শঙ্কু কেন গিরিডিতে থাকেন?

এই প্রশ্নের খুব সরল জবাব হলো গিরিডি প্রফেসর শঙ্কুর পৈতৃক নিবাস। এখানেই তাঁর দাদাবাড়ি। এখানেই শঙ্কু জন্মেছেন। গিরিডির স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছেন তিনি। তারপর কলকাতায় কলেজে পড়েছেন। এদিক থেকে দেখলে গিরিডিতে থাকাই শঙ্কুর জন্য সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা।

তবু প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল, শঙ্কু কেন গিরিডিতে থাকেন?

মানে আসল প্রশ্ন হলো: শঙ্কুর পৈতৃক ভিটা কেন গিরিডিতেই হতে হলো? কেন সেটা কলকাতা বা বর্ধমান বা হুগলি নয়?

প্রশ্নটা বুঝে দেখা দরকার। প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয় একটি চরিত্র। খ্যাপাটে এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে সত্যজিৎ অনেকগুলো কাহিনি লিখেছেন—৩৮টি সম্পূর্ণ গল্প, ২টি অসম্পূর্ণ গল্প। সব মিলিয়ে ৪০টি। ১৯৬১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ধরে গল্পগুলো লেখা হয়েছে।

কথা হলো, সত্যজিৎ নিজে কলকাতার মানুষ। কলকাতায় জন্ম ও মৃত্যু। তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদাও কলকাতার লোক। দক্ষিণ কলকাতায় ২১ রজনী সেন রোডে তাঁর বসবাস, যদিও ফেলুদার জন্ম সম্ভবত ঢাকায়। কেননা দেখা যাচ্ছে, ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। ফেলুদার বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন তাঁর মা-বাবা মারা যান। তারপর থেকে বাবার বড় ভাইয়ের কাছে কলকাতায় মানুষ হয়েছেন ফেলুদা। সত্যজিৎ রায়ের অপর সৃষ্টি তাড়িনী খুড়ো, অর্থাৎ তাড়িনীচরণ বাড়ুজ্জে থাকেন কলকাতার শোভাবাজারের বেনেটোলায়। তাহলে প্রফেসর শঙ্কু কেন অমন একা পড়ে গেলেন? কেন কলকাতা থেকে প্রায় সোয়া তিন শ মাইল দূরে, ঝাড়খন্ড নামে ভিন্ন এক প্রদেশের এক মামুলি মফস্বল শহরে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর স্রষ্টা?

এটা একটা প্রশ্ন বটে।

খোঁজখবর করে দেখতে পাচ্ছি, কলকাতা শহরের সঙ্গে শঙ্কুর নিবিড় যোগ ছিল। কিশোর বয়সে গিরিডি ছেড়ে কলকাতাতেই চলে আসতে হয়েছে তাঁকে। সেখানে কলেজে পড়েছেন। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে ডাবল অনার্সসহ বিএসসি পাস করেছেন। ২০ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনাও শুরু করেন তিনি (মনে রাখতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই একই কলেজের ছাত্র ছিলেন ফেলুদা। ফলে এমন যদি হয়ে থাকে যে, ফেলুদা কোনো একসময় প্রফেসর শঙ্কুর ছাত্র ছিলেন, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না)। শঙ্কু স্কটিশ চার্চ কলেজে কত দিন অধ্যাপনা করেছেন জানা যায় না। শুধু এটুকু জানা যায় যে একদিন সবকিছু গুটিয়ে তিনি ফিরে গেছেন তাঁর শৈশবের শহর গিরিডিতে। সেখানে গিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করেছেন। গবেষণাগারটা স্থাপন করা হয়েছিল সম্ভবত পৈতৃক ভিটাতেই।

শঙ্কুর গিরিডিতে অবস্থানকে যদি একটা রহস্য বা ধাঁধা হিসেবে দেখি, সে ক্ষেত্রে এই ধাঁধা সমাধানের পথে আমাদের দুটি ধাপ পেরোতে হবে। প্রথম ধাপে আমাদের ধরে নিতে হবে, ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। মানে সত্যজিৎ রায় দৈবচয়ন ভিত্তিতে মানচিত্র খুলে চোখ বুজে একটা জায়গায় আঙুল বসিয়ে গিরিডি পেয়ে যাননি।

দ্বিতীয় ধাপে আমাদের ধরে নিতে হবে গিরিডি বেছে নেওয়ার পেছনে একটা কোনো যোগসূত্র কাজ করেছে। কী সেই যোগসূত্র, তা অনুসন্ধানের আগে আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার কেন কলকাতায় শঙ্কুর ঠাঁই হওয়া সম্ভব ছিল না, কেন তাঁকে কলকাতা ছাড়তেই হতো।

এই প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটির ভেতরেই। দেখা যাচ্ছে, একেবারে গোড়ায় শঙ্কুর চরিত্রটি উন্মোচন হয়েছে ক্রমশ দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকা এক অসীমের যাত্রী হিসেবে। আমরা যখন তাঁর ডায়েরি পড়তে শুরু করেছি, তত দিনে শঙ্কু একটি উল্কার গায়ে আটকা পড়ে দূর নক্ষত্রলোকের যাত্রী হয়ে পড়েছেন। গিরিডি এবং কলকাতা তো বটেই, পুরো পৃথিবী ছেড়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন তিনি। ফ্যান্টাসি আর কুহকে জড়ানো এ রকম একটি চরিত্রের বসবাস থাকতে হয় সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখায়। সে জন্যই কি পশ্চিমবঙ্গের সীমানার বাইরে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ধার ঘেঁষে ঝাড়খন্ড প্রদেশের একটি ব্রাঞ্চলাইন শহর বেছে নেওয়া?

