সাজিদা ফাউন্ডেশনের। নাম ‘আমরাও মানুষ’। তারা রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের নিরাপদ বিশ্রামের জায়গা দেয়। তাদের লেখাপড়াও শেখায়।
ভাবলাম, তাদের পড়ালেখা শেখাতে এই দেড় মাস ছুটির সময়ে আমিও তো কিছুটা সাহায্য করতে পারি। এর মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারব। এই ভেবেই এসব ছেলেমেয়ের সঙ্গে নতুন এক যাত্রা শুরু হলো আমার।
প্রথম দিন তাদের পড়ার ঘরে ঢুকে দেখি, বাংলা বই সামনে নিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে পড়ছে। ঘরে ঢুকতেই তারা আমাকে সমস্বরে সালাম দিল। খেয়াল করলাম, সবার বয়স ছয় থেকে দশ বছরের মধ্যে। তারা সরে গিয়ে আমার জন্য বসার জায়গা করে দিল।
প্রথমে তারা নিজেদের পরিচয় দিল। আমিও আমার নাম-পরিচয় বললাম। এরপর শুরু হলো পড়াশোনা। প্রথম দিনটিতে সবাই উত্সাহ নিয়ে আমার কাছে পড়া বুঝে নিল। এমনকি দিনের শেষে তাদের প্রায় সবার নতুন কিছু ইংরেজি শব্দও শেখা হয়ে গেল আমার।
দু-চার দিনের মধ্যেই তাদের সবার নাম মুখস্থ হয়ে গেল। মুখস্থ হয়ে গেল তাদের ব্যবহারও। চিনতে পারলাম রহিমাকে, যে সব সময় হাসিখুশি থাকে। পরিচয় হলো রবিন ও রুবেলের সঙ্গে, যারা এই মুহূর্তে ঝগড়া করে তো পরের মুহূর্তে আবার বন্ধু হয়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হলো ক্লাস টু আর থ্রির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। আমি প্রতিদিন তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতাম। একদিন তারা আমাকে তাদের সঙ্গে দুপুরে খেতে বলল। বেশ আনন্দ করে খেলাম। এতে তাদের সে কী উৎসাহ!
আস্তে আস্তে লক্ষ করলাম, তাদের সবার মধ্যেই নানা গুণ আছে। মর্জিনা পড়াশোনায় দারুণ, সুমাইয়া অসাধারণ ছবি আঁকে, আঁখি সুন্দর গলায় গান গায়। তাদের প্রতিভা দেখে আমি মুগ্ধ। পরদিন তাদের সবার জন্য ছোট্ট একটি করে উপহার নিয়ে গেলাম।
তাদের সবার জীবন সম্পর্কেও আমি খানিকটা ধারণা পেলাম। জানতে পারলাম লাবণী আর হাসান নামে দুই ভাইবোনের গল্প। লাবণী ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তার ছোট ভাই হাসান এখনো ডে-কেয়ারে। আগে তারা রাস্তায় মায়ের সঙ্গে থাকত। পরে তারা এই সেন্টারে জায়গা পায়। তাদের মা-ও এখানে কাজ পান।
আঁখি নামের মেয়েটি আগে থাকত কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ছোট থাকতেই তার মা মারা যায়। এরপর সে খালার কাছে বড় হয়। খালাকেই সে ‘মা’ বলে ডাকে।
মর্জিনা আর সুমাইয়া দুই বোন। আগে তারা সেন্টারের কাছে একটা জায়গায় পরিবারের সঙ্গে থাকত। খুব কষ্ট হতো সেখানে। এত দিনে তাদের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। কিছুদিন পরে তারা গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবে।
তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে অপূর্ব এক অভিজ্ঞতা হলো। পরিকল্পনা করেছি, সবাইকে একটি করে রঙের বক্স উপহার দেব। তাদের জীবনের কিছুটা সময়ও যদি রাঙিয়ে তুলতে পারি!