গল্পটা আছে হোটেল গ্রেভার ইন বইয়ে। গল্পটা বলার আগে নির্মলেন্দু গুণের প্রথম বরফ দেখার কবিতার কটা লাইন পড়া যাক। লাইনগুলো হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের শুরুতে তুলে দিয়েছেন।
‘খুলে দাও বরফের আলপনা আঁকা
হোটেলের সমস্ত জানালা।
খুলে দাও আমার পোশাক
আমাকে আবৃত করে আজ শুধু বরফ ঝরুক
সারা দিন… সারা দিন।
আজ শুধু বরফের সাথে খেলা।’
[জীবনের প্রথম বরফ: নির্মলেন্দু গুণ]
হোটেল গ্রেভার ইন বইটি হুমায়ূন আহমেদের আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ের স্মৃতিকথা। এতে স্ত্রীকে লেখা তাঁর লেখা চিঠির কথা আছে। চিঠির মধ্যে তিনি বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন বরফের বর্ণনা। কারণ, তখনো যুক্তরাষ্ট্রে বরফ পড়া শুরু হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ কি এই কবিতা থেকে সেই বরফের বর্ণনা কল্পনা করেছিলেন?
মূলত একটা হোটেলের নাম হোটেল গ্রেভার ইন। যুক্তরাষ্ট্রের ডাকোটায় ছিল হোটেলটি। সে সময় পিএইচডি করতে গেছেন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এয়ারপোর্টে হুমায়ূন আহমেদকে নিতে এসেছেন ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজর টয়লা ক্লেইন। একটু দেরি করে এসেছেন তিনি।
চারপাশে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। হুমায়ূন আহমেদকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলেন টয়লা ক্লেইন। প্রথমে ‘না’ বললেও ক্লেইনের যুক্তির কারণে ‘হ্যাঁ’ বললেন হুমায়ূন আহমেদ। কাগজের কাপে দুই কাপ কফি নিয়ে এলেন ক্লেইন। হুমায়ূন আহমেদের মতে, এর চেয়ে কুৎসিত কোনো পানীয় জীবনে তিনি খাননি। কষা, তিতকুটে, নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসবে এমন। ধারণা করতে পারি, তিনি মুখে দিয়েছিলেন আমেরিকানো, যে কফিতে কোনো দুধ বা চিনি থাকে না। আমাদের অভ্যাস দুধ ও চিনি দিয়ে চা–কফি খাওয়া। এখন অবশ্য অনেকেই আমেরিকানো খান। কড়া কফি। বোধ করি তখন আমাদের এই তল্লাটে এমন কড়া বস্তু খাওয়ার চল ছিল না।
কফি ভালো না লাগলেও আমাদের দেশের ভদ্রতা অনুযায়ী হুমায়ূন আহমেদ বললেন, খুব ভালো লাগছে। বিষয়টি বুঝতে পারেন ক্লেইন। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে বললেন, তোমাদের পূর্বদেশীয় ভদ্রতা যুক্তরাষ্ট্রে অচল। কফি ভালো লাগলে বলবে ভালো। খারাপ লাগলে ‘ইয়াক’ বলে ডাস্টবিনে কফির কাপ ছুড়ে ফেলবে। হুমায়ূন আহমেদ সঙ্গে সঙ্গে ‘ইয়াক’ বলে কফির কাপ ছুড়ে ফেললেন। তাঁর দাবি, এটিই তাঁর আমেরিকায় আমেরিকানদের মতো প্রথম আচরণ।
এয়ারপোর্ট থেকে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে রাখা হলো হোটেল গ্রেভার ইন-এ। এই হোটেল ইউনিভার্সিটিকে দান করেছেন হোটেলের মালিক। সব সুযোগ–সুবিধা আছে এখানে। পুরোনো ধরনের তিনতলা হোটেল। হুমায়ূন আহমেদকে দ্বিতীয় তলায় একটা বড় ঘর দেওয়া হলো। পাশের ঘরে এক বয়স্ক মহিলা থাকেন। তিনি ইউনিভার্সিটির কেউ নন। বাইরের মানুষেরা ভাড়া দিয়েও এই হোটেলে থাকতে পারেন।
হোটেলের একজন হুমায়ূন আহমেদকে এই হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেতে নিষেধ করলেন। বললেন, এখানে দাম বেশি, খাবার ভালো নয়। দুই ব্লক পরে যে হোটেলে খাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি, সেটার নাম বিফ অ্যান্ড বান। খাবারের দাম কম।
হুমায়ূন আহমেদ রাতে খেতে গেলেন বিফ অ্যান্ড বানে। ছোটখাটো রেস্টুরেন্ট। তিন সুন্দরী ওয়েট্রেস খাবার পরিবেশন করছেন। ১৯৭৭ সালের কথা। তখন দেশের বাইরে যাওয়ার সময় পকেটে ২০ ডলারের বেশি নেওয়া যেত না। এই হোটেলে ঢুকে দেখলেন, সব খাবারের দাম আট থেকে নয় ডলার। এর চেয়ে দামি খাবারও আছে। কিন্তু পরিচিত আর দামে সস্তা একটা খাবারই পেলেন হুমায়ূন আহমেদ। ফ্রেঞ্চ টোস্ট। অর্ডার করলেন। ওয়েট্রেস অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এটাই তোমার ডিনার?’ হুমায়ূন আহমেদ ইয়েস–নো দিয়ে তখনো কথাবার্তা চালাচ্ছেন। বললেন, ইয়েস। ড্রিংকস বা কফি লাগবে কি না-র উত্তরে বললেন, নো।