এটা তো মানতেই হবে, সত্যজিতের অন্য চরিত্রগুলোর ভিড়ের মধ্যে শঙ্কু ঠিক খাপে খাপে মেলে না, মেশে না। শঙ্কু অনেকখানিই ব্যতিক্রম।

কাল্পনিক চরিত্রকে দূরের কোনো ভূগোলের মধ্যে স্থাপন করার একটা প্রচলন কিন্তু অনেক দিন ধরেই বিশ্বসাহিত্যে চালু আছে। যেমন ধরা যাক এডগার অ্যালান পোর গোয়েন্দা চরিত্র আগুস্ত দুঁপার কথা। অ্যালান পো যুক্তরাষ্ট্রের লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর গোয়েন্দা চরিত্রকে তিনি ঠাঁই দিলেন আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে। এইচ আর এফ কিটিং নামে এক ব্রিটিশ লেখকের তৈরি গোয়েন্দা চরিত্র ইন্সপেক্টর ঘোটের স্থান জুটল ভারতের বোম্বে বা মুম্বাই শহরে। আরেক ব্রিটিশ লেখক মাইকেল ডিবডিনের গোয়েন্দা অরলিয়ানো জেনের বসবাস ইতালিতে। আবার অনেকে তাঁদের গোয়েন্দা চরিত্রের জাতীয়তাও বদলে দিয়েছেন। যেমন ব্রিটিশ লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা চরিত্র এরকুল পোয়ারো জাতিতে ছিলেন বেলজিয়ান।

কাজেই নিজের চরিত্রকে দূরের অচেনা পরিবেশে, ভিন্ন ধারার ঘরবাড়ির মধ্যে স্থাপন করা সাহিত্যে নতুন কোনো প্রবণতা নয়। শঙ্কুর জন্য সত্যজিৎ রায়ের এ রকম একটা অপরিচয়ের আড়াল দরকার হয়েছিল।

এটুকু না হয় মানা গেল। ধরা যাক, আমরা স্বীকার করে নিলাম, কলকাতা থেকে শঙ্কুকে বিতাড়িত হতেই হতো। কিন্তু এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন: কেন গিরিডি? কেন অন্য কোনো জায়গা নয়?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে গিরিডি শহরের মধ্যে। দেখতে হবে শহরটির বৈশিষ্ট্য।

গিরিডি দীর্ঘদিন ধরে ছিল ভারতের বিহার প্রদেশের একটি জেলা শহর। ২০০০ সালে বিহারের দক্ষিণ অংশ ভেঙে ঝাড়খন্ড নামে নতুন একটি প্রদেশ তৈরি হলে সেটা এখন ঝাড়খন্ডের মধ্যে পড়েছে।

দূরের শহর হলেও বাঙালিদের কাছে গিরিডি আসলে ততটা বিচ্ছিন্ন অচেনা শহর নয়। বরং সেটাকে বাঙালি-অধ্যুষিত শহরই বলতে হবে। ব্রিটিশ আমল থেকে সেখানে বাঙালিদের বসবাস। ১৮৭০-এর দশকে এই জেলায় বেশ কিছু তামার খনি আবিষ্কার হলে একদল জার্মান ব্যবসায়ী খনির মালিকানা কিনে এখানে বসবাস শুরু করেন। গিরিডিতে তাঁরা সুন্দর সুন্দর বাংলো বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু খনির ব্যবসা ভালো চলেনি। কিছুদিন পরে জার্মান নাগরিকেরা ব্যবসা গুটিয়ে চলে যান। এরপর ১৮৯০-এর দশক থেকে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালিরা এসব ঘরবাড়ি কিনে নিতে শুরু করেন। তাঁদের কাছে গিরিডি হয়ে ওঠে পছন্দের অবকাশ কেন্দ্র। বায়ুবদলের জন্য তাঁরা সেখানে যেতে শুরু করেন। কলকাতাবাসী বাঙালিরা ট্রেনে করে নিয়মিত কলকাতা-গিরিডি যাতায়াত করছেন—এমন উল্লেখ অনেক গল্প-উপন্যাসেই দেখা যাবে।

মূলত ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী শিক্ষিত বাঙালিরা গিরিডিতে বসবাস শুরু করেন। শহরটা খুবই সুন্দর। চারপাশে ছোট-বড় পাথুরে টিলা। শহরের এক প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে উশ্রী নামে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। এক ধারে শিরশিয়া নামে একটা মনোরম লেক বা ঝিল আছে।

খোঁজখবর করে দেখছি, গিরিডিতে বসবাসকারীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সত্যজিতের নিজের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও। সবচেয়ে বড় কথা শঙ্কুর মতোই এক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর বসবাস ছিল গিরিডিতে। তিনি আমাদের বিক্রমপুরের জগদীশচন্দ্র বসু। শঙ্কুর মতোই খ্যাপাটে এই বিজ্ঞানীর নানান মহা আবিষ্কার জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছে।

এই সব বিবেচনায় নিলে কলকাতার বাইরে গিরিডি শহরই শঙ্কুর জন্য সবচেয়ে স্বাভাবিক বাসস্থান বলে মনে হবে। এটা এমন এক শহর, যা বাঙালির কল্পরাজ্যের সীমান্তে অবস্থান করে।

গিরিডিনিবাসী বাঙালি কবি সুনির্মল বসুর একটি কবিতা দিয়ে শেষ করি:

মনে পড়ে অতীতের স্মৃতি অনাবিল
উশ্রী নদীর জল করে ঝিলমিল
আমলকী বনে বনে ছায়া কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে
শিরশির করে ওঠে ‘শিরশিয়া ঝিল’।