বাংলাদেশের বানানো পিচে শ্রীলঙ্কা পারে, আমরা কেন পারি না

দুই ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশকে ধবলধোলাই করেছে শ্রীলঙ্কাশামসুল হক

ধরো, পাশের এক এলাকার সঙ্গে তোমরা দুটি ম্যাচ খেললে। খেলাগুলো হলোও তোমাদের মাঠে। কিন্তু সুবিধে করে নিল ওরা। একবার ব্যাট করে যা করল, সেটা তোমরা দুবার নেমেও পারলে না। রীতিমতো নাস্তানাবুদ! এলাকায় ঢি ঢি পড়ে গেল। আমাদেরই মাটি, জল-হাওয়া, সেখানে কি না রাজত্ব করল ওরা! চার-পাঁচ শ রান তুলে একদম ঘরে ঢুকে মেরে গেল!

এমন কথা শুনলে কার না মন খারাপ হয়। আসলে ক্রিকেট খেলাটাই এমন। টক-ঝাল-মিষ্টি। শুধু মিষ্টি খাবে, তা হবে না। আর ঝালটা না জানলে মিষ্টির স্বাদটাই তো ভালোভাবে বুঝবে না। জীবনে তাই ঝালও জরুরি, খেলাধুলায় যেমন হার। এটি এড়ানো যায় না। হারগুলোই তো প্রতিটি জয়ের ভিত। যেমন ধরো, ওই ম্যাচটা, ওভাবে হারের পর নিশ্চয়ই তদন্ত হয়। আরে, পুলিশ-ফুলিস কিছু নয়, কেন হারলে, কেন ব্যাটিংটা এত বাজে হলো, এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, বিশ্লেষণ আর কি। কারণগুলো বের করে অনুশীলনে সেগুলো শুধরে পরের ম্যাচেই তো জিততে পারো!

প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের এই চট্টগ্রাম টেস্টের কথাই ধরো। শ্রীলঙ্কা এক ইনিংসেই তুলল ৫৩১। আমরা দুই ইনিংস মিলিয়ে তুলেছি ৪৯৬। প্রথম ইনিংসে ১৭৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১৮। ব্যাপারটাকে আরেকটু বড় করে দেখা যাক। এই সিরিজে দুটি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। সিলেটে তো ২০০ পেরোয়নি। প্রথমে ১৮৮, তারপর ১৮২। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৭০। শ্রীলঙ্কা এক ইনিংসেই তুলেছে ৪১৮। এই আকাশ-পাতাল পার্থক্যের কারণ কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাঁদের কাজ, তিনি বা তাঁরা হয়তো ইতমধ্যেই তোমাদের সেই তদন্তের মতো কাজে নেমে গেছেন। ড্রেসিংরুমেও চলছে আত্মবিশ্লেষণ। বাইরে আমরাও খুঁজছি কারণ। ওরা আমাদের মাঠে চার-পাঁচ শ তুললেও আমরা কেন পারিনি?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে।

বাংলা পরীক্ষার আগে আমরা নিশ্চয়ই গণিতের হোমওয়ার্ক করি না। কিংবা সামাজিক বিজ্ঞানের প্রস্তুতিতে ইংরেজি পড়ি না। যদি পড়ি, কিংবা পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্তও একটু হোমওয়ার্ক করার সুযোগ না পাই, তাহলে কী হয়? ডাহা ফেল।

খেতাবটা বাংলাদেশ দলকেও তুমি চাইলে এই সিরিজে দিতে পারো। সেটা দেবে না জানি, শেষ ইনিংসে তো একটু হলেও প্রতিরোধের আলো দেখা গিয়েছিল। ওই যে ৩১৮। সে যা হোক, আমরা বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রস্তুতিতে একটু তাকাতে পারি।

সিলেটে টেস্ট সিরিজ শুরু হয়েছে ২২ মার্চ। বাংলাদেশ দল তার আগে সর্বশেষ টেস্ট ক্রিকেটের মাঠে ছিল ৯ ডিসেম্বর (নিউজিল্যান্ড সিরিজ)। এই ৩ মাস ১৩ দিনের বিরতিটা কেমন, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে তোমাদের কাছেই। মানে যারা ক্রিকেট খেলো, তারা ভালো বুঝবে। পাড়া-মহল্লায় এখন তো টি-টোয়েন্টি অথবা টি-টেনই বেশি চলে, বিশের বেশি ওভারে খেলা হয় কমই। এই তিন সংস্করণের প্রস্তুতিও তিন রকম।

সামনে সব কটি সংস্করণেই টুর্নামেন্ট থাকলে সব রকম হোমওয়ার্ক সেরে রাখতে হয়। কারণ, চর্চাই তো সব। কেন, সে উদাহরণ পরে দেওয়া যাবে, আগে দেখে নেওয়া যাক, এই ৩ মাস ১৩ দিনে বাংলাদেশ দলের হোমওয়ার্কে কী ছিল?

নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ বাংলাদেশ শেষ করেছে ডিসেম্বরের শেষ দিনে। মাঝে দিন ১৫ বিরতির পর বিপিএল শুরু হলো ১৯ জানুয়ারি। শেষ হতে হতে গত মাসের প্রথম দিন, মানে ১ মার্চ। এরপর তো শ্রীলঙ্কা চলে এল। ৪ মার্চ থেকে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু হয়ে ওয়ানডে সিরিজ শেষ হলো ১৮ মার্চ। তিন দিন বিরতির পর শুরু হলো টেস্ট সিরিজ।

মাঝে একটি টুর্নামেন্টও শুরু হয়েছে। ১১ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। এটি ওয়ানডে সংস্করণের টুর্নামেন্ট। অর্থাৎ টেস্ট দলের বিশেষজ্ঞ কিংবা তিন সংস্করণেই ভালো, এমন কেউ এই ৩ মাস ১৩ দিনে দীর্ঘ সংস্করণের ম্যাচ খেলেননি। যেমন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। স্বাভাবিকভাবেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সেই ধাক্কাটা লাগার কথা। ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে তা বোঝা গেছে প্রকট। বড় দৈর্ঘ্যের ইনিংস খেলা কিংবা ক্রিজে কামড়ে একটা দিন পার করে দেওয়া, এসব শুধু দক্ষতার ব্যাপার নয়, চর্চাও লাগে। চর্চা হলেই তো দক্ষতা বাড়ে। ধৈর্য ধরে ক্রিজে সেশন টু সেশন পড়ে থাকতে যে ধরনের অভ্যাস লাগে, সেসব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা ছিল না।

বলতে পারো, বা রে! তবে যে শ্রীলঙ্কা পারছে! আসলে পার্থক্যটাও এখানেই। শ্রীলঙ্কার প্রধান ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট ‘মেজর লিগ টুর্নামেন্ট’ এর ফাইনাল হয়েছে গত বছর ৮ ডিসেম্বর। সেই টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কার টেস্ট দলের খেলোয়াড়দের অনেকেই ছিলেন। সেখানে দিনেশ চান্ডিমাল, আসিতা ফার্নান্দো, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, কামিন্দু মেন্ডিসরা খেলেছেন। এরপর গত ১৮ জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল সুপার লিগ—যেটি চার দিনের টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজে রানের ফল্গুধারা বইয়ে দেওয়া ধনাঞ্জয়া, কামিন্দু এবং কুশল মেন্ডিসরা সেখানেও খেলে এই সিরিজের প্রস্তুতি সেরেছেন। মাঝে জিম্বাবুয়ে ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি, ওয়ানডে সিরিজও খেলেছে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল। তাই বলে টেস্টের প্রস্তুতিটা আলাদা করে সেরে রাখতে তাঁরা ভুল করেনি।

টেস্টে দীর্ঘ সময় ব্যাটিংয়ে দক্ষতার সঙ্গে অভ্যাসও লাগে। গরমের মধ্যে ক্রিজ কামড়ে থেকে দলকে বড় সংগ্রহ এনে দেওয়াটা অবশ্যই চর্চার ব্যাপার। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগেই সেই চর্চাই করে এসেছেন শ্রীলঙ্কার টেস্ট ব্যাটসম্যানরা। এরপর সিরিজে দুই টেস্টে সময় যত গড়িয়েছে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং তত ভালো হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক তা–ই। সেই যে গত বছর ৯ ডিসেম্বরের পর সিলেটে ২২ মার্চ টেস্ট খেলতে নামল বাংলাদেশ—নেমেই কিন্তু ভালো করতে শুরু করেনি। দুই টেস্টে মোট চার ইনিংসের স্কোরগুলো যথাক্রমে সাজালেই ব্যাপারটা বোঝা যায়—১৮৮, ১৮২, ১৭৮ এবং ৩১৮।

বাংলাদেশকে একটিও বড় জুটি গড়তে দেয়নি শ্রীলঙ্কা
শামসুল হক

যেহেতু বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ খেলার মধ্যে ছিলেন না খেলোয়াড়েরা, তাই টেস্ট কন্ডিশনে নেমেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সুবিধে করতে পারেননি। দুই টেস্ট মিলিয়ে প্রথম তিন ইনিংসেই যাচ্ছেতাই হয় পারফরম্যান্স। কিন্তু শেষ ইনিংসে এসে—চট্টগ্রামে চতুর্থ ইনিংস—টেস্টের মেজাজ কিছুটা হলেও ফিরেছিল ব্যাটসম্যানের মধ্যে। সে জন্যই ওই ৩১৮। রসিকতা করে কেউ কেউ আগের তিনটি ইনিংসকে তাই ‘চর্চা’ও বলতে পারো। শ্রীলঙ্কা যে অনুশীলনটা করে এসে প্রথম টেস্ট থেকেই ফসল তুলে নিয়েছে, বাংলাদেশ তো আর সেটি করতে পারেনি। এ কারণে প্রথম টেস্টে ও দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসটা তাই এ সংস্করণের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই গলদঘর্ম ছুটেছে।

যেকোনো বিষয়ে চর্চাটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা এখন বুঝেছো তো? অনুশীলন না থাকলে, তা যত মেধাবিই হও, ব্যাটিংটা যেমন মনের মতো হয় না, তেমনি পড়ালেখাতেও খুব করা ভালো সম্ভব হয় না।

শ্রীলঙ্কা টেস্ট খেলার চর্চাটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টে করে এসেছিল বলেই আমাদের মাটিতে চার–পাঁচ শ করতে পেরেছে। আমরা আমাদের মাটিতে পারিনি; কারণ, গত তিন মাসে এই সংস্করণের জন্য আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। বলতে পারো, অনেকেই তো তিন সংস্করণ একসঙ্গে খেলে ভালোও করছে।

উদাহরণ হিসেবে তুমি বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, কেইন উইলিয়ামসদের টানতে পারো। কিন্তু তাঁরা তো মহাতারকা—সাধারণের চেয়ে আলাদা, তাই ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম দিয়ে কি উদাহরণ চলে?

ক্লাসের ফার্স্ট বয়/গার্লের সঙ্গে নিশ্চয়ই গোটা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের তুলনা চলে না! সাধারনকে তাঁদের কাতারে উঠতে হলে প্রচুর খাটতে হয়, মানে অনুশীলন ও চর্চার প্রয়োজন। তবেই না ভালো কিছু আশা করা সম্ভব।

এই সিরিজের আগে বাংলাদেশ কি তা পেরেছে?