বইটিতে হোটেলের দারুণ কিছু বর্ণনা আছে। সেটা জানতে বইটি পড়তে হবে।
এবার জানা যাক, কেন হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গেলেন পিএইচডি করার জন্য। তাঁর মন দেশে ফিরে আসার জন্য হু হু করছিল। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী দেশে। কিছুদিন পর তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হবে। তাই এখানকার কিছুই তাঁর ভালো লাগছিল না। ইউনিভার্সিটিও ছুটি। সব ফাঁকা। ছুটির মধ্যে অল্প কয়েকটা কোর্স চলছে। দিনের বেলায় ইউনিভার্সিটিতে ঘোরাঘুরি করেন। রাতে হোটেলে ফিরে চেয়ারে বসে থাকেন। ঘুমাতে পারেন না।
একদিন ভোরবেলায় হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওয়াশিংটনের সিয়াটল থেকে ফোন করলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে হুমায়ূন আহমেদের আগে এসেছেন। পিএইচডি করছেন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে। ফোনে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘আমাকে টিকিট কেটে দে। আমি চলে যাই দেশে।’ জাফর ইকবাল জানালেন, তিনি ১০০ ডলার পাঠিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে।
এভাবে টাকার সমস্যা দূর হয়ে গেল। তবু হুমায়ূন আহমেদ প্রতিদিন বিফ অ্যান্ড বানে খেতে যান। গিয়ে আর বলা লাগে না কী খাবেন। প্রতিদিনই ফ্রেঞ্চ টোস্ট খান। সাদা ভাত, সর্ষেবাটা দিয়ে রান্না করা ইলিশের জন্য তাঁর মন কেমন করে। উপায় না থাকায় তিনি খান ফ্রেঞ্চ টোস্ট। এভাবে ছয় দিন কেটে গেল। এরপর ঘটল আনন্দদায়ক ঘটনা।
খেতে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কেউ অর্ডার নিতে আসছেন না। অনেক্ষণ একা বসে আছেন। এরপর এলেন এক মেয়ে। তিনি বললেন, ‘দেখো আহামাদ (বাঙালি নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে আমেরিকানদের অসুবিধা হয়), আমরা জানি তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। দিনের পর দিন তুমি একটা কুৎসিত খাবার মুখ বুজে খেয়ে যাচ্ছ। টাকাপয়সার কষ্টের মতো কষ্ট তো আর কিছুই হতে পারে না।’
তাই হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবেসে বিনা পয়সায় একটা ভালো ডিনারের ব্যবস্থা করল সেই রেস্টুরেন্ট। যার মধ্যে ছিল বিশাল ট্রেতে টি-বোন স্টেক। সঙ্গে নানা কিছু। আইসক্রিম, কফি এসবও। পকেটে ডলার থাকলেও তাদের সহানুভূতি দেখানোর ঘটনাকে নষ্ট করতে চাইলেন না হুমায়ূন আহমেদ। কিছুই বললেন না। ওয়েট্রেসরা সবাই এসে খোঁজ নিলেন, তিনি ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না। আবেগে হুমায়ূন আহমেদের চোখে পানি চলে এল। এত মমতা এক অপরিচিত ছেলের জন্য! মেয়েরা চোখের জল দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন।
খেয়েদেয়ে গভীর আনন্দ নিয়ে হোটেলে ফিরলেন হুমায়ূন আহমেদ। রাতে দেশে রেখে আসা স্ত্রীকে চিঠি লিখলেন। তুষারপাতের বর্ণনা দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে লিখলেন সুন্দর চিঠি। বিফ অ্যান্ড বান সহানুভূতি দেখিয়ে ডিনার খাওয়ানোয় হুমায়ূন আহমেদ সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। দেশে এখনই ফিরে যাবেন না। থেকে যাবেন পিএইচডি করার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের পিএইচডি–জীবনে এ রকম সুন্দর সব ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো জানার জন্য তোমাকে পড়তে হবে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিকথামূলক বই হোটেল গ্রেভার ইন।